কৃষকের কষ্টে উৎপাদিত সবজি স্থানীয় পর্যায়ে দাম কম হলেও বাজারে পৌঁছাতে কয়েক গুণ বেড়ে যায়। কৃষকের কাছ থেকে কয়েক হাতবদল হয়ে ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে দাম দ্বিগুণ-তিন গুণ হয়ে যাচ্ছে। যশোরের কৃষক, পাইকারি বিক্রেতা, আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
যশোরের বড় বাজারে রবিবার (২০ অক্টোবর) সকালে মুলার কেজি ৪০, বেগুন ১২০, কাঁচা কলার কেজি ৬০, পটল ৫০, লাউয়ের পিস ৫০-৬০, কচুরমুখি ৮০, করলা ৮০, কাঁকরোল ৮০, পেঁপে ৪০, শসা ৬০, ঢ্যাঁড়স ৬০ ও শিম ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একই সবজি সাতমাইল বারীনগর হাটে কৃষকরা বিক্রি করছেন অর্ধেক দামে। এই হাটে কৃষকদের কাছ থেকে মুলার কেজি ২৫, বেগুন ৬০, কাঁচা কলার কেজি ৪০, পটল ৩০, লাউয়ের পিস ২৮-৩০, কচুরমুখি ৪০, করলা ৪০, কাঁকরোল ৪০, পেঁপে ২০, শসা ৩০, ঢ্যাঁড়স ৩০ ও শিম ৭০-৭৫ টাকায় কিনছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এখান থেকে বড় বাজারে আসতেই দাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
অথচ যশোর শহর থেকে সাতমাইল বারীনগরের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। মাত্র এতটুকু দূরত্বে সবজির দাম হয়ে যাওয়াকে বাজার সিন্ডিকেটের কারণ বলছেন কৃষকরা। যশোরের সাতমাইল-বারীনগর হাট খুলনা বিভাগের বৃহৎ পাইকারি সবজি বাজার। সপ্তাহে দুদিন রবিবার ও বৃহস্পতিবার হাটবার হলেও এখন প্রতিদিন বসছে।
কেন এই দাম বৃদ্ধি, এই প্রশ্নের জবাবে কৃষকরা বলছেন, বাজার সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা ন্যায্য দাম না পেলেও এজেন্ট ও স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ী এবং আড়তদারা দ্বিগুণ দামে সবজি বিক্রি করছেন।
তবে আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে এ বছর আগাম শীতকালীন সবজির ক্ষেত কয়েক দফায় নষ্ট হয়েছে। সে কারণে উৎপাদন কম হওয়ায় সরবরাহ কমেছে, আর সরবরাহ কম থাকায় বাজারে দাম বেড়েছে সব ধরনের সবজির।
আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্যান্য বছর এই সময়ে হাটবারের দিনে ৯০-১০০টি ট্রাকে সবজি পাঠানো হতো। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় যেতো ওসব সবজির ট্রাক। এ বছর সবজির সরবরাহ কমে গেছে। সে কারণে বাইরে পাঠানোর পরিমাণও কমেছে। রবিবার বিকাল পর্যন্ত ৫০ ট্রাক সবজি পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। প্রতিদিন ১০ ট্রাক কমবেশি হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় এবার কৃষক পর্যায়ে সবজির দামও বেড়েছে। এজন্য দাম বেশি।
যশোর সদরের চূড়ামনকাটি ইউনিয়নের চূড়ামনকাটি ও হৈবতপুর ইউনিয়নের হৈবতপুরের বিভিন্ন কৃষি মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, যেসব ক্ষেতে সবজি থাকার কথা সেখানে ফলন নেই। যেসব ক্ষেতে আছে সেগুলোতেও অনেক কম। চাষিরা বলছেন, বেশ কয়েক দফা টানা বৃষ্টির কারণে সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। এতে খরচ ওঠাতেই হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকরা।
চূড়ামনকাটি এলাকার সবজি চাষি সহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দফায় দফায় বৃষ্টির কারণে আমাদের শীতকালীন আগাম ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সবজি ক্ষেত পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। এ বছর তিনবার একই সবজির চারা লাগিয়েছি, প্রত্যেকবার বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে। কৃষকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এ বছর আর সেই ক্ষতি পূরণ সম্ভব নয়। এরপরও বাজারে গিয়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়।’
একই এলাকার কৃষক রায়হান বাবু বলেন, ‘ছয় কাঠা জমিতে বেগুন লাগিয়েছিলাম। লাগাতার বৃষ্টির আগে কয়েক দফা বেগুন তুলেছি। দুদিন পর পর উঠানো যেতো। কিন্তু বৃষ্টির পর সেই গাছে এখন আর এক কেজিও পাওয়া যাচ্ছে না। এক বিঘা জমিতে মুলা লাগিয়েছিলাম ৩০ হাজার টাকা খরচ করে। এখন ১০ হাজার টাকা তুলতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে। আগে ভ্যানে মাল নিয়ে হাটে যেতাম, এখন ব্যাগে নিয়ে যাই।’
