আমি তোমারি বিরহে রহিবো বিলীন তোমাতে করিবো বাস, দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস। যদি আর কারে ভালোবাসো, যদি আর ফিরে নাহি আসো, তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুঃখ পাই গো। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন উক্তির সঙ্গে মিল রেখেই শেষমেশ পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের তোফাজ্জল।
স্বজন সূত্রে জানা গেছে, তোফাজ্জলের পরিবারের কোনও সদস্য আর বেঁচে নেই। বাবা-মা ও ভাই, একে একে সবাইকে হারিয়েছেন তিনি। তোফাজ্জলের বাবা আবদুর রহমান মারা গেছেন ২০১১ সালে, মা বিউটি বেগম মারা যান ২০১৩ সালে এবং ভাই পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নাসির উদ্দিন মারা যান ২০২৩ সালে। পরিবারের কেউ না থাকায় কখন, কোথায় থাকেন তা কেউ খোঁজও রাখেন না।
একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। তোফাজ্জল ২০০৯ সালে চরদুয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০১১ সালে সৈয়দ ফজলুল হক ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে বাংলা বিভাগে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেন। একমাত্র আশ্রয়স্থল বড় ভাই নাসির, সে-ও মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নিলে তাকে দেখাশোনা করার মতো কেউ ছিল না।
বাবা-মায়ের মৃত্যুশোক কাটিয়ে না উঠতেই ২০১৬ সালে তৎকালীন কাঁঠালতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামের মেয়ের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। সম্পর্কের দুই বছর না গড়াতেই প্রেমিকার বাবা শহিদুল ইসলাম বিষয়টি জেনে যায়। পরে শহিদুল ইসলাম তার মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। সেই থেকেই তোফাজ্জল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীতে পরিণত হন। ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন স্থানে। সে সময়ে তোফাজ্জলের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল বড় ভাই নাসির। বড় ভাই নাসির পুলিশের এএসআই পদে কর্মরত ছিলেন। যেখানেই চাকরিতে যেতেন সেখানেই নিয়ে যেতেন তোফাজ্জলকে। সুস্থ রাখার জন্য অনেক জায়গায় চিকিৎসাও করাতেন তাকে। তবে সে সুখটুকুও আর থাকলো না তার। ২০২৩ সালে মরণব্যাধি ক্যানসারে একমাত্র আশ্রয়স্থল বড় ভাই নাসিরও মারা যায়। সেই থেকে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তোফাজ্জল।
পাথরঘাটা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পাথরঘাটা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান এনামুল হোসেন বলেন, ‘তোফাজ্জলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল আপন ভাইয়ের মতো। খুব ভালোভাবেই কাটছিল তোফাজ্জলের জীবন। তবে একসময় কাঁঠালতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামের মেয়ের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। আর সেই প্রেমই তার জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেমের সম্পর্কের কথা চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম টের পেয়ে মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। তখন থেকে তোফাজ্জল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং নেশার সঙ্গে জড়িয়ে যান। এর কিছু দিনের মধ্যে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। তবে বেশ কয়েক বছর যাবৎ আমি ওর ভরণপোষণ দিয়ে আসছিলাম। তোফাজ্জলকে চিকিৎসার মাধ্যমে মোটামুটি সুস্থ করেছিলাম। ওকে আমার আপন ভাইয়ের মতো দেখতাম। তবে হঠাৎ আবার অসুস্থ হয়ে গত মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে আমাকে কিছু না বলেই ঢাকায় চলে যায়। আর ঢাকায় যাওয়ার একদিন পরেই নরপিশাচদের হাতে নিহত হয়।’
প্রতিবেশী রিয়াজ হোসেন বলেন, ‘তোফাজ্জল অনেক ভালো মনের মানুষ ছিল। তবে একসময় কাঁঠালতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে শহিদ চেয়ারম্যানের বাহিনী তোফাজ্জলকে মারধর করে। সে সময় মাথায় আঘাত লাগার কারণে এবং প্রেমিকাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার ফলে তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।’
তোফাজ্জলের ভাবি লতিফা বেগম বলেন, ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে না থাকায় তোফাজ্জল আমাদের সঙ্গেই থাকতো। তবে ২০২০ সালে করোনার সময় তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। তখন আমি অসুস্থ থাকার কারণে বাড়িতে থাকি। তবে কী কারণে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়েছে তা আমার জানা নাই।’
তোফাজ্জলের ফুফাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া বলেন, ‘আমার ভাই তোফাজ্জল হোসেন মেধাবী ছাত্র ছিল। তবে স্থানীয় এক ইউপি সদস্যের মেয়ের সঙ্গে প্রেম সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ঝামেলা হলে এবং পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একপর্যায়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।’
উল্লেখ্য, বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে আটকে রেখে শারীরিকভাবে নির্যাতন করায় তোফাজ্জল মারা যায়। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।