Image default
রাজনীতি

বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ হ্রদের আদ্যোপান্ত

বঙ্গভঙ্গ বাংলার ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আদেশে ১ম বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়। বাংলা বিভক্ত করে ফেলার ধারনাটি অবশ্য কার্জন থেকে শুরু হয়নি। ১৭৬৫ সালের পর থেকেই বিহার ও ওড়িশা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সরকারী প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বাংলা অতিরিক্ত বড় হয়ে যায় এবং ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এটির সুষ্ঠু শাসনক্রিয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত এখান থেকেই।

কিন্তু ১৯১১ সালে, প্রচণ্ড গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়। দ্বিতীয়বার বঙ্গভঙ্গ হয় ১৯৪৭ সালে। এর ফলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতে যুক্ত হয়। এই পূর্ববঙ্গই পরবর্তীকালে পাকিস্তানের কাছ থেকে এক রক্তক্ষয়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে ও বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে।

বঙ্গ প্রদেশের আয়তন ছিল ১,৮৯,০০০ বর্গমাইল (৪,৯০,০০০ কিমি২) এবং জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৮৫ লাখ। বঙ্গের পূর্বাঞ্চল ভৌগোলিক এবং অপ্রতুল যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল হতে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৮৩৬ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে বঙ্গ থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধিনে ন্যস্ত করা হয় এবং ১৮৫৪ সালে বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব হতে গভর্নর-জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে অব্যাহতি দিয়ে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের উপর অর্পণ করা হয়। ১৮৭৪ সালে সিলেট সহ আসামকে বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে চিফ-কমিশনারশীপ গঠন করা হয় এবং ১৮৯৮ সালে লুসাই পাহাড়কে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

বিভক্তিকরণ

১৯০৩ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ বিবেচনা করা হয়। তখন বঙ্গ হতে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাদ্বয়কে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাবও ছিল। তেমনিভাবে ছোট নাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে আত্তিকরণেরও একটি প্রস্তাব ছিল। ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকারীভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় এবং ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন বঙ্গের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এক সরকারি সফরের মাধ্যমে এই বিভক্তির ব্যাপারে জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে এই বিভক্তির বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দেন।

পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী (দার্জিলিং বাদে) বিভাগ এবং মালদা জেলা, আসাম প্রদেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে এই নতুন প্রদেশ গঠন করবে। এর ফলে বঙ্গ শুধু তার বৃহৎ পূর্বাঞ্চলই হারাবে না, তাকে হিন্দীভাষী পাঁচটি রাজ্যও মধ্যপ্রদেশকে ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিমে সম্বলপুর এবং মধ্যপ্রদেশের পাঁচটি ওড়িয়া-ভাষী রাজ্যের সামান্য অংশ বঙ্গকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ফলে বঙ্গের আয়তন দাঁড়ায় ১,৪১,৫৮০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লাখ, যার মধ্যে ৪ কোটি ২০ লাখ হিন্দু ও ৯০ লাখ মুসলিম।

নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব বঙ্গ ও আসাম” যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫০৪ বর্গমাইল (২,৭৫,৮৪০ কিমি২) এবং জনসংখ্যা হবে ৩ কোটি ১০ লাখ, যাদের মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ মুসলিম ও ১ কোটি ২০ লাখ হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে এবং কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় থাকবে। সরকার নির্দেশ দেয় যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চিম সীমানা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকবে সাথে সাথে এর ভৌগোলিক, জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্টাবলিও নির্দিষ্ট থাকবে। সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯শে জুলাই, ১৯০৫ সালে এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর।

বঙ্গভঙ্গ রদ

আগের পর্বে বলা হয়েছিল ১৯১০ সালের শেষের দিকে ভারতের প্রশাসনের দুটি বড় পরিবর্তনের কথা। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিটিশ সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর ভারতে আসার ঘোষণা দেন। এ সময় যাতে ভারতীয়রা, বিশেষ করে কংগ্রেস নেতৃত্ব যেন কোনো ঝামেলা না করে সে কারণে তিনি তাদের সাথে এক প্রকার আপোসে যান। কংগ্রেসের সাথে বঙ্গভঙ্গ রদের ব্যাপারে আপোসে গেলেও অন্যদিকে লর্ড হার্ডিঞ্জের মাথায় ছিল ভিন্ন এক পরিকল্পনা। বঙ্গভঙ্গ রদ করলে মুসলমানরা ক্ষিপ্ত হবে এটি জানা ছিল তার। একইসাথে বাংলাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জোরদার হচ্ছিল। দুই পক্ষকে শান্ত রাখার জন্য গোপনে আরেক চাল চালেন তিনি।

