গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে কতজন নিখোঁজ, কোথায় তারা?
বাংলাদেশ

গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে কতজন নিখোঁজ, কোথায় তারা?

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজদের সন্ধান মেলেনি দেড় মাসেও। পুড়ে যাওয়া ভবন ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে ফায়ার সার্ভিস, প্রশাসন ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) টিম উদ্ধারকাজ বন্ধ রেখেছে। এর মধ্যে নিখোঁজদের স্বজনরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে প্রবেশ করে বেশ কয়েকটি হাড়গোড় উদ্ধার করেন। তবে এরপর কোনও উদ্ধার তৎপরতা দেখা যায়নি। এমনকি নিখোঁজদের খোঁজে এখন কারখানার ফটকে এসে স্বজনদের ভিড় করতেও দেখা যাচ্ছে না। আবার নিখোঁজ ব্যক্তিরা কারখানার শ্রমিক নন। ফলে দাবি খাটিয়ে কিছু করতেও পারছেন না। এ অবস্থায় নীরবে চোখের পানি ফেলছেন স্বজনরা।

রূপসীতে অবস্থিত গাজী টায়ার কারখানা ঘুরে দেখা যায়, এর ভেতরে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু ছাই আর ছাই। টায়ারের রাবার, কাঁচামাল পুড়ে ও গলে জমাটবদ্ধ হয়ে আছে। পরিত্যক্ত অবস্থায় মেশিনের বিভিন্ন অংশ পড়ে আছে। ভবনের প্রবেশপথসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর অবস্থায় আছে। পুরো ভবনের পলেস্তারা খসে খসে পড়েছে। ফলে পুরো স্থাপনা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তবে এই ভবনে অগ্নিকাণ্ডে আসলে কতজন নিখোঁজ তা দেড় মাসেও নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি প্রশাসন।

গাজী টায়ার কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, নিরাপত্তাজনিত কারণে কারখানার ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। ভেতরে যেতে হলে জেলা প্রশাসন কিংবা কারখানার সিকিউরিটি ইনচার্জের অনুমতি নিতে হবে। কারণ এর আগে বেশ কয়েক দফায় লুটপাট হয়েছে। এজন্য এখন আর কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২৫ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টায় রূপগঞ্জের রূপসীতে গাজী টায়ার কারখানায় আগুন লাগে। দীর্ঘ ৩২ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নেভানোর কথা জানালেও ফের দফায় দফায় ভবনটিতে আগুন জ্বলে ওঠে। এ অবস্থায় কারখানাটিতে চলে লুটপাট। মূলত কারখানার মালামাল লুটপাটকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ থেকে ভবনে আগুন দেওয়া হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। 

ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে ড্রোন ক্যামেরা ও মই ব্যবহার করে কোনও লাশের আলামত পায়নি বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে। পরবর্তীতে ভবনের নিচতলায় তল্লাশি চালিয়ে কিছু পাওয়া যায়নি বলেও জানায় ফায়ার সার্ভিস। আর ভবনের চতুর্থ, পঞ্চম ও ৬ষ্ঠতলার ফ্লোর ধসে পড়ায় ‘বেশ ঝুঁকিপূর্ণ’ উল্লেখ করে উদ্ধারকাজ বন্ধ করে দেয় বুয়েট টিম। 

সর্বশেষ ১ সেপ্টেম্বর বিকালে গণশুনানি শেষে নিখোঁজ ৭৮ জনের তালিকা সংগ্রহ করেছিল জেলা প্রশাসনের তদন্ত টিম। ওই দিন বিকালে নিখোঁজদের স্বজনরা আগুনে পুড়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ঢুকে মাথার খুলি ও হাড়ের টুকরো পেয়েছেন বলে জানান। উদ্ধার হওয়া হাড়গুলো পুলিশের কাছে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু ওই ৭৮ জনের বিষয়েও এখন পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছুই জানানো হয়নি।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার কারখানা

স্বজনদের দাবি অনুযায়ী, শুরুতে ১৭৪ জন নিখোঁজের তালিকা করেছিল ফায়ার সার্ভিস। পরে নিখোঁজের তালিকা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হলে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা আবার নতুন করে ১৩১ জনের তালিকা করে। এরপর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম গঠন করা হয়। সেখানে নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করে একটি তালিকা করা হবে বলে জানায় তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও ১০ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিবেদন দেয়নি কমিটি। এমনকি এ ঘটনায় ঠিক কতজন নিখোঁজ, তাও জানানো হয়নি।

নিখোঁজ আবু বকর নাঈমের মা নাজমা বেগম বরপা এলাকায় বসবাস করেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ছেলে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশোনা করতো। গাজী টায়ার কারখানা থেকে মাদ্রাসার দূরত্ব ১০ মিনিটের। আগুন লাগার একদিন পর নিখোঁজের বিষয়টি জানতে পেরেছি। ওই দিন মাদ্রাসার শিক্ষকরা আমাকে ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। অগ্নিকাণ্ডের দিন আমার ছেলেসহ মাদ্রাসার আরেক ছাত্র এশার নামাজের পর রাত ৯টার দিকে কারখানার দিকে যায়। এরপর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবু বকরের এখনও খোঁজ পাইনি। পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি, ফেসবুকে দিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। আমার ছেলে হয়তো সেখানে পুড়ে মারা গেছে।’

