ভরা মৌসুমে বরিশাল নগরীর ‘ইলিশ মোকাম’ হিসেবে পরিচিত পোর্ট রোডের আড়তে ইলিশ নেই। জেলেরা নদীতে নামলেও অনেকে খালি হাতে ফিরছেন। আবার অনেকে নদীতে জাটকা ধরছেন। সাগরে বড় ইলিশ না পাওয়ায় দাদনের টাকা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন জেলেরা। ইলিশ সংকটের জন্য বৈরী আবহাওয়াকে দায়ী করছেন তারা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় ইলিশ সমুদ্র থেকেই বিক্রি করে দিচ্ছেন জেলেরা।
এদিকে, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রফতানি শুরু হয়েছে। প্রতি কেজি রফতানি হচ্ছে ১০ মার্কিন ডলার বা এক হাজার ১৮০ টাকায়। তবে দেশের বাজারে খুচরা পর্যায়ে এক কেজি ওজনের ইলিশ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ ভারতে যে দামে রফতানি হচ্ছে, তার চেয়ে প্রতি কেজিতে ৮০০ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে দেশের ক্রেতাদের। ফলে রফতানি মূল্য নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
তবে রফতানির খবরে দেশের বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে গেলেও সেটিকে প্রধান কারণ মনে করছেন না বরিশালের আড়তদার ও মাছ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মূলত বাজারে মাছের সরবরাহ কম থাকায় দাম বেশি। কেন সরবরাহ কম সে প্রশ্নের জবাবে তারা জানালেন, নদী ও সাগরে মাছ কম ধরা পড়ছে। কীভাবে বুঝলেন, কারণ সাগরের মাছ পোর্ট রোডের আড়তে আসছে না।
জেলে, আড়তদার ও মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতে রফতানির খবরে সাগরের ইলিশের দাম কিছুটা বেড়েছে। তাও সরবরাহ কম থাকার কারণে। তবে নদীর ইলিশের দাম অপরিবর্তিত আছে। নগরীর ইলিশ মোকামের আড়তদারদের দাবি, এবার মাছের দাম এমনিতেই বেশি। কারণ সংকট। তবে রফতানির খবরে দাম ততটা বাড়েনি, যতটা প্রচার হচ্ছে। নদীর ইলিশ আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। দাম বেশির কারণে ক্রেতাও কম।
নগরীর পোর্ট রোড ইলিশ মোকামের আড়তদার মো. মোবারক হোসেন ও জহির সিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, এবার নিষেধাজ্ঞা শেষে ইলিশ শিকার শুরু হলেও তেমন কোনও সুবিধা পাননি বরিশালের আড়তদার ও জেলেরা। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য আড়ত গড়ে উঠেছে। এ কারণে দাদন দেওয়া হলেও সাগরের জেলেরা এখন আর এই বাজারে আসেন না। তারা তাদের সুবিধামতো স্থানে অর্থাৎ যেখানে বেশি দাম পান, সেখানে ইলিশ বিক্রি করে দিচ্ছেন। পোর্ট রোড মোকামে শুধুমাত্র নদীর ইলিশ আসছে। তাও এবার অনেক কম। এজন্য মূলত দাম বেশি। তবে মাঝেমধ্যে সাগরের ইলিশের সরবরাহ বেড়ে গেলে তখন দাম কিছুটা কমে আসে। এবার তা হয়নি।
মোবারক হোসেন বলেন, ‘ভারতে রফতানির বিষয়টি প্রচার হওয়ার পর সাগরের ইলিশের দাম বেড়েছে। কিন্তু নদীর ইলিশের দাম বাড়েনি। কারণ আমাদের মোকামে যে পরিমাণ ইলিশ আসছে, সেখান থেকে রফতানি করার মতো নেই। আমরা নিশ্চিত করে বলছি, গত দুই মাস ধরে একই দামে মাছ বিক্রি করছি।’
জহির সিকদার বলেন, ‘এবার সাগরের ইলিশ আমাদের আড়তে না আসায় কর্মচারীদের বেতন দিয়ে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। পোর্ট রোড মোকামের বেশিরভাগ আড়তদার যেসব এলাকায় সাগরের মাছ উঠছে, সেখানে নতুন ব্যবসা বসিয়েছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ আড়তদার মহিপুর থেকে সাগরের ইলিশ কিনছেন। বরিশাল মোকামের লোকসান মহিপুর থেকে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে আমার সেখানে মোকাম নেই।’
