বিশাল চুনাপাথরের গুহা। ওপর থেকে স্ট্যালাকটাইটস ঝুলে আছে ওল্টানো শ্বেত তরবারির মতো। চারিদিকে নিকষ অন্ধকার। কোথাও থেকে আলোর লেশমাত্র রেখা নেই। চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু স্ট্যালাকটাইটের চুয়ে পড়া জলের শব্দ।
আর এরই মধ্যে দিয়ে সাবধানে পা ফেলে ফেলে, প্রতি ইঞ্চি জমি মাপতে মাপতে চলেছেন একদল বিজ্ঞানী। আর তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় গাইড।
চলার পথ সব জায়গায় তো সমানও না। কোথাও দুটো দেওয়ালের মধ্যে ফাঁক এতটাই সরু যে কোনওমতে যাওয়া যাচ্ছে তার ভিতর দিয়ে। ঠিক যেন হলিউডের কোনও অ্যাডভেঞ্চার ছবি, দুঃসাহসীর দল চলেছে রহস্যের মায়াজাল ভেদ করতে।
বাস্তবেও অবশ্য এই বিজ্ঞানীরাও এক রহস্য উন্মোচনেই বেরিয়েছেন এক অসমসাহসী মহিলা বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে। তিনি শি জেঙলি, চিনা শহর ইউহানের ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির আওতাধীন সেন্টার ফর এমার্জিং ইনফেক্সাস ডিজিজেস-এর অধিকর্তা। তো প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে দক্ষিণ চিনা রাজ্য গুয়ানজির রাজধানী নানিঙের কাছে দুর্গম গুহাতে কী করছেন এই ভাইরোলজিস্টরা?
২০০২-৩ সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রম বা সার্স-এর কবলে পড়েন প্রায় হাজার আষ্টেক মানুষ, মারাও যান শ’আটেক। এর পরেই নড়েচড়ে বসেন ভাইরোলজিস্টরা। আদতে এই ধরনের ফ্লুয়ের ভাইরাস যে প্রাণঘাতী হতে পারে, তা সার্স-এর আগে বিজ্ঞানীরা বুঝতেই পারেননি। তখনই শঙ্কা শুরু হয়, তা হলে কি অন্য জন্তু থেকে মানবদেহে সংক্রমণ হচ্ছে? দেখা গেল বেজি জাতীয় এক জানোয়ারের শরীর থেকে সত্যিই সংক্রমণ হচ্ছে।
তখনই শি-র মনে হয় তা হলে বাদুড় থেকে কোনও ভাবে সংক্রমণের সম্ভাবনা নেই তো? যা ভাবা সেই কাজ। বাদুড়ের সন্ধানে দু’জন সঙ্গী নিয়ে ২০০৪ সালে দুর্গম সব পাহাড়ের গুহায় যেতে শুরু করলেন। তবে বাদুড় ধরা মোটেই কোনও সহজ কাজ নয়। পাহাড়ের এমন সব দুর্গম জায়গায় গুহায় ওদের আস্তানা যে, সেখানে পৌঁছানোটাই রীতিমতো এক অ্যাডভেঞ্চার। তার পর তো ধরা। তা বহু চেষ্টার পর কিছু ধরাও সম্ভব হল। রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে তাদের ছেড়েও দেওয়া হল। তার পর সেই নমুনা পরীক্ষাগারে এনে পরীক্ষা করা। এটাই গত ১৬ বছর ধরে দিনের পর দিন একনাগাড়ে করে চলেছেন শি। আর এর থেকেই ২০০৫ সালে শি মোটামুটিভাবে প্রাথমিক সিদ্ধান্তে আসেন যে বাদুড় হল সার্স-এর করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল। কিন্তু আরও তথ্য চাই, না হলে জগত মানবে কেন?