পঞ্চম জর্জ
পঞ্চম জর্জ

১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট হার্ডিঞ্জ ভারত সচিবের কাছে সুপারিশ করেন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের। এর ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। প্রথমত, বাংলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দমন করা যাবে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ভারতে মুসলিম শাসনের কেন্দ্র দিল্লিকে রাজধানী করে মুসলিমদের খুশি রাখা যাবে। একই সাথে বিহার ও উড়িষ্যাকে বাংলা থেকে পৃথক করে দুই বাংলাকে এক করার পরিকল্পনা তো ছিলই। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লির মসনদে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের ঘোষণা করেন। ১৯১২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয় বঙ্গভঙ্গ রদ। একইসাথে কলকাতা হারায় রাজধানীর মর্যাদা। দুই বাংলা এক হলেও রাজধানীর মর্যাদা আর থাকে না বাংলা প্রদেশের।

দিল্লির দরবারে রাজা পঞ্চম জর্জ ও তার রানী

বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ

বঙ্গভঙ্গ রদের মূল কারণ ছিল হিন্দুদের বিরোধীতা, স্পষ্ট করে বলতে গেলে পশ্চিম বাংলার উঁচু শ্রেণীর হিন্দুদের বিরোধীতা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার কথা ভেবে হিন্দু রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ শিক্ষিত শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করে। অথচ পূর্বের হিন্দুরা ঠিকই বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই ছিল। তবে পরবর্তীতে পশ্চিমের উগ্রবাদী আন্দোলনের প্রভাব পূর্বেও পড়ে। সবচেয়ে বাজে অবস্থা হয় যখন বাংলাকে ভাগ করাকে কেন্দ্র করে উগ্র হিন্দুত্ববাদের জন্ম হয় ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রসারের চেষ্টায় মুসলমানদের সমর্থন হারায় কংগ্রেসসহ হিন্দু নেতারা।

কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর, দিল্লির দরবারে রাজা পঞ্চম জর্জ

স্বদেশী আন্দোলনের শুরুতে ব্রিটিশ পণ্য বয়কটও ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক অচলতার সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ কারখানাগুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরাও বঙ্গভঙ্গ বাতিলের জন্য সরকারকে চাপ দিতে থাকে। একইসাথে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ব্রিটিশ সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। পরবর্তীতে চাপে পড়লেও বিরুদ্ধ পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগায় ব্রিটিশরা। পশ্চিম বাংলাকে শান্ত করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করে, কিন্তু একইসাথে রাজধানীও বাংলা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়।

বঙ্গভঙ্গ রদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মুসলিম লীগের দুর্বলতা। মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানালেও সাংগঠনিক দিক দিয়ে কংগ্রেসের চেয়ে দুর্বল ছিল। ফলে কংগ্রেস কলকাতা ও পশ্চিম বাংলায় হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গের জন্য যেমন ঐক্যবদ্ধ করেছিল, মুসলিম লীগ সেরকম কিছুই করতে পারেনি বঙ্গভঙ্গকে সমর্থনের ব্যাপারে। তাদের বেশিরভাগ কার্যক্রম সীমিত ছিল বক্তৃতার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানানো। মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গভঙ্গকে চালু রাখা কিংবা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার মতো কিছু করতে পারেনি মুসলিম লীগ। ফলে কংগ্রেসের কাছে একপর্যায়ে নতি স্বীকার করতেই হয় ব্রিটিশ সরকারকে। মুসলিম লীগ নিজেদের স্বার্থে সেরকম কোনো চাপও সৃষ্টি করতে পারেনি সরকারের উপর। ফলে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হয় স্বাভাবিকভাবেই মাত্র ছয় বছরের মাথায়।

১. স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব: বঙ্গভঙ্গের পর সারা বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। এই আন্দোলনে জনগণ ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করে দেশীয় পণ্য ব্যবহার শুরু করে। এই আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। সরকার এই আন্দোলনের প্রভাব কমাতে এবং বাঙালিদের ঐক্য ভাঙতে ব্যর্থ হয়। এই আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ বঙ্গভঙ্গ রদের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে।

২. জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান: বঙ্গভঙ্গ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এই বিভাজনের ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হয়, যা ব্রিটিশ শাসকদের “বিভাজন ও শাসন” নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয়তাবাদী নেতারা বঙ্গভঙ্গকে ব্রিটিশদের ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতির প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও সংগঠিত করেন।

