Image default
জানা অজানা

সিকাডা ৩৩০১ : ইন্টারনেট জগতের অমীমাংসিত রহস্য

২০১২ সালের ৪ই জানুয়ারি ফোরচ্যান নামের ওয়েবসাইটের বুলেটিন বোর্ডে ছবি সহ একটি মেসেজ পোস্ট করা হয়। ওয়েবসাইটের নীতিমালা অনুযায়ী ছবি প্রকাশকারীর নাম-পরিচয় গোপন রাখা হয়। অজ্ঞাত পোস্টকারি সেই ছবিতে ব্যবহারকারীদেরকে চিত্রের মাঝেই লুকানো একটি বার্তা উন্মোচন করার জন্য চ্যালেঞ্জ জানান। সে মেসেজটিতে লেখা ছিল –

“হ্যালো, আমরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের খুঁজছি। তাদের খোঁজার জন্য আমরা একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছি। এই ছবিতে একটি মেসেজ লুকানো আছে। এটাকে খুজে বের করো। এটাই তোমাদেরকে আমাদের কাছে নিয়ে আসবে। আমরা সেসব স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তিকে দেখার অপেক্ষায় আছি যারা এটি সম্পূর্ণ করতে পারবে। গুড লাক।”

আর নিচে ছিলো একটি কোড। 3310. পুরো ইন্টার্নেট দুনিয়া তোলপার হয়ে গেলো যেনো হঠাৎ করেই। পৃথিবীর সেরা হ্যাকার এবং কোড সমাধানকারীরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা প্রমাণের জন্য এই পরীক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। আর এই রহস্যময় ধাঁধার নামি দেয়া হয় ‘সিকাডা 3301.

ছবিতে লুকানো সিকাডা ৩৩০১

সিকাডা ৩৩০১ এর শুরু

“ঘটনাক্রমে আমি ২০১২ সালে প্রকাশিত সেই সিকাডা ৩৩০১ এর ধাঁধার সন্ধান পাই। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমি সবার থেকে পিছিয়ে ছিলাম। কারণ, আমি ছবি প্রকাশিত হওয়ার অনেক পরে এটি দেখতে পাই। প্রথমদিকে আমি ব্যাপারটা বেশ সহজভাবে নিয়েছিলাম। যেন কোনো সহজ ধাঁধা সমাধান করছি। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা এত সহজ হবে না। কিন্তু আমি কখনো হাল ছেড়ে দেইনি। সবসময় এমন কিছু চাইতাম যা আমার ঘাম ছুটিয়ে দেবে। তাই সিকাডা আমার জন্য খুব আকর্ষণীয় ছিল।” বলছিলেন সিকাডা ৩৩০১ এর সমাধানে অগ্রদূত জুয়েল এরিকসন। পেশায় একজন ক্রিপ্টোগ্রাফি গবেষক এরিকসন আজ পর্যন্ত সিকাডা ধাঁধা সমাধানকারীদের মাঝে অন্যতম হিসেবে গণ্য হন। এই ধাঁধা সমাধান অভিযানে তাকে স্টেগানোগ্রাফি, ক্রিপ্টোগ্রাফি, সাহিত্যতত্ত্বসহ আরো বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে পদচারণা করতে হয়েছিলো। একেকটি ধাঁধার সমাধান যেন আরেকটি রহস্যের শুরু। এরিকসন সিকাডার সর্বপ্রথম প্রকাশিত ছবি থেকে স্টেগানোগ্রাফি সফটওয়্যারের সাহায্যে একটি ক্ষুদে বার্তার সন্ধান লাভ করেন। শিফট সাইফারের সাহায্যে নিবন্ধিত সেই কোড সমাধানের পর তিনি একটি ওয়েবসাইটের লিংকের সন্ধান পান। বেশ উত্তেজনার সাথে তিনি সেই ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেখানে একটি পাতিহাঁসের ছবি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।

