ছাত্রজীবনে একটা সময় ছিল যখন মা-বাবারা ছেলেমেয়েকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পড়ানো ছাড়া অন্যকিছু কল্পনাও করতো না।
কিন্তু এই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর বাহিরে অন্য কোন বিষয় নিয়েও যে পড়ালেখা করা যায়, সেই বিষয়ে তাদের ধারণা ছিল অতি স্বল্প।
আজ আমরা আলোচনা করবো “ব্যাবসায় শিক্ষা বিভাগে কেন পড়া উচিৎ” বা “ব্যাবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়ে কি হওয়া যায়??”
আমাদের অভিভাবকেরদের মধ্যে যাদের সন্তান একটু মেধাবী, তাদের ৮০% অভিভাবক বা শিক্ষক নবম শ্রেণিতে ভর্তির সময় সাইন্স পড়ার উপদেশ দিয়ে থাকে।
কিন্তু তারা একবারের জন্যও ভাবেনা যে, আজ আপনি মেধাবী আছেন,আগামী ২বছর পর আপনার সেই মেধা নাও থাকতে পারে।
সাইন্স বা বিজ্ঞাণ বিভাগে পড়তে হলে আপনাকে অনেক বেশি মেধাবী হতে হবে। পাশাপাশি এসএসসি এবং এইচএসসি দুটোতেই জিপিএ-৫ পেতে হবে। এর বিকল্প নেই।
এই বিষয়ে অভিবাবকেদের যুক্তি হলো, সাইন্সে পড়লে যেকোন সময় বিভাগ পরিবর্তন করতে পারবে।
কিন্তু আমার কথা হলো, বিভাগ পরিবর্তন করলে সে যদি অন্য বিভাগে গিয়ে নিজেকে ঠিকভাবে মানিয়ে নিতে না পারে,তখন কি হবে?
এককথায় অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করায়।
কমার্সে পড়ে কি হওয়া যায়
তারপর যখন এসএসসিতে যারা জিপিএ-৫ পায়না,তখন অনেক অভিভাবক তাদের সন্তান বা আত্বীয়স্বজনকের মানবিকে ভর্তি হতে বলে!!!
এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি,মানবিকে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগী কম। তাই ভালো ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেশি থাকে।
এটি অনেকটি ভুল একটি সিদ্ধান্ত।
কারন ধরুন আপনি সাধারন কোন বিষয় নিয়ে মানবিক থেকে ভালো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেন।
মানবিকে একমাত্র প্রফেশনাল বিষয় “আইন বিভাগ”
সাড়া বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে আইন বিভাগের আইনের আসন কয়টা???
আপনি যদি মানবিক থেকে আইন বিভাগে পড়তে পারেন,তাহলে খুবই ভালো।
আইন ছাড়া সকল বিষয়েই আপনাকে বিসিএস দিতে হবে। আর বিসিএস পরীক্ষা এমন এক পরীক্ষা ৮০% প্রিলিমিনারী থেকেই বাদ যায়।
আপনি যে ৪ বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সিল সংবলিত টি-শার্ট পড়েছিলেন,সেটা দেখাতে হলে, আপনাকে প্রিলিমিনারী, রিটেন পরীক্ষায় অতিক্রম করতে হবে।
তার মানে, ১লাখ স্টুডেন্ট এর মধ্যে সেরা ২হাজার স্টুডেন্ট এর কাতারে আপনাকে আসতে হবে। তারপর আপনি ভাইবা বোর্ডে গিয়ে আপনার ভার্সিটির টি-শার্ট দেখানোর চান্স পাবেন।
এখন আমাদের প্রসঙ্গে আসি ,
আপনি যদি ব্যাবসায় শিক্ষা বিভাগের স্টুডেন্ট হয়ে থাকেন। তবে শুরুতে আপনার জন্য যেসকল চাকরীতে আপনাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে সেগুলা আলোচনা করা হলোঃ
১) ব্যাংকঃ আপনি ব্যাংকের চাকরির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবেন যদি আপনি ব্যাবসায় শিক্ষা বা কমার্সের শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন।
অনেকে বলবে, ভাই, আমার এক চাচাতো ভাইয়ের ফুফাতো ভাই, আর্টস থেকে ইকোনমিকস পড়ে ব্যাংকে চাকরী করে।
তাদের জন্য আমার উত্তর হলো, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য সরকারের চাপের কারনে ব্যাংকে অন্যন্যা ডিপার্টমেন্ট এর স্টুডেন্ট নিয়ে থাকে। আপনি যদি সৎভাবে ব্যাংকে চাকরী করতে চান,তবে কমার্সের বিকল্প নেই। কারন সারাজীবন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কোটি কোটি টাকার হিসেব কে করেছে???
২) শিল্পপ্রতিষ্ঠানঃ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদে যারা আছে, সবাই কমার্স বেকগ্রাউন্ডের। একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান কিভাবে চালাতে হবে, শ্রমিকদের মোটিভেশন কিভাবে দিতে হবে। শ্রমিকের মজুরি হার কিভাবে নির্ধারণ করতে হবে। এইসব বিষয় কমার্সের স্টুডেন্টের চেয়ে বেশি কেউ জানেনা।
আপনি যদি সিএ ডিগ্রি অর্জন করতে পারেন তবে,আপনার প্রাথমিক অবস্থায় বেতন হবে, প্রায় দেড় লক্ষ টাকা।
আর যদি সিএ সম্পূর্ন শেষ করতে নাও পারেন,তবুও আপনার ভালো বেতনে চাকরির জন্য অগ্রাধিকার পাবেন। কমার্স ছাড়া অন্য বিভাগের স্টুডেন্টের কাছে সিএ কোর্সগুলো চিরতার রসের মতো লাগবে।
৩) বীমা প্রতিষ্ঠানঃ বাংলাদেশে বর্তমানে বীমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এইসব বীমা প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কমার্সের স্টুডেন্টদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
৪) মার্কেটি প্রতিষ্ঠানঃ শুধুমাত্র মার্কেটিং এর কারনে অনেক পন্য বাজার দখল করে। আবার অনেক ভালোমানের পন্যের নাম কেউ জানেনা।
ব্যাবসায় শিক্ষার এমন একটি বিভাগ হলো মার্কেটিং। আপনি যদি মার্কেটি নিয়ে পড়ালেখা করেন, তাহলে যেকোন বড় কোন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ মার্কেটি ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে পারবেন।
৫) সফল ব্যাবসায়ীঃ আপনি যদি চাকরি না করে সফল ব্যাবসায়ী হতে চান। তবে ব্যাবসায় শিক্ষা বিভাগে অধ্যায়ন করা আপনার জন্য জরুরী। কারন ব্যাবসায় শিক্ষা পড়ার মাধ্যমে আপনি হিসেবনিকেশে দক্ষ হবেন। একইসাথে আপনার ব্যাবসায় প্রচার-প্রসার সহ শ্রমিকদের বা কর্মকর্তার সাথে কিভাবে ব্যাবহার করবেন। কিভাবে কোন চুক্তি করবে। ব্যাবসায় আইনকানুন সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকবে সবার উপরে!! ফলে একজন সফল ব্যাবসায়ী হতে হলে আপনাকে ব্যাবসায় শিক্ষা বিভাগে অধ্যয়ন করা জরুরী।
আর আপনি যদি উচ্চ বেতনের চাকরির কথা চিন্তা করে থাকেন, তাহলে ব্যাবসায় প্রশাসন বিভাগের চাকরীতে উচ্চবেতনের চাকরির সংখ্যা যেকোন বিভাগের তুলনায় বেশি।
এখন আলোচনা করি ব্যাবসায় শিক্ষা বিভাগ বা কমার্সে পড়ার কারনে আপনাকে যেসকল বাধার সম্মূখীন হতে হবে
১) ভার্সিটি ভর্তিঃ কমার্সে ভার্সিটি ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে থাকে। অপরদিকে সেই তুলনায় আসন সংখ্যা অনেক কম থাকে।
মনে রাখবেন, ভালো কিছু পাবার ক্ষেত্রে প্রতিযোগী সর্বদাই বেশি থাকে।