কারও পক্ষ থেকে আর্থিক কোনও সহায়তা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা কোনও ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি। আমার ছেলের লাশ বা কোনও চিহ্ন পাইনি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নামের তালিকা করা হয়েছে। এরপর আর কিছু জানায়নি। ঘটনার প্রথম দিকে গাজী টায়ার কারখানার সামনে নিখোঁজের স্বজনরা ভিড় করতো। তবে এখন কেউ কারখানার সামনে যায় না। সেখানে গিয়ে কী করবো। কতদিন ঘুরবো। মাঝেমধ্যে কারখানার সামনে যাই, দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসি।’ 

একই ঘটনায় নিখোঁজ রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার মো. মাসুদের চাচাতো ভাই হাসিবুর রহমান বলেন, ‘মাসুদের বাবা নেই। মা আছে। মাসুদ অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাতো। ঘটনার দিন গাজী টায়ার কারখানায় লুটপাট হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখার জন্য আশপাশের কয়েকজন লোক তাকে নিয়ে সেখানে যায়। পরে কীভাবে সে কারখানার ভেতরে ঢুকেছে, তা জানা নেই আমাদের। এরপর অগ্নিকাণ্ড ঘটে। তবে ওই সময় কারখানার ভেতরে মালামাল ছিল না। আগের দফায় মালামাল সব লুট হয়ে গিয়েছিল।’

নিখোঁজ মাসুদ বাড়ি ফিরবে এই আশায় এখনও অপেক্ষায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসন নিখোঁজের তালিকা করে বলেছিল, সন্ধান পেলে আমাদের জানাবে। আমরা এখনও সে আশায় আছি। যদি বেঁচে থাকে বাড়ি ফিরে আসবে। এখন আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করছি। নীরব হয়ে গিয়েছি আমরা। ওই কারখানার গেটের সামনে যাওয়া হয় না। তবে কারখানার কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেও পারছি না। কারণ সেখানে অনেকে লুটপাট করেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সুযোগ নেই।’ 

নিখোঁজ রূপগঞ্জের রূপসীর আব্দুর রহমানের বড় ভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার ছোট ভাই তাঁতের কারিগর ছিল। ঘটনার দিন রাতে বন্ধুদের সঙ্গে কারখানায় গিয়েছিল। তবে লুটপাট করেনি। এরপর থেকে ভাইয়ের খোঁজ পাচ্ছি না। কারখানার ভেতরে কিছু নেই। সব পুড়ে ছাই। এখন নীরবে কাঁদা ছাড়া উপায় নেই।’

গাজী টায়ার কারখানায় গিয়ে কোনও লাভ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কারখানার সামনে গিয়ে কোনও লাভ হয় না। আমার ভাই সেখানে কাজ করতো না। লাশ পেলে অন্তত বলা যেতো। কিন্তু কিছুই তো পাইনি।’ 

উদ্ধার তৎপরতা শেষে কারখানার বর্তমান অবস্থা

নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে জানতে চাইলে গাজী টায়ারের নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে ফায়ার সার্ভিস, প্রশাসন ও বুয়েট টিমের কেউ কিছু পেলো না। অথচ কোথা থেকে কয়েকজন লোকজন এসে বললো কিছু হাড়গোড় পেয়ে গেলো। এগুলো আদৌ এখানকার কিনা, কিংবা এগুলো মানুষের হাড় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ ছাড়া এত মানুষ পুড়ে গেলে এক ধরনের পোড়া গন্ধ বেরিয়ে আসবে। তেমনটা এখানে হয়নি। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন ধরনের তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের কাছে দেওয়া হয়নি। আর ভবনটির ইনস্যুরেন্স করা আছে, এটা বললেই ভেঙে ফেলা যাবে না। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের অনুমতি লাগবে।’ 

কারখানার ভেতরে লুটপাট বন্ধ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঘটনার শুরু থেকে কারখানায় প্রচুর লুটপাট হয়েছে। বেশ কয়েকটি চক্র বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করেছিল আর ভেতরে আরেকটি সহযোগী পক্ষ লুটপাট করেছিল। লুটপাট শেষে আরেকটি পক্ষ কম দামে নানা জিনিসপত্র কিনে নিয়ে চলে যায়। এখন নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। ফলে লুটপাট বন্ধ হয়েছে। তবে ভবনে এখন কিছুই নেই।’

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর হুসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান হামিদুর রহমান বদলি হয়ে চলে গেছেন। এটা যেহেতু আমি দেখভাল করিনি, সেহেতু বিস্তারিত জানি না। আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। সে কারণে এ বিষয়ে আমার কাছে বিস্তারিত কোনও তথ্য নেই।’ 

একই বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘এখনও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন হাতে পাইনি। প্রতিবেদন পেলে নিশ্চিত করে বলা যাবে ঠিক কতজন নিখোঁজ আছে।’

Source link

Related posts

বিমানের বিশেষ ফ্লাইট বাতিল, শাহজালাল বিমানবন্দরে সৌদিগামী অভিবাসীদের বিক্ষোভ

News Desk

ঢাকার সমাবেশ থেকে সরকার পতনের কর্মসূচি ঘোষণা: ড. মোশাররফ

News Desk

সড়ক সম্প্রসারণকাজে ৩৪৩ গাছের মৃত্যু, জনমনে ক্ষোভ

News Desk

Leave a Comment