সিকাডা ৩৩০১

কি আছে এই ধাধায়

কি আছে এই ধাধায় এটা বলার চেয়ে বলা সহজ কি নেই এই ধাধায় – কবিতা, শিল্পকর্ম, সঙ্গীত, অনুমাননিভর্র কথাসাহিত্য, অষ্ঠাদশ শতকের অজ্ঞাত এবং রহস্যময় সাহিত্য, মায়ান ক্যালেণ্ডার, দর্শন, গণিত, ক্রিপ্টোগ্রাফি, সংখ্যাতত্ব, প্রযুক্তিবিদ্যা, তথ্য নিরাপত্তা, স্টেগেনোগ্রাফি এবং প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। এই ধাধার সূত্রপাত ইন্টারনেটে হলেও এর কার্যক্রম পরিচালিত হয় টেলিফোনে, সঙ্গীতে, অপ্রকাশিত এবং দুস্প্রাপ্য বইতে, ডিজিটাল ছবি এমনকি বিভিন্ন জায়গায় ছাপানো কাগজের মাধ্যমেও কিন্তু এর সবটাই লুকানো হয়েছে এনক্রিপশন এবং এনকোডিং করে। এই ধাধাটি শুধুমাত্র কম্পিউটারে বসে সমাধান করা যাবে না, এর জন্য প্রতিযোগীকে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতে হবে। ধাধার সূত্রগুলো কিউআর কোড হিসেবে লাগানো থাকে টেলিফোন/ইলেকট্রিক পোল অথবা ডাকবাক্সে। এর জায়গা ইউএস, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া, জাপান, পোলাণ্ড, মেক্সিকো এবং দক্ষিণ কোরিয়া-তে ছড়িয়ে আছে।প্রতিটি ধাধা এবং সূত্র একটি নির্দিষ্ঠ সময়ে এবং পর্যায়ক্রমে শেষ করতে হয়, এতে কোন ধরণের ভুল গ্রহনযোগ্য নয় বা কোন ভাবেই আবার পুনরায় শুরু করা যাবে না।

ছবিতে লুকানো ধাধা

কেন সিকাডা ৩৩০১ রহস্যময়

জোয়েল এরিকসন একজন সিকিউরিটি রিসার্চার যিনি দাবী করেছেন যে তিনি এই ধাধাগুলোর অনেকটাই সমাধান করেছেন। “ফাস্ট কোম্পানী” ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি জানান, প্রথমে তিনি এটাকে একটা মজা মনে করে শুরু করেন কিন্তু তারপরেই তিনি বুঝতে পারেন এর গভীরতা এবং এটি কতটা জটিল এবং কঠিন। সিকিউরিটি রিসির্চার হিসেবে তার আগে থেকেই ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং স্টেগোনোগ্রাফি সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিলো। রহস্যের জট খুলতে গিয়ে তাকে সমাধান করতে হয়েছিলো ইন্টারনেটে বিভিন্ন ধরণের ছবি বা টেক্সটে থাকা লুকানো তথ্যকে, তাই নয় এই ধাধা তাকে বাস্তব পৃথিবীতে নিয়ে আসে। এই প্রক্রিয়ায় তাকে ১৪টি বিভিন্ন জায়গায় থাকা ধাধা সলভ করতে হয় যেগুলো একটি সিকাডা এবং কিউআর কোড হিসেবে থাকতো।

ইলেকট্রিক পোলে লাগানো সিকাডা ৩৩০১ এর ধাধা

তবে ভৌগোলিক বাধার কারণে তার পক্ষে সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয় নি, সে ক্ষেত্রে বন্ধুদের সাহায্য গ্রহণ করে। এই সব ধাধাগুলো সমাধান করে সে আবার ইন্টারনেটে ফিরে আসে তবে এইবার ইন্টারনেটের সবচেয়ে গভীর জগতে যা “ডিপ/ডার্ক ওয়েব” নামে পরিচিত(বি:দ্র: ডিপ/ডার্ক ওয়েব কি তা নিয়ে ব্লগে লেখা আছে তাই এই ব্যাপারে বিশদ লেখলাম না)। এই পর্যায়ে তাকে একটা আ্যানোনিমাস টর নেটওয়ার্কের ঠিকানা দেওয়া যেখানে গিয়ে সে দেখতে পায় একটা হতাশাজনক মেসেজ যাতে বলা হয় এই অর্গানাইজেশন এমন কাউকে গ্রহণ করবে না যে শুধুমাত্র নিজেরা ধাধাগুলো সমাধান না করে অন্যদের সাহায্য নিয়েছে। সিকাডা ৩৩০১ এর ব্যাপারে জোয়েল-এর শ্রদ্ধামিশ্রিত মতামত হল তারা বেশ সুসংগঠিত এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন একটি গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠান। তাদের বিভিন্ন ধরণের ধাধাগুলো দেখে তার ধারণা তারা কোন সরকারী বা ইন্টেলিজেন্স প্রতিষ্ঠান নয়, বরং তারা কোন ক্রিপ্টোএনার্কি মুভমেন্ট বা হ্যাকার গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ঠ।

