আট বছর পরেও সেই নৃশংস জঙ্গি হামলার ঘটনা ভুলতে পারেননি কিশোরগঞ্জবাসী। সেদিনের কথা মনে করে শিউরে ওঠেন সবাই। স্বজন হারানোর স্মৃতি আর বীভৎস হামলার ঘটনা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় এই এলাকার মানুষদের। আশপাশের বাড়িঘরের দেয়ালে এখনও দেখা যায় গুলির চিহ্ন।
২০১৬ সালের ৭ জুলাই ঈদুল ফিতরের দিন সকাল পৌনে ৯টার দিকে শোলাকিয়া ঈদগাহে ছিল মানুষের ঢল। হঠাৎ আজিমউদ্দিন হাইস্কুল সংলগ্ন রাস্তায় মুফতি মুহাম্মদ আলী মসজিদের সামনে পুলিশের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে অতর্কিত হামলা চালায় অস্ত্রধারী জঙ্গিরা। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে জঙ্গিদের সঙ্গে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধ হয়।
এ সময় জঙ্গিরা জবাই করে হত্যা করে পুলিশের দুই কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম ও আনসারুল হককে। আহত হন পুলিশের কমপক্ষে আট সদস্য। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাস্থলে নিহত হয় আবির রহমান নামে এক জঙ্গি। হামলার সময় জঙ্গিদের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিজের ঘরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন গৃহবধূ ঝরনা ভৌমিক।
শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে গুরুতর আহত অবস্থায় জঙ্গি শফিউল ইসলাম ডন নামে এক সশস্ত্র জঙ্গি এবং তানিম নামে স্থানীয় এক সন্দেহভাজন যুবককে আটক করা হয়। এ মামলার মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে ১৯ জন জঙ্গি হামলা চালাতে গিয়ে এবং পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বিভিন্ন সময় মারা যায়। পরে জেএমবি সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, আনোয়ার হোসেন, সোহেল মাহমুদ, রাজীব গান্ধী ও জাহিদুল হক তানিম নামে বাকি পাঁচ জনকে মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি করা হয়। বর্তমানে তারা কারাগারে আটক রয়েছে। এই আসামিদের দ্রুত সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন কিশোরগঞ্জবাসী।
ওইদিনের হামলার ঘটনাস্থল সবুজবাগ গলির নাম এখন ‘ঝরনা রানী ভৌমিক সড়ক’। গলির ভেতরে বিভিন্ন বাসার দেয়ালে এখনও গুলির চিহ্ন। সেগুলো মুছে যায়নি। আট বছরেও এলাকাবাসী ভুলতে পারেননি সেই দুঃসহ স্মৃতি। সেই ভৌমিক নিবাসে আজও শোকের আবহ। যে জানালাটা ভেদ করে গুলি ভেতরে গিয়ে ঝরনা রানী মারা যান, সেই জানালাটার পাশে টাঙানো হয় ঝরনার ছবি। তার স্বামী গৌরাঙ্গ গত ১৮ জুন মারা গেছেন। তাদের সন্তান শুভ দেব পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এখনও সেদিনের কথা মনে হলে তারা আঁতকে ওঠেন। বিশেষ করে, তখন যারা ছোট ছিল, তাদের মন থেকে এ ঘটনার স্মৃতি দূর হচ্ছে না কিছুতেই।
প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান রেণু। যিনি পুরো বিষয়টি পাঁচতলার বাসা থেকে দেখেছেন। তিনি জানান, পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। জঙ্গিরা ঢুকে পড়ে তার বাসার সামনের সবুজবাগ গলিতে। ভয়ে বাসার সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে পড়েন। তিনি বাসার চারতলায় গিয়ে জানালার পাশে অবস্থান নেন। তখন এক হামলাকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা নিক্ষেপ করে। এ সময় একজন হামলাকারী হাতে থাকা চাপাতি ঘোরাতে ঘোরাতে পুলিশকে আক্রমণ করতে আসে। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা গুলি করে চাপাতি হাতে থাকা জঙ্গিকে মাটিতে ফেলে দেন।
এ ঘটনায় তিন দিন পরে পাকুন্দিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ শামসুদ্দীন বাদী হয়ে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের বিভিন্ন ধারায় কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা করেন।
জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পরবর্তী সময়ে এ মামলায় মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়। বিভিন্ন সময়ে বন্দুকযুদ্ধে আসামিদের মধ্যে ১৯ জন মারা যায়। জীবিত পাঁচ আসামির মধ্যে দুজন গাজীপুরের কাশিমপুর, দুজন কিশোরগঞ্জ এবং একজন রাজশাহী কারাগারে আটক রয়েছে। তারা হলো– জাহিদুল হক তানিম, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজিব গান্ধি, মিজানুর রহমান, আনোয়ার হোসেন ও মো. সবুর খান। মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আরিফুর রহমান ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই আদালতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, ‘এরই মধ্যে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আশা করি অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। নিহতদের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে। এটি অনেক বড় একটি ঘটনা। সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। আগামী ৩১ জুলাই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।’