গত চার বছর ধরে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা থেকে বঞ্চিত কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলা উখিয়ার জনসাধারণ। এরফলে বেসরকারি সেবা নিয়ে গুণতে হচ্ছে বেশি অর্থ। আর যাদের সামর্থ নেই, তাদের পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। বিশেষ করে সময় মতো হাসপাতালে রোগী পৌঁছাতে না পেরে জরুরি চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। এমনকি এ কারণে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চালু ছিল নাগরিক এই সেবা। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও সংকট নিরসনে নেওয়া হয়নি কোনও উদ্যোগ। সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি আরব সরকারের অনুদানে (সৌদিগ্রান্ট) দেওয়া একটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সেবা দেওয়া হচ্ছিল উখিয়ার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালে। তবে অ্যাম্বুলেন্সটি অচল হয়ে পড়লে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর তুরস্ক সরকারের সহায়তায় আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার দেওয়া অ্যাম্বুলেন্স হস্তান্তর করা হয় এখানে। এছাড়াও জাতিসংঘের জনসংখ্যা সহায়তা তহবিল (ইউএনএফপিএ) থেকে দেওয়া আরেকটি অ্যাম্বুলেন্সও বরাদ্দ ছিল সেবা দেওয়ার জন্য।
বর্তমানে তিনটি অ্যাম্বুলেন্সই অকেজো। মেরামত না করে চার বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আঙ্গিনায়। অভিযোগ আছে, সরকারি নাগরিক সেবায় স্থবিরতা এনে তৈরি করা হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেলথ সেক্টরে কর্মরত এনজিওগুলোর সহায়তায় রেফারেল সিস্টেমের মাধ্যমে রোগীদের নামসর্বস্ব সেবা দেওয়ার অজুহাত।
সঠিক সময়ে অ্যাম্বুলেন্স সেবা না পেয়ে প্রতিনিয়ত বিপাকে পড়তে হয় রোগীদের, জরুরি চিকিৎসা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। ২০২৩ সালের ১৯ মার্চ, রাজাপালং ইউপির টাইপালং গ্রামের বাসিন্দা নুর জাহান বেগম (৭০) অসুস্থ হয়ে পড়লে উখিয়া হাসপাতালে নিয়ে যায় তার পরিবার। কর্তব্যরত চিকিৎসক নুর জাহানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে প্রেরণ (রেফার্ড) করেন। সেখানে নিতে তার ছেলে হাজী ছালামত উল্লাহ অ্যাম্বুলেন্স সেবা চান। কিন্তু চিকিৎসক তখন জানিয়ে দেন সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালু নেই, এনজিও থেকে সেবা নিতে হবে। মায়ের অবস্থা অবনতি হতে থাকায় উপায় না পেয়ে দেড় হাজার টাকার স্থলে ৩ হাজার টাকা ভাড়া চুক্তিতে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে কক্সবাজার রওনা দেন ছেলে। পথিমধ্যে নুর জাহান মৃত্যুবরণ করেন।
সরকারি তিনটি অ্যাম্বুলেন্স থাকা সত্ত্বেও কেন সেগুলো অচল- এমন প্রশ্ন তুলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা-সহ কর্মরত তিন জনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার দায়ে সিভিল সার্জন বরাবর অভিযোগ দেন মাকে হারিয়ে শোকাহত হাজী ছালামত উল্লাহ। পরে সেই অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হলেও দোষীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনও ব্যবস্থা। এমনকি এই ঘটনার দেড় বছর অতিক্রান্তের পরও চালু করা হয়নি অ্যাম্বুলেন্স সেবা।
অভিযোগকারী হাজী ছালামত উল্লাহ বলেন, ‘একজন নাগরিক হিসেবে অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাওয়া সবার অধিকার। আমরা উখিয়ার মানুষ সেই সেবা থেকে বঞ্চিত। আমি মাকে হারিয়েছি। তদন্ত হলেও সুরাহা পাইনি। কারণ অ্যাম্বুলেন্সকে ঘিরে উখিয়া হাসপাতালে হরিলুট চলে এবং যার ভাগ সিভিল সার্জন অফিসেও পৌঁছে বলে জেনেছি।’
এদিকে সম্প্রতি আঙ্গিনায় ফেলে রাখা অ্যাম্বুলেন্সগুলোর মধ্যে একটি টেকনাফ ও আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেওয়া হয়েছে বলে কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। তৃতীয় অ্যাম্বুলেন্সটি উখিয়ায় রাখা হলেও চালক না থাকায় চালু করা হয়নি এবং আদৌ কবে চালু হবে সেটির উত্তর মেলেনি। আগে যে চালক ছিলেন, তার বদলির পেছনেও ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চালকের ওভারটাইম মজুরি লোপাটের অভিযোগ
২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্স চালকের দায়িত্ব পালন করেছেন আমিনুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে মহেশখালীতে কর্মরত। আমিনুল ইসলামের কাছে মিললো অ্যাম্বুলেন্সের বদৌলতে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অর্থ লোপাটের অভিযোগ।
উখিয়ায় থাকাকালীন এল-থ্রি হান্ড্রেড মডেলের একটি অ্যাম্বুলেন্স চালাতেন আমিনুল। তার অভিযোগ, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মেরামতের নামে ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে তাকে দিয়ে জোর করে সই করিয়ে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী ফরিদুল আলম। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সময়ে আমিনুলকে বঞ্চিত করা হয়েছে তার প্রাপ্য ওভারটাইমের মজুরি বাবদ প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা থেকেও। ২০২০-২১ অর্থবছরে তার ওভারটাইমের মজুরি সুকৌশলে সই জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সাত-আট বার আমি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার রনজন স্যারের কাছে আমার ওভারটাইমের মজুরি বিষয়ে গিয়েছি। উনি আমাকে বিল পাস হয়নি বলে ফেরত দিয়েছেন। অথচ আমি উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে খোঁজ নিয়ে তখন জেনেছিলাম বিলটি পাস হয়েছে।’
আমিনুল আরও বলেন, ‘যেখানে যেতে হয় আমি সেখানে গিয়েই বলবো, আমার টাকা অফিস সহকারী ফরিদসহ সংশ্লিষ্ট অন্যরা মেরে খেয়েছে।’ প্রাপ্য টাকা চাওয়ায় ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় তাকে উখিয়া থেকে মাস কয়েকের মধ্যে বদলি করা হয় বলেও অভিযোগ আমিনুলের।
এ প্রসঙ্গে উখিয়ার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী ফরিদুল আলম অর্থ আত্মসাৎ করার বিষয় জানতে চাওয়া হলে কথা না বলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
তবে আমিনুলের করা অভিযোগ অস্বীকার করে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার রনজন বড়ুয়া রাজন বলেন, ‘অনিয়ম- দুর্নীতির বিষয়টি সত্য না। কিন্তু হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দ্রুত চালুর কারার চেষ্টা চলছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডাক্তার আসিফ হাওলাদার বলেন, ‘এনজিওর সহযোগিতায় উখিয়ার রোগীরা অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাচ্ছেন। শিগগিরই চালক নিয়োগ দেওয়া হলে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সও চালু হবে।’
অ্যাম্বুলেন্সকে কেন্দ্র করে অনিয়ম দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণের সেবক, অনিয়ম-দুর্নীতির প্রশ্নই আসে না। যদি কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী এসবে জড়িত হয়, অভিযোগ পেলে তদন্ত করে জিরো টলারেন্স নীতিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’