৩. প্রশাসনিক অকার্যকারিতা: বঙ্গভঙ্গের পর নতুন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হয়। কিন্তু এই কাঠামো অকার্যকর প্রমাণিত হয়। পূর্ববঙ্গ ও আসামের প্রশাসনিক কাজে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতির প্রকোপ বৃদ্ধি ইত্যাদি। এর ফলে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষ আরও বৃদ্ধি পায় এবং বঙ্গভঙ্গ রদের দাবিতে আন্দোলন আরও জোরদার হয়।

৪. হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হয়, যা ছিল ব্রিটিশ শাসকদের কাছে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। এই ঐক্য ব্রিটিশ সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের বিভাজন নীতির ব্যর্থতার প্রমাণ দেয়।

৫. ব্রিটিশ সরকারের নীতি পরিবর্তন: ১৯১১ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ভারতীয়দের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং ভারতীয়দের মধ্যে সद्भाव ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। তার এই নীতি পরিবর্তন বঙ্গভঙ্গ রদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে।

৬. আন্তর্জাতিক চাপ: ব্রিটিশ সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপও বঙ্গভঙ্গ রদের একটি কারণ ছিল। বিভিন্ন দেশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করছিল এবং বঙ্গভঙ্গের নিন্দা জানিয়েছিল। এই আন্তর্জাতিক চাপ ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য করে।

৭. অর্থনৈতিক ক্ষতি: বঙ্গভঙ্গের ফলে ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। স্বদেশী আন্দোলনের কারণে ব্রিটিশ পণ্যের বিক্রি কমে যায়, যার ফলে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলির মুনাফা কমে যায়। এই অর্থনৈতিক ক্ষতি ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদের সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে।

৮. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। স্বদেশী আন্দোলন এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কারণে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অস্থিতিশীলতা ব্রিটিশ সরকারের জন্য একটি বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের বঙ্গভঙ্গ রদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।

৯. ব্রিটিশ সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত: বঙ্গভঙ্গ ছিল ব্রিটিশ সরকারের একটি ভুল সিদ্ধান্ত, যা তারা পরবর্তীতে উপলব্ধি করে। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় এবং ব্রিটিশ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। এই ভুল সিদ্ধান্তের পরিণতি হিসেবে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদের সিদ্ধান্ত নেয়।

১০. জনমতের চাপ: বঙ্গভঙ্গ রদের পক্ষে জনমতের চাপ ছিল অপরিসীম। ভারতীয়রা বঙ্গভঙ্গকে ব্রিটিশদের ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতির প্রমাণ হিসেবে দেখত। তারা বঙ্গভঙ্গ রদের দাবি জানাতে থাকে। এই ব্যাপক গণ-আন্দোলনের চাপের মুখে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়।

 

বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া

 

হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গের সময় হিন্দুদের যে প্রতিক্রিয়া ছিল বঙ্গভঙ্গ রদের পর তাদের প্রতিক্রিয়া হয় ঠিক উল্টো। কংগ্রেস সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। উগ্রপন্থী হিন্দুরা একে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিজয় হিসেবে প্রচার করে। কংগ্রেস সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার ব্রিটিশ সরকারকে অভিনন্দন জানান বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে। কংগ্রেসের ইতিহাস লেখক পট্টভি সীতারাময় লিখেছেন, “১৯১১ সালে কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ করে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনে ন্যায়নীতির পরিচয় দিয়েছে”।

মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া

স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হতাশ হয়। তারা সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে। বাংলা ছাড়াও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানরা এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় যে উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়েছিল সেটি নিয়েও সন্দিহান হয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার জনগণ। মুসলিম লীগের নেতারা সরকারের সমালোচনা শুরু করেন। বঙ্গভঙ্গ রদে সবচেয়ে ব্যথিত হন নবাব সলিমুল্লাহ। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে বলেন, “বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে আমরা যে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলাম তা আমাদের বিরাট দুঃখের কারণ। কিন্তু আমাদের দুঃখ আরো বেশি তীব্র হয়ে ওঠে যখন দেখি সরকার আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে বা কোনো পূর্বাভাষ না দিয়েই এই পরিবর্তন বাস্তবায়ন করলেন”।

শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক

 

বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণার পর ৩০ ডিসেম্বর নবাব সলিমুল্লাহর আহবানে উভয় বাংলার নেতৃত্বস্থানীয়দের নিয়ে এক সভা করেন। সেই সভায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মুসলিম নেতারাও উপস্থিত ছিলেন এবং মুসলমানদের সাথে কোনো প্রকার পরামর্শ না করে হঠাৎ করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করায় সরকারের সমালোচনা করেন। মুসলিম লীগ মুসলমানদের অধিকার আদায়ের মুখপাত্রে পরীনত হয়। মুসলিম লীগের নেতৃত্বের আসে পরিবর্তন। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, এ. কে. ফজলুল হকের মতো নেতারা হাল ধরেন মুসলিম লীগের। ফজলুল হক ব্রিটিশ সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন মুসলমানদের দাবির প্রতি উপেক্ষা করা হলে বিপদের সম্ভাবনা আছে।

ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গ রদ করে পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের শান্ত করতে পারলেও পূর্ব বাংলার মুসলিমদের অসন্তোষ ব্রিটিশদের আরেক সমস্যায় ফেলে। বাংলা থেকে রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া বাংলার মুসলমানদের কোনো প্রভাবই ফেলেনি। লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা সফর করেন এবং মুসলিম নেতার সাথে বৈঠক করেন। তিনি তাদের আশ্বাস দেন নতুন প্রশাসনে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা হবে। একইসাথে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন। ড. রাসবিহারী ঘোষসহ বেশ কজন হিন্দু নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই প্রতিষ্ঠা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

কার্জন হল, বঙ্গভঙ্গ রদের ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন

১১. জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জয়: বঙ্গভঙ্গ রদ ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি বড় বিজয়। এটি ভারতীয়দের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে এবং তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও জোরদার করে। এই ঘটনা ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বোধকে জাগিয়ে তোলে এবং তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়।

১২. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা: বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই ঘটনা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ব্রিটিশ প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয় এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করে।

১৩. ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অসন্তোষ: বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতীয়দের অসন্তোষ কমেনি। এই ঘটনা ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার প্রতি আকাঙ্ক্ষাকে আরও জোরদার করে এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে তীব্রতর করে তোলে।

১৪. নতুন প্রশাসনিক কাঠামো: বঙ্গভঙ্গ রদের পর ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। বাংলাকে একটি প্রদেশ হিসেবে পুনর্বহাল করা হয় এবং দিল্লিকে ভারতের রাজধানী করা হয়। এই পরিবর্তনগুলি ভারতীয়দের দাবির প্রতি ব্রিটিশ সরকারের আংশিক সাড়া হিসেবে দেখা হয়।

১৫. রাজনৈতিক সচেতনতা: বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। তারা বুঝতে পারে যে, সংগঠিত আন্দোলনের মাধ্যমে তারা ব্রিটিশ সরকারকে তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করতে পারে।

হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচেষ্টা

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তবে বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলিম লীগের নেতৃত্বে আসা নেতারা হিন্দুদের বিরোধীতার বদলে ঐক্যের চেষ্টা চালান। ফলে কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃবৃন্দও তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ১৯১৩ সালে লক্ষ্ণৌতে মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে ভারতের জন্য স্বরাজ দাবি কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একইসাথে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ডাক দেয়া হয়। ফজলুল হক মুসলিম লীগের নেতা হবার পরেও কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯১৪ সালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। অন্যদিকে মুসলিম লীগের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন কংগ্রেসের শ্রীমতি নাইডু। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একসাথে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়, যা ‘লক্ষ্ণৌ প্যাক্ট’ নামে পরিচিত। এর ফলে হিন্দু-মুসলমানের হারানো ঐক্য আবারো ফিরে আসতে থাকে এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় ভারতে। একইসাথে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রমাণ করে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সাম্প্রদায়িক রূপ ছিল উগ্রবাদী একটি শ্রেণীর নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা।

লক্ষ্ণৌ প্যাক্টের উপস্থিত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের একাংশ

শুরুতে বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ ব্রিটিশরা নিয়েছিল প্রশাসনিক সুবিধার কথা ভেবে। কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলাকে ভাগ করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও যুক্ত হয়। পশ্চিম বাংলার ব্যাপক বিরোধীতা সত্ত্বেও ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের আন্দোলন। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া হিন্দু-মুসলিম উভয়ই উপকৃত হয় এর ফলে। কিন্তু একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারকে হার মানতে হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কাছে। অবশ্য হার মানলেও দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর করে পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষেই কাজে লাগায় তারা। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে যে দাগ পড়েছিল সেটি আর কখনোই মুছে যায়নি। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রচেষ্টায় কিছুদিন ঐক্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত ঐক্য টেকেনি বেশিদিন। ফলে ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের সময় আর দুই বাংলাকে এক রাখা সম্ভব হয়নি। অথচ বাংলাকে ভাগ করা নিয়েই ঘটে গেছে কত কিছু!

Related posts

কে এই চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী

জাহিদ হাসান

আসিফ নজরুল ,আইনের শিক্ষক থেকে আইন উপদেষ্টা

জাহিদ হাসান

যুক্তরাষ্ট্র কেন সবসময় ইসরায়েলকে সমর্থন করে?

জাহিদ হাসান

Leave a Comment