কৃষিজমি রক্ষায় সরকারের যে সিদ্ধান্ত, তা উপেক্ষা করে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলায় তিন ফসলি জমি ভরাট করে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র সম্বল হারানোর আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় কৃষকরা। তারা বলছেন, ‘আমাদের জীবন-জীবিকা হুমকিতে ফেলে স্টেডিয়াম চাই না। কোনও দরকার নেই। তবে উপজেলার অন্য কোথাও স্টেডিয়াম হতে পারে।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালে হাইমচর উপজেলার লামচরি গ্রামে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাস জমিতে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। ওই সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিষয়টি অবগত না করায় প্রস্তাবনা বাতিল হয়ে যায়। এরপর ২ নম্বর আলগী দুর্গাপুর উত্তর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত উত্তর আলগী মৌজায় প্রায় সাড়ে ৩ একর কৃষিজমি ‘নাল’ দেখিয়ে স্টেডিয়াম তৈরির জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। অথচ সেটি উপজেলার সবচেয়ে বড় ফসলি জমি। সেখানে ধান, ভুট্টা, সয়াবিন ও মাষকলাই ডালসহ বছরে তিনটি ফসল আবাদ করেন কৃষকরা। এরই মধ্যে স্টেডিয়াম করার জন্য খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণ ও বালু দিয়ে জমি ভরাটের উদ্যোগের খবর ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন কৃষকরা। সেখানে স্টেডিয়াম নির্মাণ না করার দাবি জানিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা।
যা বলছেন কৃষকরা
ফসল ফলানোর একমাত্র সম্বল কৃষিজমি ভরাট করে স্টেডিয়াম নির্মাণের খবর শুনেছেন স্থানীয় কৃষক রহমত উল্যাহ। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাইমচর থানার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় ফসলি জমি। এখানে খুব ভালো ফসল হয়। এই জমির ওপর নির্ভর করে এখানের পরিবারগুলোর জীবিকা নির্বাহ হয়। এখন শুনছি, এখানে স্টেডিয়াম হবে। পেটে ভাত থাকলেই তো আমাদের সন্তানরা খেলতে মাঠে যাবে। পেটে ভাত না থাকলে কীভাবে খেলতে যাবে? ভাত আসে যে জমি থেকে সেখানে স্টেডিয়াম দরকার নেই।’
উত্তর আলগী দুর্গাপুর গ্রামের আরেক কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘স্টেডিয়ামের জন্য প্রস্তাবিত স্থানে আমার ৪৬ শতাংশ জমি আছে। প্রতি বছর ৪০ মণ ধান পাই। পাশাপাশি ভুট্টা, সয়াবিন ও মাষকলাই ডাল আবাদ করি। জমির আয়ের ওপর আমার সাত সদস্যের পরিবার নির্ভরশীল। এখানে স্টেডিয়াম হলে আমাকে পরিবার-পরিজন নিয়ে পথে বসতে হবে। তাই স্টেডিয়ামের কোনও দরকার নেই। এখানে স্টেডিয়াম হলে আশপাশের আরও ৫ একর কৃষিজমি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে অন্যত্র হলে আমার আপত্তি নেই।’
ওই এলাকার কৃষাণী পারভীন বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাকে দেখার কেউ নেই। ছেলেমেয়ে তিন জন। এখানে ১৫ শতাংশ জমির ফসল দিয়ে সংসার চলে আমার। বর্গা দিয়ে গত বছরও ২০ মণ ধান পেয়েছি। যদি স্টেডিয়াম করার জন্য আমার জমি নিয়ে যায়, তাহলে কীভাবে চলবো? আমি এখানে স্টেডিয়াম চাই না, পেটে ভাত চাই। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি আমাদের জমি রক্ষার ব্যবস্থা নেবেন।’
আলগী দুর্গাপুর গ্রামের এক কৃষকের সন্তান কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল আমিন বলেন, ‘এই জমিতে ফসল ফলিয়ে আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলে। আমরা পড়ালেখা করছি। জমিটি যদি স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য নিয়ে যায়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় পড়বে। কৃষকরা খাদ্য সংকটে পড়বেন। স্টেডিয়াম হলে বর্ষা মৌসুমে আশপাশে জলাবদ্ধতাসহ নানা সমস্যা দেখা দেবে। এখন যে রকম সুন্দর পরিবেশ আছে, তাও নষ্ট হয়ে যাবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, এখানে নয়; অন্য কোনও স্থানে যেন স্টেডিয়াম হয়।’
আলগী দুর্গাপুর গ্রামের কৃষক কালু হোসেন বলেন, ‘হঠাৎ সরকারি লোকজন এসে জানালেন আমার কৃষিজমিতে স্টেডিয়াম হবে। এই কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এখানে স্টেডিয়াম হলে আমার সংসার চলবে কীভাবে। তাই কোনোভাবেই আমার ফসলি জমিতে স্টেডিয়াম হতে দেবো না।’
বিকল্প জমি দেখিয়ে দিলেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান
ওই কৃষিজমি ছাড়াও স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য আরও জমি আছে বলে জানালেন ২ নম্বর আলগী দুর্গাপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান পাটোয়ারী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৮ সাল থেকে হাইমচরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম করছে সরকার। এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে আমাদের লামচরি গ্রামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি পরিত্যক্ত জমিতে স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য কয়েক বছর আগে একটি ডিও লেটার দিয়েছেন আমাদের সংসদ সদস্য সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি। বিষয়টি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অনাপত্তিপত্র দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষিজমিতে স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। আমরা উন্নয়নের পক্ষে। খেলাধুলার জন্য এখানে স্টেডিয়াম দরকার। তবে তা কৃষিজমি নষ্ট করে হোক, এটি চাই না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিত্যক্ত জমিতে স্টেডিয়ামটি হলে তো কোনও সমস্যা নেই। তাহলে উন্নয়ন হবে, কৃষিজমিও রক্ষা পাবে। সেইসঙ্গে কৃষকের জীবিকাও টিকে থাকবে।’
তবে ফসলি জমিতেই স্টেডিয়াম নির্মাণে আগ্রহী উপজেলা চেয়ারম্যান
কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন জেনেও তাদের দাবি আমলে না নিয়ে কৃষিজমিতেই স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য আগ্রহ দেখালেন হাইমচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূর হোসেন পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষের ক্ষতি হলেও বৃহৎ অংশের মানুষ উপকার পাবে। স্টেডিয়াম হলে হাইমচরের আড়াই লাখ মানুষের উপকার হবে। যুবকরা সেখানে খেলাধুলা করতে পারবে। এজন্য স্টেডিয়াম হাইমচরে অতি প্রয়োজন।’
দেশের অন্যান্য উপজেলায় স্টেডিয়াম হয়ে গেছে, কিন্তু হাইমচরে এখনও আমরা করতে পারছি না উল্লেখ করে নূর হোসেন পাটোয়ারী আরও বলেন, ‘এখন আমরা যে জায়গার জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছি, সেখানে তেমন ফসল হয় না। আর অধিগ্রহণের ফলে জমির যে দাম দেওয়া হবে, তা বর্তমান দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। জমির মালিকরাই উপকৃত হবেন। সেখানে স্টেডিয়াম হলে কৃষি ও কৃষকদের তেমন কোনও ক্ষতি হবে না।’
তদন্ত কমিটি গঠন
কৃষকদের দাবির মুখে প্রস্তাবিত ওই জমি কৃষিকাজে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে উপজেলা প্রশাসন।
হাইমচর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিরুপম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য অনেক আগেই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। আমি এবং ইউএনও দুজনই উপজেলায় নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। এখন যেহেতু কৃষকরা সেটিকে কৃষিজমি দাবি করে স্মারকলিপি দিয়েছেন; আসলে কৃষিকাজে ব্যবহার হচ্ছে কিনা; তা যাচাইয়ের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবেন।’
যা বললেন ইউএনও
কৃষকদের জীবন-জীবিকার ক্ষতি করে কোনও কাজ আমরা করবো না এমনটি জানিয়েছেন হাইমচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালমা নাজনীন তৃষা। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘তাই প্রস্তাবিত জায়গাটি ফসলি জমি কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রতিবেদন জমা দিলে আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠাবো।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকিল খন্দকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত জমি ফসলি কিনা, তা তদন্ত করার জন্য ঈদুল আজহার আগে আমাকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ঈদের পর থেকে তদন্ত শুরু করেছি। এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেবো।’
প্রসঙ্গত, কৃষিজমি সুরক্ষা, অকৃষি জমির সর্বোচ্চ সীমার বিধান, খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাসের উদ্দেশ্যে ‘ভূমি মালিকানা ও ব্যবহার আইন, ২০২৩’-এর খসড়া চূড়ান্তকরণের কাজ করছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত ডেল্টা কাউন্সিলের পদাধিকার বলে অন্যতম সদস্য ভূমিমন্ত্রী। দেশে বন্যা, নদী ভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় কৌশল হলো ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’।