জাপানীরা ১৯৩৭ সালে নানকিং (এখন নানজিং) এ চাইনিজদের কচুকাটা করেছিলো। খুন -ধর্ষণ মিলিয়ে এমন নৃশংসতা কমই দেখেছে বিশ্ব। The flowers of war নামে একটি মর্মস্পর্শী মুভি আছে এই গণহত্যা নিয়ে। জাপানীরা এর আগে পরেও লাখে লাখে মরেছে-মেরেছে। শেষতক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জব্দ জাপান বাধ্য হয়েই রক্তের নেশা ছেড়ে জাতি গঠনে মনোযোগ দিয়েছিলো বলেই আজ তারা পৃথিবীর অন্যতম সভ্য জাতিতে পরিণত হতে পেরেছে।
এই জাতি গঠনের পিছনে জাপানীরা চিরকৃতজ্ঞ কুষ্টিয়ায় জন্ম নেয়া একজন বাঙালির কাছে। মিত্রপক্ষের চাপ সত্বেও ইন্টারন্যাশনাল যুদ্ধাপরাধ টাইব্যুনালের ‘টোকিও ট্রায়াল’ ফেজে এই বাঙালি বিচারকের দৃঢ অবস্থানের কারণেই জাপান অনেক কম ক্ষতিপূরণের উপরে বেঁচে গিয়েছিলো। নয়তো যে ক্ষতিপূরণের বোঝা মিত্রপক্ষ ও অন্য বিচারকরা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেনন তার দায় এখন পর্যন্ত টানতে হতো জাপানকে। সেক্ষেত্রে ঋণের বোঝা টানতে টানতে জাতি গঠনের সুযোগই আর পাওয়া হতোনা জাপানের।
দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল তাকে বিচারক হিসেবে চাইছে। সেখানে ১১ জনের একজন হয়ে যাবেন তিনি। আন্তর্জাতিক অপরাধের ন্যায় বিচার করবেন। কিন্তু টোকিও পৌঁছে তার ভুল ভাঙল। তাকে মেধাবী যোগ্য বিচারক হিসেবে এখানে আনা হয়নি। বরং অবহেলিত দেশের ক্ষুদ্র প্রতিনিধি হিসেবে বিচারকদের প্যানেলে একটা সমতা রক্ষার জন্য আনা হয়েছে। সেখানে রাধাবিনোদ কী মতামত দেন তা কারোর কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল আলাদা একটি হোটেলে। বাকি ১০ জনের জন্য ছিল ভিন্ন ব্যবস্থা।
বিচারের সময় চলে এলে রাধাবিনোদ ভিন্ন মত পোষণ করলেন। জাপান যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধচলাকালে যে কম অপরাধ ঘটায়নি তা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু দোষ শুধু জাপানের একার ছিল না। নাগাসাকি, হিরোশিমাতে বোমাবাজি করে মানবতার অপমান না করলেও জাপান আত্মসমর্পণ করতো। এইসব যুদ্ধাপরাধের জন্য, হাজার হাজার নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য এই শক্তিশালী দেশগুলোরও তাহলে শাস্তি পাওনা আছে। তার এই কথায় ফুঁসে উঠল প্যানেল। তাদের ধারণা, ভারতীয় উপমহাদেশে পাশ্চাত্যের আগ্রাসন বিরোধী এই বাঙালি নিতান্তই মিত্রশক্তি বিদ্বেষী।
অভিযোগগুলোর তিনটি ভাগ ছিল- এ, বি ও সি। এ শ্রেণীর অভিযোগ ছিল শান্তিবিরোধী অপরাধ। বি আর সি শ্রেণীতে ছিল প্রচলিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। রাধাবিনোদ পাল ট্রাইব্যুনালকে মনে করিয়ে দিলেন এ এবং সি শ্রেণীর অভিযোগ কার্যকর হবে না। কারণ জাপান যখন যুদ্ধে যায় তখনও আন্তর্জাতিক আইনে এমন কোনো আইন অন্তর্ভুক্ত ছিল না, যদি আইনই না থাকে, তাহলে জাপান আইন কিভাবে ভাঙল? পুরো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে রাধাবিনোদ লিখলেন তার ঐতিহাসিক রায়। যার কিয়দংশ প্রকাশিত হয়েছে।
