সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করে ভাগ্যবদল করেছেন কক্সবাজারের তিন শতাধিক নারী-পুরুষ। সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়ন, মহেশখালীর বাঁকখালী নদীর চ্যানেল, শহরের নুনছড়ি, চৌফলদণ্ডী খাল, টেকনাফের সেন্টমার্টিন ও উখিয়ার সোনারপাড়া সমুদ্র উপকূলে এসব সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করছেন তারা।
সামুদ্রিক শৈবালের মধ্যে রয়েছে ওয়েস্টার, গ্রিন মাসেল ও সিউইড। বাঁশের ভেলা, প্লাস্টিকের ড্রাম, রশি, প্লাস্টিকের খাঁচা ব্যবহার করে এগুলো চাষ করা হয়। এতে দারুণভাবে সফল হয়েছেন তারা।
সামুদ্রিক শৈবাল গবেষকরা বলছেন, ওয়েস্টার হলো সাদ বড় ঝিনুক, গ্রিন মাসেল সবুজ ঝিনুক ও সিউইড সামুদ্রিক শৈবাল। চাষ ছড়িয়ে পড়লে উপকূলীয় জলাশয় চাষের আওতায় আসবে। জলজ সম্পদ উৎপাদন বাড়বে। কক্সবাজার উপকূলের দরিদ্র লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটবে। এ ছাড়া গ্রিন মাসেল চাষে রফতানিতে নতুন পণ্য যোগ করতে পারবে বাংলাদেশ।
শৈবাল চাষি ও গবেষকরা জানিয়েছেন, স্থানীয় হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বাসাবাড়িতে শৈবাল দিয়ে মজাদার স্যুপসহ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার তৈরি করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্য, ওষুধ, প্রসাধনী, সার, বায়োফুয়েল তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে সামুদ্রিক শৈবাল। তাই বিশ্বজুড়েই সামুদ্রিক শৈবালের চাহিদা আছে।
২০২২ সালে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এবং আইডিএফ সামুদ্রিক শৈবাল চাষের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এতে স্থানীয় দরিদ্র জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত, চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং চাষিবান্ধব কলাকৌশল উদ্ভাবন করা হয়। কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে গ্রিন মাসেল চাষে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল শেখানো হয়। একইসঙ্গে বাজারজাতের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। বেড়েছে আয়। সংসারে এসেছে সচ্ছলতা। দূর হয়েছে দারিদ্র্য।
একসময় লবণ মাঠের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন খুরুশকুল ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. আনোয়ার মিয়া। এখন ইউনিয়নের পশ্চিম প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের বাঁকখালী চ্যানেলে ২০টি ভেলায় সামুদ্রিক শৈবালের চাষ করছেন। প্রতি মৌসুমে ৭০-৮০ হাজার টাকার শৈবাল বিক্রি করেন। আনোয়ার মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি আইডিএফ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ড্রাম, বাঁশ ও রশি দিয়ে ভেলা তৈরি করে ওয়েস্টার ও গ্রিন মাসেল চাষ করছি। এগুলো বিক্রি করে সংসার চলে। মৌসুমে ৭০-৮০ হাজার টাকার বিক্রি হয়।’
তার মতো শৈবাল চাষ করে ভাগ্যবদল হয়েছে আরও তিন শতাধিক নারী-পুরুষের। একই ইউনিয়নের বাসিন্দা রেজিয়া বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সবুজ ও সাদা ঝিনুক চাষ করে সফলতা পেয়েছি। সংসারের কাজের পাশাপাশি এই কাজ করে আসছি। এই কাজ করতে গিয়ে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। এখন আমার সংসারে অভাব নেই। এর মধ্য দিয়ে ভাগ্যবদল হয়েছে।’
একই কথা বলেছেন সোনারপাড়ার গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ। প্রথমে বাঁশ, ড্রাম ও রশিতে পুঁজির দরকার পড়ে। এরপর বাঁশের ভেলাগুলো পাহারা দিতে হয়। যাতে নদীতে মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার যাতায়াত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নষ্ট না হয়। এতে তেমন কোনও সময় অপচয় হয় না। উৎপাদিত পণ্যগুলো বিক্রিতে বাজারে যেতে হয় না। বাসা থেকে কিনে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।’
একই তথ্য দিয়েছেন শৈবাল চাষি খালেদা বেগম ও আবদুল করিম। তারা জানান, প্রথমে বাঁশ বেঁধে ভেলা তৈরি করেন। পরে প্লাস্টিকের বয়া সংযুক্ত করা হয়, যাতে ভেলাটি ভাসমান থাকে। এরপর শৈবাল চারা এনে সেখানে লাগানো হয়। লবণাক্ত পানিতে কোনও ধরনের পরিচর্যা ছাড়াই শৈবাল বাড়তে থাকে।
কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুর রহমানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক শৈবাল চাষি। তিনি জানান, সামুদ্রিক শৈবাল খুবই পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার। এটি প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যায়। খাদ্য হিসেবে দেশে সামুদ্রিক শৈবালের পরিচিতি বাড়ানো গেলে কর্মসংস্থানও বাড়বে। কক্সবাজারে বর্তমানে ৩৭০ জন শৈবালের চাষ করছেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে কক্সবাজারের অন্তত ৫০ হাজার মানুষকে শৈবাল চাষে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ শৈবাল চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশে সামুদ্রিক শৈবালের চাষ বাড়ানো গেলে রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো যাবে।
কক্সবাজারে শতাধিক নারী-পুরুষকে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া আইডিএফের মৎস্য কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকার গ্রামীণ নারী-পুরুষকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য শৈবাল চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে কারিগরি সহায়তা এবং বাজারজাতের পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে করে মাঠপর্যায়ের চাষিরা পাচ্ছেন ব্যাপক সফলতা। এজন্য অনেকে যুক্ত হচ্ছেন।’
কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সামুদ্রিক শৈবালবিষয়ক প্রকল্পের পরিচালক মো. মহিদুল ইসলাম জানান, ২০১৮ সালে তাদের প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে পরীক্ষামূলকভাবে সামুদ্রিক শৈবালের চাষ শুরু হয়। চাষে সফলতা পাওয়ার পর বাণিজ্যিক চাষে মানুষকে উৎসাহিত করতে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা পাঠান তারা। অনেকে এরই মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাষ শুরু করেছেন। চাষিদের কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র থেকে কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।