সমাজে পুরাতন সংস্কার-বিশ্বাস এবং ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। ভারতে, তুরস্কে, মিসরে এবং আরো কোনো কোনো রাষ্ট্রে ধর্মীয় শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি সুবিধামতো রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম : ইসলাম’—দুটো কথাই এখন আছে।
কি সাম্প্রদায়িকতার জন্য মামলা-মোকদ্দমায় আসামি করা হয়? বিচার করে শাস্তি দেওয়া হয়? হিন্দু মন্দির ও হিন্দু বাড়ি লুট করার ঘটনা তো বছর দশেক ধরে ক্রমাগত বাড়ছে! বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রতি মুসলমানদের কিংবা মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের কি কোনো বিদ্বেষ আছে? বাংলাদেশে কি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো বিরোধ আছে?
ইংরেজ শাসকরা ভারতে তাদের Devide and Rule Policy অনুযায়ী Nationalism এর ধারণাকে বিভ্রান্ত করার জন্য সচেতনভাবে Communalism কথাটা চালু করেছিল এবং ১৯৪৭ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবকে বিভক্ত করে, ভারতকে বিভক্ত করে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি জিন্নাহর ও নিখিল ভারত কংগ্রেসের সভাপতি নেহরুর কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র, নজরুল, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখের লেখায় ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’ কিংবা ‘হিন্দু-মুসলিম বিরোধ’ কথাগুলো পাওয়া যায়; সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক বিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সাম্প্রদায়িকতাবাদ ইত্যাদি কথা পাওয়া যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক শক্তি ইত্যাদি কথা প্রচার করার সময়ে সতর্কতা দরকার।
মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের ফল কী হয়েছে? সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনের কথা, জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচন সামনে নিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও উদীচী ইত্যাদি সংগঠন থেকে বেশ জোরেশোরে প্রচার চালানো হচ্ছে। তাদের প্রচেষ্টা সফল হোক—এটাই কামনা করি। সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্পর্কে নানাজনের এবং নানা সংগঠনের নানা মত আছে। শুধু বাংলা ভাষায়ই নয়, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ইত্যাদি ভাষায়ও এ নিয়ে নানা মত আছে। এই বাস্তবতায় কী অর্থে আমরা সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ইত্যাদি কথা ব্যবহার করি, তা স্পষ্ট করা দরকার। সংস্কৃতি কথাটার অর্থ কি ‘বিনোদনমূলক কাজ’?
Culture বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, গোপাল হালদার, নীহার রঞ্জন রায়, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ প্রমুখের ধারণা কি এক? বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য এ বিষয়টির বিবেচনাও অপরিহার্য।
কোনো তাত্ত্বিক আলোচনার কথা আমি বলছি না, বলছি পরিচ্ছন্ন কর্মোপযোগী চিন্তার কিংবা আন্দোলনের লক্ষ্যে কর্মসূচির কথা। বাংলা ভাষায় Culture বা সংস্কৃতি নিয়ে দেড় শ বছর ধরে অনেকে আলোচনা করেছেন, করছেন। আমার কোনো কোনো বইয়েও এ বিষয়ে আলোচনা আছে। ধারণাটি বিকাশশীল। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে, রাজনৈতিক দলে, রাজনৈতিক আন্দোলনে ও বুদ্ধিজীবীদের মহলে সংস্কৃতির সচেতন চর্চা থাকলে তা দ্বারা জনজীবনে অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়। ‘ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি’ গ্রন্থে (বাংলা অনুবাদ ১৯৬৯; মূলগ্রন্থ ইংরেজিতে ‘Foundation of Indian Culture’ , প্রথম প্রকাশ?) শ্রী অরবিন্দ (১৮৭২-১৯৫০) উল্লেখ করেছেন, ‘পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্যে উন্নীত করাই সংস্কৃতির জীবন্ত লক্ষ্য। ’ এই কথাটা অরবিন্দের আগে ও পরে নানাভাবে আরো কেউ কেউ লিখেছেন। অরবিন্দ Life Divine -বাংলা অনুবাদে ‘দিব্য জীবন’ নামে যে বই লিখেছেন তাতে তিনি পৃথিবীতেই মানুষের চেষ্টায় দিব্য জীবন বা স্বর্গীয় জীবন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। স্বর্গ-নরক আছে কি নেই, তা তো যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা যায় না। সেটা বিশ্বাসের বিষয়। জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে মানুষের ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত চেষ্টা দ্বারা পৃথিবীকেই স্বর্গরাজ্যে উন্নীত করা যাবে, এমনটা উপলব্ধি করা যায়। অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির এই কালে দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী আরো নানা যুদ্ধের এবং মানুষের পাশবিক আচরণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে যে বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে মানবজাতির সেই আশাবাদ আর নেই। তবে বিভিন্ন জাতির মধ্যে এবং বাংলা ভাষার দেশেও কিছু লোকের মধ্যে এমন ধারণা আছে যে মানবজাতি এ রকম থাকবে না, সব জাতির মধ্যেই মনুষ্যত্ব বিষয়ে নতুন সচেতনতা ও জাগরণ দেখা দেবে এবং নতুন আশাবাদ অবশ্যই দেখা দেবে। মানবজাতি উন্নতির দিকেই যাবে।