জোয়েল এরিকসন

এতদূর চলে আসা এরিকসনের কিন্তু সেই চাবি বের করতে তেমন সময় লাগেনি। সেই সহায়ক চাবি ব্যবহার করে তিনি গুপ্ত বার্তার সন্ধান পেলেন। Reddit-এর পেজ থেকে তিনি পেলেন আরো দুটো ছবি এবং বরাবরের মতো এই দুটো ছবির মাঝে লুকিয়ে ছিলো পরবর্তী ধাঁধার সমাধান। এরিকসন তার স্টেগানোগ্রাফির সাহায্যে দুটো ছবির মাঝে লুকনো বার্তার সন্ধান পেলেন। কিন্তু এবার তিনি ফের বিপাকে পড়লেন। কারণ, এই বার্তার মাঝে বেশ কিছু ধাঁধা লুকিয়ে আছে, যার উত্তরে বেরিয়ে আসবে কিছু সংখ্যা। সিকাডার নির্দেশনা অনুযায়ী, এই সংখ্যাগুলো টেক্সাস শহরের একটি ফোন নাম্বারের অংশ। টেক্সাসের ফোন সহায়িকা ঘেঁটে এরিকসন বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য নাম্বারের তালিকা তৈরি করলেন। সেগুলোতে বার বার ফোন দিয়ে তিনি কাঙ্ক্ষিত ফোন নাম্বার বের করলেন। সিকাডার সেই নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়ার পর যান্ত্রিক স্বরে একটি রেকর্ডকৃত ভয়েস মেইল ভেসে আসলো,

“সাবাস! তুমি অনেকদূর পর্যন্ত চলে এসেছো। খুব ভালো বুদ্ধি আছে তোমার। এবার আমাদের প্রথম ছবিতে ফিরে যাও। সেখানে আরো তিনটি সংখ্যা লুকিয়ে আছে। প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে ৩৩০১

ধাঁধার সমাধানে পৃথিবীর পথে

জুয়েল এরিকসনের ভ্রূ কুঁচকে গেলো। কী মুশকিল! এই ধাঁধার কি কোনো শেষ আছে? কিন্তু তিনি হাল ছাড়বেন না। স্টেগানোগ্রাফি ব্যবহার করেও তিনি নতুন কিছু বের করতে পারলেন না। এবার তিনি সফটওয়্যার ব্যবহার ছেড়ে নিজ চোখে ছবিখানা পরখ করতে থাকলেন। বেশ কিছুদিন পরখ করার পর তিনি পরবর্তী দুটো সংখ্যা বের করার খুব সহজ একটি উপায় বের করলেন। কিন্তু তা কাজে দিবে কিনা তা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। তবুও চেষ্টা করতে তো দোষ নেই! তিনি পাতিহাঁসের ছবির দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ বের করলেন। এরপর ৩৩০১ এর সাথে গুণ দিয়ে গুণফল বের করে সিকাডার নির্দেশনা অনুযায়ী চেষ্টা করলেন। তার ভাগ্য সহায় হলো। তার সামনে উন্মোচিত হলো আরেকটি ওয়েবসাইট। সেখানে সিকাডার বহুল পরিচিত ছবির নিচে একটি ঘড়িতে সময় গণনা হচ্ছিলো। এরিকসন ঘড়ির ডিজিট শূন্যতে নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর হঠাৎ করে পুরো ওয়েবসাইটের চেহারা বদলে গেলো। সিকাডার মথ বদলে গিয়ে সেখানে হাজির হলো কয়েকগুচ্ছ সংখ্যাধাঁধা। কিন্তু এরিকসন এবার ঘাবড়ালেন না। সংখ্যাগুলো দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন, এগুলো জিপিএস যন্ত্রের সাহায্যে বের করা ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক। তিনি মানচিত্র বের করে যখন জিপিএস স্থানাঙ্ক মিলিয়ে দেখলেন, তখন কিন্তু ঠিকই ঘাবড়ে গেলেন।

