অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, মাকড়সারও ‘মাইন্ড’ আছে। মাইন্ড মানে এখানে, একটা বোধ। যার থেকে মাকড়সা তার বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই ক্ষমতা পতঙ্গ শ্রেণির মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না
আমাদের মধ্যে কি এক অদ্ভুত বুদ্ধিমান জীব বাস করে? যার বুদ্ধি মনে হতে পারে যেন ভিনদেশী। আমরা তাদের দেখতে পেলে সাত-পাঁচ না ভেবে আগে মেরে ফেলি। কিন্তু দেখা গিয়েছে প্রাণীটির বোধ একটু অন্য ধরনের।
যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে, তারা সাধারণত ঘরের কোণে বা ঝোপঝাড়ে থাকে। জটিল থেকে জটিলতর জাল তৈরি করে শিকার ধরতে। মাকড়সা। অনেক সময়েই যারা আমাদের ভয় অথবা ঘৃণার কারণ। পতঙ্গ শ্রেণীর এই প্রাণী সম্পর্কে খুব একটা উচ্চ ধারণা সাধারণত আমরা পোষণ করি না। কিন্তু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বর্তমান পৃথিবীর ৪৮ হাজারেরও বেশি প্রজাতির মাকড়সা প্রতিদিন এমন কাজ করে, যা তাদের বুদ্ধিমত্তারই পরিচয়।
মাকড়সা মানেই আমরা বুঝি আটটা পা, একটা সিল্ক তৈরির গ্রন্থি যাকে স্পিনারেট বলা হয়। এই গ্রন্থি থেকে সিল্ক তৈরির পর তারা পিছনের দুটি পা দিয়ে চিরুনি চালানোর মতো করে সিল্কটি সোজা করে। তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী জাল বোনা ছাড়াও নানা কাজে লাগায়। যেমন, কখনও কোকুন তৈরি করতে, কখনও উইন্ডসার্ফিং করতে অথবা স্রেফ দড়ির সাহায্যে ঝুলে থাকা বা দড়ি ধরে ওঠার মতো করে। কোনও প্রজাতির মাকড়সা অদ্ভুত একটি কীর্তি ঘটাতে পারে। হাওয়ায় নিজেকে ছুড়ে দিয়ে ওই সিল্কের সাহায্যে ভেসে কিছুটা দূর পর্যন্ত যেতে পারে। যাকে বলে বেলুনিং।
ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক ফোর্সের মাধ্যমে নিজেকে বাতাসে ভাসিয়ে দেয় মাকড়সাটি। ঠিক কোন সময়ে, কোন দিকে ভাসাতে হবে সেই সিদ্ধান্তটি মাকড়সা নিতে পারে এক রকম বোধ প্রয়োগ করেই। পায়ের সূক্ষ্ম রোমগুলি তাকে সাহায্য করে হাওয়ার গতি, দিক বুঝতে। ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী এরিকা মর্লির কথায়, ‘ওরা বাতাসের পরিবর্তন বুঝতে পারে।’
মাকড়সার স্মার্টনেস-এর সবচেয়ে বড় পরিচয় পাওয়া যায় জাল তৈরির ক্ষেত্রে। বেশিরভাগ মাকড়সাই গোলাকার জাল তৈরি করে যাকে বলা হয় ‘অর্ব ওয়েব’। এই জাল তৈরির সময় কিছু তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় মাকড়সাকে। যেমন যদি মনে করা হয় গোলাকার জাল তৈরি করবে তা হলে আগে দুটো প্রান্তের মধ্যে লম্বা অংশটা তৈরি করে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির টমাস হেসেলবার্গের মতে, ‘এই লম্বা সুতোটা আগে তৈরি করে নিলে ওরা বুঝতে পারে, কতটা বড় জাল হতে চলেছে।’ এর পর থাকে আরও অনেক ক্যালকুলেশন।
হেসেলবার্গ বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানতে পেরেছেন আরও কিছু বিষয়। সিল্ক গ্রন্থিতে আর কতটা সিল্ক পড়ে আছে, সেই অনুযায়ী জাল বুনতে বুনতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে জালটি ছোট করার। জালের ফাঁক ছোট বা বড় রাখে কী ধরনের শিকার ধরবে সেই অনুযায়ী। এমনকি পরিবেশের তাপমাত্রার উপরেও নির্ভর করে জালের ধরন। ঠান্ডার সময় বড় বড় ফাঁক রেখে জাল তৈরি করে। যাতে ঠান্ডায় বেশিক্ষণ বাইরে কাটাতে না হয়। অল্প সময়েই কোথাও ঢুকে লুকিয়ে পড়তে পারে। হেসেলবার্গ মনে করেন, মাকড়সার এই সব কাজের মধ্যে দিয়ে তাদের প্ল্যানিং ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।
মাকড়সা দুনিয়ায় আরও এক ধুরন্ধর প্রজাতি হল পোর্শিয়া। যারা অন্য প্রজাতির ছোট মাকড়সা খায়। বিজ্ঞানী রবার্ট জ্যাকসন মনে করেন, এই জাতের মাকড়সা তার আশপাশের ‘ম্যাপ’ মাথায় রাখতে পারে। একটা জলের ট্যাঙ্কের ভিতর বেশ কয়েকটা টাওয়ার তৈরি করেন তিনি। তার একটার মাথায় পোর্শিয়া মাকড়সা রাখেন। অন্য এক টাওয়ারের মাথায় থাকে তার খাদ্য অন্য মাকড়সা। এক টাওয়ার থেকে অন্য টাওয়ারে যেতে গেলে পোর্শিয়াটিকে নেমে এসে ফের অন্য টাওয়ারে উঠতে হবে। জ্যাকসন দেখেছেন, পোর্শিয়া সঠিক টাওয়ারেই ওঠে, নীচ থেকে তার খাদ্য দেখতে না পেলেও। অর্থাৎ সে মাথায় রাখতে পারে, কোথায় তার খাবার আছে।
এই ভাবে কখনও খাবার কমিয়ে, বাড়িয়ে চেষ্টা করেছেন সে ক্ষেত্রেও মাকড়সাটি বেছে নেয় বেশি খাবারের টাওয়ার। আবার পোর্শিয়া নীচে থাকাকালীন তার খাবার পালটে দিয়ে দেখেছেন, টাওয়ারে ওঠার সময় একটু থমকে দাঁড়ায়। সাময়িক ‘কনফিউশন’ তৈরি হয়। এর থেকেই অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, মাকড়সারও ‘মাইন্ড’ আছে।
মাইন্ড মানে এখানে, একটা বোধ। যার থেকে মাকড়সা তার বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই ক্ষমতা পতঙ্গ শ্রেণির মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। মৌমাছির কিছু ক্ষমতা আছে। তাকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে মাকড়সা।
পতঙ্গদের মস্তিষ্কে সেন্ট্রাল কমপ্লেক্স নামে একটা গঠন থাকে। অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকুয়্যার ইউনিভার্সিটির অ্যান্ডরু ব্যারন মনে করেন, মাকড়সার মস্তিষ্কে আর্কুয়েট বডি একই কাজ করে। অনেকে মনে করেন, বহির্বিশ্বের ধারণা মাকড়সা তৈরি করে এর মাধ্যমেই। যদিও এখনও সে বিষয়ে বিস্তর গবেষণার সুযোগ রয়েছে।