বিটিভিতে বিজ্ঞাপন দেখেননি “জিনিস যেটা ভালো,দাম তার একটু বেশিই”
সেক্ষেত্রে আপনি যদি কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে,জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ’তে পড়ালেখা করেন, তাহলে আপনি পাবলিকের কাছাকাছি সম্মান পাবেন। আর এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার মান আগের তুলনায় বহুগুণ ভালো। নতুন সিলেবাস কাঠামো, নম্বরে কাঠামো, নিয়মমাফিক ক্লাস পরীক্ষার কারনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক থেকে কোন অংশে পিছিয়ে নেই।
আর ঢাবি,জাবি,রাবি ছাড়া অন্যান্য পাবলিকের বিবিএ ডিগ্রির সম্মান,অনেকটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি।
২) অধিক পড়ালেখাঃ কমার্সে পড়লে আপনাকে অন্যদের চেয়ে একটু অধিক পড়ালেখা করতে হবে। তবে একটা বিষয়, ভার্সিটি লেবেলে বাংলায় ডিপার্টমেন্ট এর একজন ছাত্রছাত্রী যে সময় বিসিএস প্রস্তুতির জন্য,সাধারণজ্ঞান গনিত পরবে, আপনি সেই সময়টুকু হিসাববিজ্ঞান ফিন্যান্সের অংকের পেছনে দিবেন। তাহলে যথেষ্ট। হিসাববিজ্ঞান ফিন্যান্স পড়লে, এর ফলাফল আপনি পাবেনই কারন এতে করে আপনার ডিপার্টমেন্টএ ভালো রেসাল্ট আসবে। কিন্ত যিনি বাংলা ডিপার্টমেন্ট এ পড়ে,সারাদিন বিসিএস প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে কিন্তু ডিপার্টমেন্টএ ভালো ফলাফলের জন্য পড়ছেনা। সুতরাং তার এই ফল, আসতে পারে,নাও আসতে পারে। ফলাফল না পেয়ে তার মনে হতাশার জন্ম দিতে পারে। কারন আমাদের মানুষের মন এমন প্রকৃতির যে,আমরা যেকোন কিছুর তাৎক্ষণিক ফলাফল চাই।
আলোচনার শেষে কিছু কথা বলে শেষ করতে চাই,
বাংলাদেশ এমন এক দেশ, যেখানে সাইন্সে পড়ে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারলে কোন মূল্য নেই। কারন সাইন্সের চাকরীর বাজার খুবই সীমিত।
অপরদিকে মানবিকে পড়ে আপনি কি হবেন?? আইনজীবী?? এটাই একমাত্র পেশা।
আর ব্যাবসায় শিক্ষায় প্রতিযোগী অনেক বেশি কিন্তু জব সেক্টর মোটামোটি অনেক বেশি আছে।
আর আপনি যদি কমার্সে পড়ে সিএ ডিগ্রি নিতে চান। তাহলে ব্যাবসায় শিক্ষা বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগ থেকে এই ডিগ্রি নেয়া সম্ভব না।
আপনি যদি পেশাগত বা প্রফেশনাল ডিগ্রির চিন্তা করে থাকেন তবে,ব্যাবসায় শিক্ষার বা কমার্সের বিকল্প নেই!!!
শুধুমাত্র চার বছর ভার্সিটির সিলযুক্ত টি-শার্ট পড়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য মানবিক পড়ে লাভ নেই।
তবে, আপনার স্বপ্ন যদি থাকে যে,আপনি শিক্ষক হবেন, সমাজকর্মী হবেন, বিসিএস দিবেন তাহলে মানবিকে পড়তে পারেন।