স্পেন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং পোল্যাণ্ডের বিভিন্ন স্থান নির্দেশ করা আছে সেই স্থানাঙ্কগুলোতে। কিন্তু এরিকসনের পক্ষে এতগুলো দেশ ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। তাই তিনি সিকাডা সমাধানকারীদের নিজস্ব ব্লগে চোখ রাখলেন। ততদিনে মানুষ যেন বাস্তবতায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে। আসলে ‘কারা এই সিকাডা ৩৩০১’, ‘কী তাদের উদ্দেশ্য’ এরূপ হাজারো প্রশ্নে মুখরিত ছিল সেই ব্লগ। তখন অনেক বিশ্লেষক নতুন তত্ত্ব প্রদান করলেন, সিকাডা ৩৩০১ হয়তো কোনো গোপন সংঘের ভর্তি ফরম। কিন্তু এরিকসন জানতেন, হাজারো অপপ্রচারেও তিনি থামবেন না। শেষপর্যন্ত তিনি চেষ্টা করে যাবেন। স্থানীয় সিকাডা সমাধানকারীরা সেই স্থানগুলোতে একটি টেলিফোন বুথের স্তম্ভে সিকাডা চিহ্ন সম্বলিত একটি পোস্টার আবিষ্কার করলো। সিকাডার চিহ্নের নিচে একটি কিউ আর কোড যুক্ত করা ছিল।

সিকাডার হতাশা

“পুরো ব্যাপারটি খুবই হতাশাজনক ছিল। বিশেষ করে যখন মানুষজন সমাধান বের করে অন্যজনকে জানিয়ে দিচ্ছিলো। সবাই যেন সিকাডার সাথে মজা নিচ্ছিলো। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা অনেকেই নিজের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই খুব বিরক্ত হয়েছিলাম মানুষের বোকামিতে”- জুয়েল এরিকসন।

নিজের হতাশার কথা জানান দিলেন এরিকসন। তিনি একা নন, ততদিনে অনেক সমাধানকারী মানুষের বোকামিতে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিলো। তবে এসব আবেগে সময় নষ্ট করতে রাজি ছিলেন না তিনি। তাই পুনরায় শুরু করলেন ধাঁধা সমাধান। কিউ আর কোডগুলোর মাধ্যমে এরিকসন আরো দুটো ছবির ধাঁধার সন্ধান লাভ করলেন। শুরুর দিকে তিনি বিরক্ত হলেও, এবার তিনি খুশি হলেন। কারণ, ততদিনে তিনি সিকাডার নেশায় ডুবে গেছেন। স্টেগানোগ্রাফির মাধ্যমে দুটো ছবি থেকে বেরিয়ে আসলো দুটো গুপ্ত বার্তা। এর মধ্যে একটি ছিল উইলিয়াম গিবসন রচিত ‘আগ্রিপ্পা’ কবিতার একটি পঙক্তি। এরিকসন অবাক হলেন কারণ এই বার্তার মাধ্যমে তিনি কোনো সংখ্যা পেলেন না। এখন কী উপায়?

তিনি দুশ্চিন্তায় নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন। তাহলে কি এখানেই থেমে যাবে তার যাত্রা? অনিশ্চয়তার মাঝে একপর্যায়ে তিনি স্রেফ পরীক্ষা করার জন্য পূর্ব বইয়ের সহায়ক চাবি ব্যবহার করলেন এই পঙক্তির উপর। হঠাৎ করে তিনি যেন হারানো আশা ফিরে গেলেন। সেই চাবির মাধ্যমে বেরিয়ে আসলো এক নতুন লিংক। কিন্তু সেই লিংকে প্রবেশ করতে প্রয়োজন টর ব্রাউজার। তিনি বেশ উৎসাহ নিয়ে টর ব্রাউজার দিয়ে সেই লিংকে প্রবেশ করতেই বুঝে গেলেন ‘গেম ওভার’! তিনি হেরে গেছেন। হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকা এরিকসনের সামনের মনিটরে ভেসে উঠলো, “আমরা সেরা বুদ্ধিমানকে চেয়েছিলাম। তার অনুসারীকে নয়।”