ধারণা করা হয়, এই রায় ছিল ১,২৩৫ পৃষ্ঠার। তিনি লিখেছিলেন জাপান তার অধিকৃত ভূমিতে যা করেছে তা ন্যাক্কারজনক, কিন্তু যে লোকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ যোগাড় করতে পারেনি ট্রাইব্যুনাল। তিনি তার রায়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন, অভিযুক্তদের করা অপরাধ যুক্তরাষ্ট্রের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে করা অপরাধের চেয়েও বেশি ঘৃণ্য কিনা। যুদ্ধচলাকালে ব্রিটিশ ও আমেরিকান বিমানবাহিনী শত্রুদেশের সাধারণ নাগরিকদের সর্বোচ্চ মৃত্যু নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কারে ব্যস্ত ছিল।
তার রায় এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, ফরাসী আর ডাচ বিচারকেরা তা থেকে প্রভাবিত হয়ে কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থানে সরে আসেন। তবে মিত্রশক্তির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তারা নিজেদের রায়ে জাপানি অফিসারদের শাস্তি চাইতে ভোলেননি। রাধাবিনোদ পালের মূল রায়টির কিছু অংশ অনেক বছর পর জাপান সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এই শর্তে যে, তারা ট্রাইব্যুনালের রায় মেনে নেবে।
সেসময়ই জাপানী সম্রাট হিরোহিতো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলেছিলেন, “যতদিন জাপান থাকবে বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবেনা। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নি:স্বার্থ বন্ধু।”
এটি যে শুধু কথার কথা ছিলোনা তার প্রমাণ আমরা এখনো দেখতে পাই। জাপান এখনো বাংলাদেশের সবচে নি:স্বার্থ বন্ধু। এই ঘটনার প্রায় ৬৫ বছর পর ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিসান হামলায় প্রাণ গেলো নয় জাপানিজ বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারের। জাপান তখনও পাশে ছিলো বাংলাদেশের।
আর কুষ্টিয়ায় জন্ম নেয়া সেই বাঙালি বিচারকের নাম এখনো জাপানী পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য। তাঁর নামে জাপানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কিছু মেমোরিয়াল ও মনুমেন্ট। এই বিস্মৃত বাঙালির নাম বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল (১৮৮৬-১৯৬৭)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক ছাড়াও জীবদ্দশায় অনেক বড় বড় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে তিনি কুষ্টিয়ায় নিজ গ্রামের স্কুল ও রাজশাহী কলেজের ছাত্র ছিলেন। কর্মজীবনের শুরুতে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে প্রভাষক ছিলেন। কিছুদিন ময়মনসিংহ কোর্টে আইন ব্যবসাও করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই জাপানীদের বাংলাদেশের প্রতি নি:স্বার্থ সহযোগী মনোভাব দেখে এর কারণ কি হতে পারে ভাবতাম। পরে কারণ জানার পর ভদ্রলোককে নিয়ে লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়ে উঠছিলো না অনেকদিন। আজ ভারমুক্ত হলাম। গুগল করলে আরো ডিটেইলস পাবেন। নেটফ্লিক্সে পাবেন “টোকিও ট্রায়াল” নামের সিরিয়াল যেখানে রাধাবিনোদের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ইরফান খান।
কিন্তু একজন বাঙালি হিসেবে, একজন বাংলাদেশি হিসেবে আপনি আমি তার মত মেধাবী বাঙালি মানুষগুলোকে মনে রাখার ছোট্ট দায়িত্বটার কতটুকু পালন করেছি? বাঙালির মেধাগত বীরত্বের এই চমৎকার অধ্যায়টা জানে খুব অল্প মানুষ! অথচ কত ঠুনকো বিষয়ই না বাঙালি মানসে পায় সীমাহীন গুরুত্ব!