নগরীর বাংলা বাজারের মাছ বিক্রেতা হেমায়েত উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বরিশালের আড়তে সাগরের মাছ আসা বন্ধ হয়েছে অনেক দিন হলো। এখন নদীর ইলিশ আসে। সেখান থেকে পাইকারি কিনে আমরা বাজারে এনে খুচরায় বিক্রি করছি। তবে বড় ইলিশের দাম বেশি হওয়ায় বিক্রি কম হয়। এ কারণে জাটকাসহ ছোট সাইজের ইলিশ এনে তা বিক্রি করি। তবে এবার বাজারে ইলিশের সংকট মনে হচ্ছে।’
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বাংলা বাজারে প্রতি কেজি জাটকা বিক্রি হয়েছে ৫৫০ টাকা কেজি দরে। ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের বিক্রি হয়েছে এক হাজার ২০০ টাকা কেজিতে। এক কেজি বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি ওজনের মাছ বিক্রি হলো ১৮০০-১৯০০ টাকায়। সোয়া কেজি ও তার চেয়ে কিছুটা বেশি ওজনের মাছ বিক্রি হয়েছে ২০০০ থেকে ২২০০ টাকা কেজি দরে। এসব মাছ পোর্ট রোড আড়ত থেকে এনে বিক্রি করছেন এই বাজারের ব্যবসায়ীরা। এজন্য পোর্ট রোড থেকে কিছুটা দাম বেশি বলে জানালেন হেমায়েত উদ্দিন।
একই দিন পোর্ট রোড ইলিশ মোকামে জাটকা ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকা কেজি দরে। তার চেয়ে একটু বড় সাইজের ইলিশ বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৪০০-৫০০ এবং এক কেজি ওজনের বিক্রি হচ্ছে ১৭০০-১৮০০ টাকায়।
নগরীর সাগরদী বাজারের খুচরা মাছ বিক্রেতা মো. জুনায়েদ হোসেন বলেন, ‘এক কেজির ইলিশ বিক্রি করতে হয় ১৭০০-১৮০০ টাকায়। এত দাম দিয়ে কিনতে চান না ক্রেতারা। তা ছাড়া দাম বেশি হওয়ার কারণে বড় সাইজের ইলিশের ক্রেতা কম। বড় ইলিশ আনলে আমরা বিক্রি করতে পারি না। তাতে বরফ দিয়ে রাখলে খরচ বেড়ে যায়। এজন্য ছোট সাইজের কিংবা ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের মাছ এনে বিক্রি করছি।’
এবার নদীতে মাছ কম ধরা পড়ার কথা জানিয়েছেন ভোলার মেঘনা নদীতে মাছধরা জেলে মো. আশরাফুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেসব আড়তে ভালো দাম পাওয়া যায় সেখানেই আমরা ইলিশ বিক্রি করি। অনেক আড়তে ৪০ কেজিতে মণ ধরা হলেও বরিশাল মোকামে ৪৩ কেজিতে ধরা হয় মণ। এমনকি আড়তে মাছের পরিমাপ করতে মণপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা গুনতে হয়। এসব কারণে বরিশাল মোকাম থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছি আমরা। তবে যেসব জেলে দাদন নিয়েছেন তারা বরিশাল মোকামে মাছ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তারপরও তারা সুযোগ পেলে কিছু ইলিশ নদীতে বসেই বিক্রি করে দেন। বরিশাল মোকামে ইলিশ টানতে হলে জেলেদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।’
নগরীর পোর্ট রোড ইলিশ মোকামে মাছ কিনতে আসা আবু জাফর বলেন, ‘নদীর মিঠা পানির ইলিশের চাহিদা আছে। তবে দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। তারপরও বাধ্য হয়ে বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে আমাদের। ইলিশের দাম আরও কমলে আমাদের জন্য ভালো হতো।’