সুযোগ আবার এল বছর তেরো বাদে। দক্ষিণ পশ্চিম চিনের ইউনানের পাহাড়ি এলাকার চা বাগানে জনা ছয়েক কর্মীর সার্স-এর লক্ষণযুক্ত নিউমোনিয়া হল, দু’জন মারাও গেল। কারণ খুঁজতে ডাক পড়ল শি-র। ২০১৭ সালে সহযোগী গবেষক কিউ জিকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ি গুহা, বিশেষত যেগুলো বাদুড়ের আস্তানা, সেগুলো তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু করেন শি।
কোনও গোয়েন্দা কাহিনির চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয় এই তদন্ত অভিযান। অবশেষে ইউনানে এক দুর্গম পাহাড়ের গুহায় হর্সসু ব্যাট নামে এক বিশেষ প্রজাতির বাদুড়ের খোঁজ পান তাঁরা। দেখেন গুহাতে যা লালারস, মলমূত্র ছড়িয়ে আছে, তাতে সার্স জাতীয় করোনাভাইরাস রয়েছে। ঠিক যে ভাইরাসের প্রকোপে চলতি শতাব্দীর গোড়ায় প্রায় ৮০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। শি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, কোনও ভাবে এই ভাইরাস বাদুড় থেকে বেজি জাতীয় প্রাণীর শরীরে ঢোকে। এর পর এই বেজি থেকে মানবদেহে প্রবেশ করে সার্স-এর মতো কালান্তক রোগ বাঁধিয়েছে। অর্থাৎ এই ভাইরাস এখনই নিয়ন্ত্রণের কোনও উপায় না বার করতে পারলে এটা ভবিষ্যতে আরও বড় কোনও সংক্রমণের কারণ হতে পারে। এরই সঙ্গে শি ঠিক করলেন তাঁর এই আবিষ্কারের কথা বিশ্বের দরবারে পেশও করবেন। আসন্ন এই মহাবিপদ বিশ্ববাসীর জানা দরকার। কিন্তু তা করতে তাঁর দরকার আরও তথ্য, যাতে তাঁর আবিষ্কারে কেউ কোনও খুঁত না বার করতে পারে।
তাই এ বার যে শুধু রক্তের নমুনা সংগ্রহ করলেই কাজ শেষ হবে না, তা বিলক্ষণ বুঝলেন শি। করতে হবে লালারসের নমুনা সংগ্রহও। আর সেটা একদিনের ব্যাপার নয়।
শুরু হল নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চলল এই বাদুড়দের উপর পর্যবেক্ষণ আর লালা সংগ্রহের কাজ। রাতে গুহার মুখে জাল লাগানো হল। পরদিন দেখা গেল কয়েকটা বাদুড় জালে আটকে রয়েছে।
২০১৭ সালে শি আর কিউ জি তাঁদের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার নিয়ে এক প্রবন্ধ লেখেন। তাতে পরিষ্কার বলা হয়, কোনও একক বাদুড়ের লালারস বা রক্তে সার্স-এর মতো ভাইরাস নেই। কিন্তু অন্য প্রাণীর লালারসের সঙ্গে মিশে তা কালান্তক হতে পারে। ঠিক যেমন বেজি জাতীয় প্রাণীর সঙ্গে হর্সসু বাদুড়ের লালারস মিশে হয়েছে। এর পর যখন তা মানবদেহে সংক্রামিত হয়েছে, তখন ভয়াবহ হয়েছে। সারা বিশ্ব চমকে ওঠে এই পর্যবক্ষণে।
এতেই শেষ নয়। করোনাভাইরাস থাবা বসানোর পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় ফের শি প্রবন্ধ লেখেন। এই নতুন করোনাতেও যে বাদুড়ের ভূমিকা রয়েছে, সেটা বলেন তিনি। বলেন সার্স ভাইরাসই ফের করোনারূপে আরও কালান্তক হয়ে দেখা দিয়েছে।
কিন্তু ততদিনে বিশ্বময় ছড়িয়েছে করোনার থাবা। ঘরে বাইরে তখন ইউহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজিকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে এই করোনার মূল উৎস হিসাবে। এমনকী চিনা সোশ্যাল মিডিয়াতেও ইনস্টিটিউট আর শি দু’জনেরই মুণ্ডপাত হচ্ছে। শি অবশ্য এ সব সমালোচনাকে গায়ে মাখেননি। এ ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে তাঁর জবাব, ‘ভগবানের দিব্যি এই ভাইরাসের সঙ্গে ল্যাবের কোনও সম্পর্ক নেই। আর আমার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে করার (সমালোচনা নিয়ে ভাবা বাদে)।’
২০২০-র মার্চে শিয়ের সাক্ষাৎকার নেয় সায়েন্টিফিক আমেরিকান। সেখানেই প্রথম তাঁকে ‘ব্যাটওম্যান’ বলা হয়। সেই সাক্ষাৎকারেই শি বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেন, ‘বাদুড় থেকে আসা করোনাভাইরাস আরও সংক্রমণ ছড়াবে। এই ভাইরাস আমাদের খুঁজে পাওয়ার আগেই আমাদের ওটাকে খুঁজে বার করতেই হবে।’
১৯৬৪ সালের ২৬ মে চিনের হানানে জন্মগ্রহণ করেন শি। পড়াশোনা করেন ভাইরোলজি নিয়ে চিনা আর ফরাসি বিশ্ববিদ্যালয়ে। করোনার প্রাদুর্ভাবের সময় তাঁকে নিয়ে ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এক বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী গঠন করেন।
এই পর্যন্ত ভালোই ছিল। কিন্তু সম্প্রতি জনসমক্ষে আর শিকে দেখা যাচ্ছে না। এমনিতেই বেজিংয়ের মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন আছে। তাই শি-র অন্তর্ধান নানান সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। শি আদৌ নিরাপদে তো? যদিও চিনা সোশ্যাল মিডিয়া উইচ্যাটে তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে সুস্থ আর নিরাপদে থাকার কথা বলা হয়েছে।
শি কিন্তু বলেছিলেন, ‘দ্য মিশন মাস্ট গো অন’।
তবে কি কোনও প্রত্যন্ত গুহায় বাদুড়দের নিয়ে গভীর গবেষণায় রত ‘ব্যাটওম্যান’?