সিকাডার হতাশা

সিকাডা ৩৩০১ এর প্রথমদিকে মাত্র কয়েকজনকে সেই লিংকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। তাই সময়ের দৌড়ে হেরে গেলেন জুয়েল এরিকসন। দীর্ঘ ২১ দিন যাবৎ তার সিকাডা যাত্রার তাই এখানেই যবনিকাপাত হলো।

পর্দার ওপারে

এরিকসন না পারলেও অনেকেই সেই টর ব্রাউজার লিংকে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। এই প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের সেই একজন হলেন Tekknolagi (তেকনোলাজি) নামক এক ছাত্র। এই নাম ব্যবহার করে তিনি সিকাডা ৩৩০১ এর রহস্যজট খুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু হচ্ছে তেকনোলাজির সাথে। টর ব্রাউজারে সেই লিংকে প্রবেশ করার পর নতুন ছবিধাঁধার সন্ধান পাওয়া যায়। সেই ছবিতে সিকাডা ৩৩০১ একটি বইয়ের কথা ইঙ্গিত করছিলো। সেটি হচ্ছে উইলিয়াম ব্লাক রচিত ‘দ্য ম্যারেজ অফ হেভেন এন্ড হেল’। সেখান থেকে সহায়ক চাবি বের করে তিনি আরেকটি টর ব্রাউজার লিংকের সন্ধান পান। এরপর আরো কয়েক ধাপে আরো কয়েকটি ধাঁধা সমাধানের পর তার নিকট একটি MIDI ফাইল প্রেরণ করা হয়। এতদূর চলে আসা তেকনোলাজির নিকট এই ফাইলের সংকেত ভেঙে লুকানো বার্তা বের করা কোনো কষ্টের কাজ ছিল না। এই ফাইল থেকে তিনি ASCII কোডে রূপান্তরিত আরেকটি বার্তা পেলেন। তাকে সিকাডা থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো এই কোডটি একটি নির্দিষ্ট জিমেইল ঠিকানায় প্রেরণ করতে হবে। তিনি তাই করার পর তাকে সুসংবাদ প্রেরণ করা হলো- “আর কোনো ধাঁধা নেই। তুমি বিজয়ী হয়েছো।”

এর সাথে তাকে একটি গোপন পাসওয়ার্ড সম্বলিত একটি অদ্ভুত মেইল আইডি প্রদান করা হয়। সেটির সাহায্যে তেকনোলাজি এবং অন্যান্য বিজয়ীরা ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে সর্বপ্রথম সিকাডা সংঘের সাথে বৈঠক করতে সক্ষম হন। কিন্তু যেহেতু পুরো বৈঠকটি ডার্ক ওয়েবের সুরক্ষিত সার্ভারে সম্পন্ন হয়েছিলো, তাই কারো চেহারা দেখার সুযোগ মেলেনি তার। কিন্তু কী হয়েছিলো সেখানে? এর উত্তরে তেকনোলাজি জানান,

“সেখানে বেশ কিছু লোক ছিল। আমি জানি না তারা কারা কিংবা কী চায়। সবকিছুই কেমন অদ্ভুত লাগছিলো। তারা যা বলছিলো, তা আমরা নিজেরাও ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম না।”

শুধু তেকনোলাজি একা নন, এই প্রতিযোগিতার প্রথম বিজয়ী মার্কাস ওয়েনারও একই মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। তারা কী চায় কিংবা কেন চায়, তা জানা যায়নি। পরবর্তীতে এক ইমেইলের মাধ্যমে তারা বিজয়ীদের সাথে যোগাযোগ করে। সেই ইমেইলের সারমর্ম ছিল,

“আমরা একটি আন্তর্জাতিক সংঘ যাদের কোনো নাম, চিহ্ন কিংবা পরিচয় নেই। আমাদের সদস্যদের কোনো তালিকাও আমরা তৈরি করিনি। আমাদের কোনো বিজ্ঞাপন নেই। তোমরা হয়তো ভাবছো আমরা কী করতে চাচ্ছি…শুধু এতটুকুই বলবো, আমরা তোমাদের মতো মেধাবী এবং চিন্তাবিদ। আমরা ইন্টারনেট মুক্তিতে বিশ্বাস করি। আমরা কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছি এবং তোমরা সম্মতি প্রদান করলে আমাদের পরবর্তী প্রকল্পের অংশীদার হতে পারবে।”

