রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে (৩৩) পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দুই দিনেও কোনও মামলা হয়নি। পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলের মানুষ কেউ মুখ খুলছেন না। এখন পর্যন্ত পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় কোনও অভিযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে ঘটনার তদন্ত করাও সম্ভব হচ্ছে না।
গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে মাসুদের ওপর হামলা করা হয়। পরে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় থানায় সোপর্দ করা হয়। এর পর হাসপাতালে নেওয়া হলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে মারা যান। ময়নাতদন্তের পর রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর গোরস্থানে (বাড়ির পাশের গ্রাম) মাসুদকে দাফন করা হয়েছে।
এর আগে, রবিবার দুপুরে লাশ নেওয়ার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে মাসুদের স্ত্রী বিউটি আরা তার পাঁচ দিনের সন্তানকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মেয়ের নাম এখনও রাখা হয়নি। তিনি জানান, আকিকা দিয়ে বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে মেয়ের নাম রাখার কথা ছিল মাসুমা আক্তার। সেই আকিকা আর দেওয়া হলো না।
সোমবার রাত পর্যন্ত মাসুদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ থানায় অভিযোগ নিয়ে আসেননি।
এ ব্যাপারে মাসুদের মামা এমদাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের পরিবার এখনও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছে। এ বিষয়ে আমরা মামলা করতে চাচ্ছি না। এই ঘটনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে মামলা করলেও বিচার হবে না। তাই মামলা করবো না।’
তবে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছে, কিন্তু সেখানকার কোনও মানুষ মাসুদকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়ে তথ্য দিচ্ছেন না। যারা তাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদেরও পরিচয় দিচ্ছেন না। ঘটনার পর মতিহার থানায় রমজান নামের এক লোক জানতে গিয়েছিলেন, মাসুদের নামে ওই থানায় কোনো মামলা ছিল কি-না। মামলা না থাকার কথা শুনে তারা নগরের বোয়ালিয়া থানায় আহত মাসুদকে নিয়ে যান। সেখান থেকে রাতে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই মৃত্যু হয়।
মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে কি-না জানতে চাইলে উপাচার্য সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘সোমবার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মামলার বিষয়টি আমাদের আলোচনার মধ্যে রয়েছে। আমার তরফ থেকে বারবার জনসংযোগ দফতরকে বলেছি, যেন কেউ আইন নিজের হাতে তুলে না নেন। এটার ব্যাপারে সতর্ক আছি। পরিবার মামলা না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে করা হয়। আমরা সেই দিকে তাকিয়ে আছি।’
সহ-সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি নগরের বুধপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সামনে হামলার শিকার হন। এতে ডান পায়ের নিচের অংশ গোড়ালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাঁ পা-ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেটে দেওয়া হয়েছিল হাতের রগ। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্যরা ওই হামলা চালান। এ হামলায় পা হারিয়ে মাসুদ একটি প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাচল করতেন। তার অন্য পা গত শনিবার রাতে ভেঙে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে একটি চাকরি চেয়ে ২০২২ সালের শেষের দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লেখেন মাসুদ। এরপর ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৭ মীর তাফেয়া সিদ্দিকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে পাঠানো চিঠিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে আবদুল্লাহ আল মাসুদকে নিয়োগ দিতে নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর মাসুদকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নিয়োগপত্র পেয়ে ২২ ডিসেম্বর চাকরিতে যোগদান করেন। সেই থেকে এ পদেই চাকরি করতেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর কন্যাসন্তানের বাবা হন।
গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে মারা যাওয়ার খবর শোনার পর থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের খাসেরহাট এলাকার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। শোকে বাকরুদ্ধ মাসুদের মা এবং স্ত্রী।
মাসুদের মা তাসেনুর বেগম বলেন, ‘একটা সুসংবাদ (নাতনির জন্ম) পেয়ে খুশিতেই ছিলাম। তার কদিন পরই ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পেলাম। তার পাঠানো টাকাতেই সংসার চলছিল। বড় ছেলে তো বেকার। এখন কী করে যে চলবে, ভেবে কুল পাচ্ছি না। আমার পঙ্গু ছেলে কি এমন করেছিল যে এভাবে পিটিয়ে হত্যা করলো তারা। মৃত্যুর সময় এক ফোটা পানি পর্যন্ত দিলো না। আমার মৃত সন্তানকে টেনেহিচড়ে এক থানা থেকে অন্য থানায় নিয়ে গেছে। আমি আল্লাহর কাছে আজীবন সন্তান হত্যার বিচার চাইতে থাকবো। কারও কাছে অভিযোগ দিতে যাবো না।’
মাসুদের স্ত্রী বিউটি আরা বলেন, ‘বাসায় মাত্র তিন দিনের কন্যাসন্তান। ও আমার জন্য ওষুধ কিনতে বিনোদপুর বাজারে গেলে পিটিয়ে হত্যা করে। আমি রাত সাড়ে ১১টার দিকে জানতে পারি। তখন আমি বাসায় একা ছিলাম। বর্তমানে আমি দিশেহারা। তিনদিনের কন্যাসন্তান নিয়ে বিধবা হলাম। আমার স্বামী তার মৃত্যুর আগে বাড়িতে কিছুই রেখে যেতে পারেনি। দলীয় কোনও নেতাকর্মী বা প্রশাসনিক কোনও কর্মকর্তা দেখা করেননি বা কোনও খোঁজখবর নেননি আমাদের। যদিও আমার স্বামী অনেক দিন থেকে কোনও দলের রাজনীতির সঙ্গে ছিল না। তার শারীরিক অবস্থাও ভালো ছিল না। কার কাছে বিচার চাইবো বুঝতে পারছি না।’
আইনি সহায়তা নেওয়ার প্রসঙ্গে বিউটি আরা বলেন, ‘আমার বড় ভাই (ভাশুর) এখন পরিবারের অভিভাবক। তিনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই চূড়ান্ত। তবে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, এটা আমি চাই। একপর্যায়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, দেড় বছর আগে মাসুদের সঙ্গে বিয়ে হয়। ৩ সেপ্টেম্বর তাদের মেয়ের জন্ম হয়। মাসুদ নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে মেয়ের নাম রাখতে চেয়েছিলেন মাসুমা। আকিকা করে এই নাম ঘোষণা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই তো চলে গেলেন।’
মাসুদের বড় ভাই আয়াতুল্লাহ বেহেস্তী জানান, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ও বেকার জীবনযাপন করছেন। তারা দুই ভাই। বাবা রফিকুল ইসলাম ২০১৩ সালে মারা গেছেন। মা ও তিনি বাড়িতে থাকেন। বাবা মাদ্রাসা শিক্ষক হওয়ায় তারা দুই ভাই মাদ্রাসায় পড়ে দাখিল পাস করেন। বাবাও আওয়ামী লীগ রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। এজন্য তারাও আওয়ামী করেছেন।
আয়াতুল্লাহ বেহেস্তী বলেন, ‘২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির আমার ভাইয়ের ওপর হামলা করে। ওই হামলায় তার এক পা কেটে বিচ্ছিন্ন ও এক পা প্রায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো করে কেটে ফেলা হয়। শরীরে ছিল অসংখ্য ধারালো অস্ত্রের আঘাত। বাঁচার কথা ছিলো না। বহুদিন হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলো। সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মী আতিকুল্লাহ সুমন নামে একজন বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় শিবিরের নেতাকর্মীদের। এবারও শিবিরই মেরেছে বলে ধারণা। সেই মামলারই (২০১৪ সালের মামলা) বিচার সম্পন্ন হয়নি। মামলার শেষ পরিণতি কী হয়েছিল, তাও জানি না। এ নিয়ে হতাশ ছিলাম আমরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাই ২০১৪ সালে পঙ্গুত্ব বরণ করার পর থেকে রাজনীতিতে জড়িত ছিল না। বর্তমানে পরিস্থিতিতে কোনও মামলা করতে পারছি না। কারণ আতঙ্কে আমি রাজশাহী যেতে পারছি না। আমি পরিবারের চার জন সদস্য নিয়ে অত্যন্ত আতঙ্কের মধ্যে আছি। তবে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখছি।’