বাংলাদেশে স্থলভাগ এবং সমুদ্রভাগ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট আবিষ্কৃত একশো দুই প্রজাতীর সাপের মধ্যে বেশিরভাগই নির্বিষ। স্থলভাগ এবং সামুদ্রিক প্রজাতী মিলিয়ে আবিষ্কৃত মোট উনত্রিশটি প্রজাতীর বিষধর সাপের উপস্থিতি বাংলাদেশে রয়েছে যারা মানুষ মারতে সক্ষম। তবে গোখরা প্রজাতীর সাপ রয়েছে দুইটা। একটি পদ্ম গোখরা, অপরটি হলো খইয়া গোখরা। আজকে আমরা পদ্ম গোখরা সাপ নিয়ে আলোচনা করবো।
চেনার উপায়:
আমরা জানি দুই প্রজাতির গোখরা সাপেরই চওড়া ফনা থাকে, এই ফনা দেখেই আপনারা কোনটি পদ্ম গোখরা এবং কোনটি খইয়া গোখরা সেটি চিনতে পারবেন। আমরা যে সাপের ছবি সংযুক্ত করেছি সেগুলো ভালো করে খেয়াল করে দেখুন প্রতিটি সাপেরই ফনার পেছনে যে দাগ আছে, যাকে গ্রামের মানুষ খড়মের দাগ বলে থাকে সেই দাগ কোনোটি গোলাকার, কোনোটি ডিম্বাকার, কোনোটি বা তাস খেলার রুইতনের মত দেখতে, এক একটি এক এক ডিজাইনের হলেও প্রত্যেকটির ক্ষেত্রেই খেয়াল করে দেখুন এই দাগ বা ডিজাইনটি একটি পরিপুর্ণ বৃত্ত বা আয়ত বা ডিম্ব, এই দাগের চারপাশের রেখার কোথাও কোনো ফাকা যায়গা নেই, যেমন ইংরেজি ভি বর্ণের দুই বাহু উপরের দিকে উঠে ফাকা হয়ে যায় আর একসাথে মিলিত হয় না। এই দাগের সবদিক যদি একসাথে মিলে থাকে তবে সেটা পদ্ম গোখরা বা মনোস্লেড কোবরা। পদ্ম গোখরার শরীরের রং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হতে পারে, পিঠের রং বাদামী, কালচে বাদামী, কালোও হতে পারে, পিঠের উপর মাঝে মাঝে আড়াআড়ী সাদা দাগ থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। ফনার সামনের দিকে সাদা কালো বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন থাকতে পারে, গলার নিচে এক বা একধিক কালো ব্যান্ড থাকতে পারে কোনোটির চিকন আবার কোনোটির চওড়া কালো ব্যান্ড হতে পারে। ফনার পেছোনের খমড়ের চিহ্নটা যদি পরিপুর্ণ হয়, যদি কোনোদিক অন্য দিকের থেকে আলাদা না হয় তবে বুঝবেন এটি পদ্ম গোখরা বা মনোস্লেড কোবরা, গায়ের রং যাই হোক। জিনগত বৈচিত্রের কারনে কখনো কখনো এদের গায়ের রং পুরোপুরি দুধের মত সাদাও হতে পারে। পদ্ম গোখরা আট ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
বাসস্থান ও খাদ্য:
প্রায় সারাদেশেই পদ্ম গোখরা আছে, ফসলের মাঠ, বিল-বাওড়, বাড়ির পাশের ঝোপ-জঙ্গল, পুকুর বা যেকোনো জলাশয়ের আশেপাশে বসবাস করতে পছন্দ করে। ইঁদুর, ব্যং, পাখি, লিজার্ড এসবই পদ্ম গোখরার খাদ্য।
বর্ষা কালে এদের স্বাভাবিক আবাসস্থলে পানি ঢুকলে এবং ডিম পাড়ার জন্য উচু যায়গা না পেলে এরা মানুষের বাড়িতে ঢুকতে পারে।
সাবধানতা:
বাড়ির চারপাশের ঝোপ-জঙ্গল পরিস্কার রাখুন। বর্ষাকালে আপনার বাড়ির চারপাশে মাসে একবার ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিতে পারেন, এতে আপনি আশি শতাংশ নিরাপদ থাকবেন। অনেকে কার্বলিক এসিড ব্যাবহার করে থাকে তবে গবেষনায় দেখা গেছে কার্বলিক এসিডে সাপ যায় না। আর ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করবেন। রাতে চলার সময় লাইট ব্যবহার করবেন।
বিষের ধরণ :
নিউরোটক্সিক ভেনম, যা মানুষের শরীরের নার্ভার্স সিস্টেম কে আক্রমন করে, অকেজো করে দেয় ।
লক্ষন :
পদ্ম গোখরা কাউকে কামড় দিলে কামড়ানোর ঘন্টা দুয়েক পর থেকে রোগীর ঘুম ঘুম ভাব হবে, চোখ বুজে আসতে শুরু করবে, আক্রান্ত স্থান ও তার আশপাশ ফুলে উঠবে, বমি বমি ভাব হবে, জ্বর আসতে পারে, শেষমেষ রোগী কাউকে চিনতে পারবে না, এমনকি আপন মা-বাবাকেও নয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি :
সাপ সাধারনত ভয় না পেলে মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীকে কামড় দেয়না, ভয় পেলে আত্মরক্ষার্থে কামড় দেয়। দৃষ্টি শক্তি কম হওয়ায় সাপের শরীরে থাকা এক ধরনের সেন্সরের মাধমে মাটির কম্পন থেকে সাপেরা শনাক্ত করে তার সামনের বস্তুটি মানুষ বা হাতি বা অন্য প্রাণী, প্রাণীটির আকার অনুমান করে সেই অনুপাতে সাপেরা বিষ প্রয়োগ করে থাকে। ভালো খবর হলো পদ্ম গোখরা সমস্ত সাপেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শতকরা প্রায় ৯০% ক্ষেত্রে ড্রাই বাইট করে বা কামড় দেয় কিন্তু বিষ প্রয়োগ করেনা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এরা মানুষকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতে কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয় বিষ প্রয়োগ না করে। পদ্ম গোখরা তার নিজের স্বার্থেই বেশিরভাগ সময় বিষ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকে। বিষ সাপের নিজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিষের সাহাজ্যে সাপ তার শিকারের(খাবারের) শরীরে থাকা হাড়-হাড্ডি হজম করে। অতএব পদ্ম গোখরার কামড়ে শতকরা নব্বইজন রোগীরই সম্পূর্ণ বিনা চিকিৎসায় বেঁচে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে যদি না রোগী ভয় পেয়ে হার্ট ফেল করে মারা না যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী ভাবে যে তাকে সাপে কেটেছে মানে সে মারা যাবে, এই ভয়ের কারনেই তার হার্ট এ্যাটাক হয় এবং রোগী মারা যায়।
যদি কাউকে সাপে কাটে তবে তার আশপাশের মানুষের প্রথম কাজ হলো রোগীকে অভয় দেওয়া বা শান্ত রাখা। তারপর ক্ষতস্থানের উপরে গামছা বা তিন/চার ইঞ্চি চওড়া কাপড় বা ক্রেব ব্যান্ডেজ দিয়ে কম টাইট করে বেধে দেওয়া, বাধতে হবে এমন ভাবে যাতে বাধনের ভেতর দিয়ে আপনার একটি আঙুল ঢোকানো যেতে পারে, বিষের প্রভাবে রোগীর শরীর আরও ফুলে উঠে বাধন আরও টাইট হতে থাকবে। মনে রাখতে হবে বাধন কখনো বিষকে সম্পুর্ণ আটকাতে পারবে না। বাধার উদ্দেশ্য হলো রক্তের প্রবাহ কিছুটা কমিয়ে দিয়ে সঠিক চিকিৎসার জন্য কিছুটা বাড়তি সময় পাওয়া। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে কোনো রশি বা চিকন কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাধা যাবে না। এতে রোগীর হাত বা পায়ের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর রোগীর হাত বা পায়ের রক্ত জমাট বেধে সেল টিসু মরে গিয়ে সম্পুর্ণ অকেজো হয়ে যাবে এবং রোগীর হাত বা পা কেটে ফেলতে হবে এমনকি শুধু মাত্র বাধনের কারনেই রোগীর মৃত্যু হতে পারে। রোগীকে বেশি হাটাচলা করতে দেওয়া যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় রোগীকে শোয়া অবস্থায় রাখলে। তাকে স্থানান্তর করতে হলে চ্যাংদোলা করে নিতে হবে।
সব সময় খেয়াল রাখতে হবে এক মুহূর্ত সময়ও যেনো নষ্ট না হয়, কারন গোখরা সাপের বিষক্রিয়ার লক্ষন প্রকাশ পেতে মাত্র দুই ঘন্টা সময় লাগে। এই দুই ঘন্টার ভেতর অবশ্যই আপনার নিকটবর্তী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌছাতে হবে, কারন শুধুমাত্র সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গুলোতেই সাপে কাটা রোগীর সঠিক চিকিৎসার ব্যাবস্থা রয়েছে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং পর্যাপ্ত এন্টি ভেনম শুধুমাত্র সরকারী মেডিকেল কলেজ গুলোতেই এখন পর্যন্ত পৌছেছে। জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে এন্টি ভেনম থাকলেও ট্রেনিংপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষার ব্যাবস্থা এখনো পর্যাপ্ত নয় সব ক্ষেত্রে। উপজেলা হাসপাতালে এখনো কোনো ব্যাবস্থা নেই। তবে আশা করা হচ্ছে আগামী এক/দুই বছরের মধ্যে দেশের সকল উপজেলা পর্যায়ে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা পৌছে যাবে।
সাপে কাটলে রোগীকে দ্রুত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান, কোনো ওঝা/বদ্যর কাছে নয়, তাতে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই হবে না। মনে রাখবেন প্রতিটি সেকেন্ডই মহা মুল্যবান একজন সাপে কাটা রোগীর জন্য।
আপনি আমি সচেতন হলে সাপের কামড়ে আর মানুষের মৃত্যু হবে না।
সাপ আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাণী। সাপ দেখলেই মেরে না ফেলে তাড়িয়ে দিন অথবা কোনো রেসকিউয়ার কে খবর দিন।