ইমেইল পেয়ে অনেকেই সরে দাঁড়ালেন। মনে হচ্ছিলো কোনো সফটওয়্যার বানানোর জন্য কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। তাই অনেকেই হতাশ হয়ে পড়লেন। তবে যারা সম্মতি প্রদান করেছিলেন, তাদের কী হয়েছিলো? অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, তাদের সাথেও সিকাডা ৩৩০১ এর কেউ পুনরায় যোগাযোগ করেনি। নিমিষেই যেন হাওয়া হয়ে গেলো তারা!

এক বছর এক দিন পর

এই ঘটনার ঠিক এক বছর এক দিন পরেই পুনরায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরো কয়েক ডজন জটিল রহস্যজট নিয়ে হাজির হলো ‘সিকাডা ৩৩০১’ এর দ্বিতীয় ধাঁধা। ধাঁধার শুরুতে একটি শুভেচ্ছা বার্তায় লেখা ছিল,

“হ্যালো। তোমাদের অবতার সন্নিকটে। তোমাদের তীর্থযাত্রার শুরু এখান থেকেই। সকল রহস্যের উত্তর মেলবে ধাঁধার শেষে। শুভ কামনায়, ৩৩০১”

অনেকেই চটে গেলেন। কিন্তু এবারও বহু মানুষ এই ধাঁধার নেশায় মেতে উঠলেন। প্রথম ধাঁধার মতোই তা বেশ রোমাঞ্চকর ছিল বলে মন্তব্য করেন ধাঁধা সমাধানকারীদের একজন। এই ধাঁধায় বিজয়ী একজনের ছদ্মনাম Nox Populi (নক্স পপুলি)। কিছুদিন পর এক টকশোতে প্রথম ধাঁধার বিজয়ী মার্কাস ওয়েনার জানান, তার সাথে নক্স পপুলি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। নক্স পপুলির মতে, এবারও তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এক অজ্ঞাত কারণে তারা হঠাৎ করে বিজয়ীদের সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। এই অদ্ভুত আচরণের কারণ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা কিছুই জানতে পারেননি।

পুরো ঘটনা এখানে শেষ হলেও হয়তো হতো। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরবর্তী বছরে পুনরায় নতুন ধাঁধা নিয়ে হাজির হয় সিকাডা ৩৩০১। এখন পর্যন্ত ২০১৪ সালে প্রকাশিত সেই ধাঁধার কোনো বিজয়ীর নাম জানা যায়নি। প্রথম ধাঁধার সমাধানকারী জুয়েল এরিকসন আর কোনো ধাঁধায় অংশ নেবেন না বলে জানিয়েছেন। জুয়েল এরিকসন জানান, তার আইটি সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার জন্য স্টেগানোগ্রাফি, ক্রিপ্টোগ্রাফির কাজগুলো করা খুব সহজ ছিল। কিন্তু অন্যান্য সাহিত্যভিত্তিক অংশে তাকে বেশ ভুগতে হয়েছিলো। তাই এবার তিনি আর চেষ্টা করবেন না। হয়তো এরিকসনের মতো অনেকেই বৃথা সময় অপচয়ের ভয়ে সিকাডা ৩৩০১ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

শেষকথা

ইন্টারনেট আধুনিক যুগের এক বিস্ময়। আর সিকাডা ৩৩০১ ইন্টারনেটের জগতের অন্যতম প্রধান বিস্ময়। হয়ত অদুর ভবিষ্যতে সিকাডার গোপনীয়তা প্রকাশ পাবে , সিকাডার বেশ কয়েকটি ধাধার সমাধান ইন্টারনেট জুড়ে রয়েছে কিন্তু পূর্নাংগ সমাধানের আগ পর্যন্ত তাদের সম্পর্কে হয়ত কিছুই জানা সম্ভব হবে না।

 

 

Related posts

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ১০টি ফুল

News Desk

টিকটক(TikTok)কি ? বাংলাদেশে কতটা জনপ্রিয় এই অ্যাপ, টিকটক থেকে টাকা উপার্জন

News Desk

জোড়া শালিক দেখা কি আসলেই ভালো?

News Desk

Leave a Comment