হৈবতপুর গ্রামের কৃষক রমজান আলী বলেন, ‘এ বছর শীতকালীন আগাম সবজি করে তিন লাখ টাকা আয়ের টার্গেট ছিল। কিন্তু একাধারে বৃষ্টিতে প্রথম দফায় সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। এরপর দুই বিঘা জমিতে লাগাই মুলা। একটা টাকার বিক্রি করতে পারিনি। মুলা ক্ষেতে প্রথমবারেই লাগে ২৫ হাজার টাকার বেশি। এ ছাড়া কীটনাশক, সার মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার টাকা বিঘায় খরচ হয়েছে। এক মুলার বীজ দুবার রোপণ করে অনেক বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছি। এরপর যখন বাজারে সবজি নিয়ে যাই, তখন ৫০ কেজিতে মণ হিসেবে বিক্রি করতে হয়। কেজিতে দাম পড়ে ২৫-৩০ টাকা। অথচ ২৫ টাকার সেই মুলা বাজারে ৬০ টাকায় বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। অথচ কষ্ট করে সবজি চাষ করে চালানও তুলতে পারছি না আমরা।’
বড় হৈবতপুর গ্রামের কৃষক নূর মোহাম্মদ, একই এলাকার আক্তারুল ইসলাম ও পোলতাডাঙ্গা গ্রামের শফিুল ইসলাম জানান, হাটে পটল বিক্রি করেছেন পটল করছেন ৩০ টাকা কেজি দরে। পরে শুনি, শহরের বাজারে ৬০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। আর ঢাকায় ৮০-১০০ টাকায়। আমাদের বিক্রির সঙ্গে বাজারের দামের বিশাল ফারাক।
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা হাটে গিয়ে সরাসরি বাইরের ব্যাপারীদের কাছে সবজি বিক্রি করতে পারছি না। স্থানীয় পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে কেনেন অল্প দামে। এরপর তারা জায়গায় কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন। আমাদের সবজির মণপ্রতি ৪-৫ কেজি বেশি দিতে হয়। আসলে আমরা পদে পদে ঠকছি। যদি সিন্ডিকেট না থাকতো তাহলে আমরা সরাসরি ঢাকা-চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে দামাদামি করে বিক্রি করতে পারতাম। এতে আমরা একটু লাভবান হলেও কম দামে সবজি পেতেন ক্রেতারা।’
তবে কৃষকদের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বারীনগর হাটের ইজারাদার ও সবজি ব্যবসায়ী আব্দুস সোবহান। তিনি দাবি করেন, ‘সিন্ডিকেটের বিষয়টি একেবারেই ভিত্তিহীন। এই হাটে বাইরের জেলা থেকে ব্যাপারীরা আসছেন। কিন্তু এবারের মৌসুমে হাটে অল্প সবজি উঠায় তারাও কম আসছেন।’
তিনি বলেন, ‘এবার মৌসুমের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিতে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ সবজি ক্ষেত বিনষ্ট হয়েছে। যেহেতু উৎপাদন কম, সে কারণে হাটে সবজি উঠছেও কম। আর চাহিদা বেশি থাকায় দামও বেশি। আসলে শ্রমিক ও পরিবহন খরচের কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে।’
এবার সবজি উৎপাদন ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের উপপরিচালক আবু তালহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত তিন বছরের মধ্যে এবার যশোরে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। জুলাই মাসের শেষ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কয়েক দফা বৃষ্টি হয়েছে। অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখেও ব্যাপক বৃষ্টি হয়। সে কারণে জেলায় আগাম শীতকালীন সবজি চাষে বেশ ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে কৃষকরা বসে নেই। সরকারও তাদের দুই দফায় প্রণোদনা দিয়েছে। প্রথম দফায় পাঁচ হাজার ও দ্বিতীয় দফায় ১০ হাজার কৃষককে সরকার শাকসবজির বীজ, সার ও নগদ টাকা প্রণোদনা দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শাকসবজির ক্ষেত একটু উঁচু জমিতে চাষ হয়। সেক্ষেত্রে যদি পানি নেমে যায় এবং বিপর্যয় আর না হয়, তাহলে আসছে শীত মৌসুমে কৃষকরা ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবেন।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এবার যশোরে আগাম শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে সাত হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। শীতকালীন সবজি চাষ হচ্ছে ২০ হাজার হেক্টর জমিতে। তবে গত বছর শীতকালীন সবজি ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল।