Image default
ইতিহাসইসলামধর্ম

বীরত্বের প্রতীক: মুসলিম বিশ্বের গর্ব সালাউদ্দিন আইয়ুবী

সালাউদ্দিন আইয়ুবী ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি শুধুমাত্র একজন সফল সেনাপতি ছিলেন না, বরং তাঁর নাম ইতিহাসে এক ন্যায়পরায়ণ শাসক, কৌশলী নেতা এবং অসাধারণ মানবিক গুণাবলীর অধিকারী হিসেবে অমর হয়ে আছে। তাঁর ন্যায়পরায়ণতা, সাহসিকতা এবং ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অদম্য ইচ্ছা তাঁকে মুসলিম বিশ্বের গর্বে পরিণত করেছে। এই নিবন্ধে আমরা সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জীবন, তাঁর বীরত্বগাঁথা এবং তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব।

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা

সালাউদ্দিন আইয়ুবীর পুরো নাম ছিল “সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব”। তিনি ১১৩৭ সালে বর্তমান ইরাকের তিকরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা নাজমুদ্দিন আইয়ুব ছিলেন তিকরিতের গভর্নর। ছোটবেলা থেকেই সালাউদ্দিনের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী ও উচ্চমানের নৈতিকতা লক্ষ্য করা যায়। ইসলামের শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি বাল্যকাল থেকেই সামরিক শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন।

সেনাপতি হিসেবে সালাউদ্দিনের উত্থান

তাঁর সামরিক জীবনের মূল শিক্ষাগুরু ছিলেন সিরিয়ার বিখ্যাত সেনাপতি নূরুদ্দিন জঙ্গি। নূরুদ্দিনের সাথে থেকে সালাউদ্দিন রণকৌশল, যুদ্ধ পরিচালনা এবং ইসলামের সেবা করার মূলনীতি শিখেন। নূরুদ্দিনের অধীনে কাজ করার সময় তিনি মিশরের ফাতিমীয় শাসন উৎখাত করে মিশরে আইয়ুবী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি নিজেকে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত করেন, যা পরবর্তী সময়ে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে সফলভাবে লড়াই করতে সক্ষম হয়।

ক্রুসেড ও জেরুজালেম পুনরুদ্ধার

তাঁর বীরত্বগাঁথার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ছিল ক্রুসেডের সময় জেরুজালেম পুনরুদ্ধার। খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা ১০৯৯ সালে জেরুজালেম দখল করেছিল এবং সেখানে মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান নাগরিকদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। ১১৮৭ সালে সালাউদ্দিন জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন। ঐতিহাসিক হত্তিনের যুদ্ধে সালাউদ্দিনের কৌশলী নেতৃত্বের সামনে ক্রুসেডার বাহিনী পরাজিত হয়।

জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে তিনি এক বিরল মানবিকতা প্রদর্শন করেন। যেখানে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা জেরুজালেমে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, সেখানে সালাউদ্দিন জেরুজালেমের খ্রিস্টানদের নিরাপত্তা প্রদান করেন এবং শহরের সমস্ত নাগরিকদের প্রতি সহনশীল আচরণ করেন। এটি তাঁকে শুধু মুসলিমদের মধ্যেই নয়, খ্রিস্টানদের কাছেও একজন ন্যায়পরায়ণ ও মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি দেয়।

১১৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রবিবার মতাবেক ৫৮৩ সনের ১৫ রজব সুলতান আইয়ুবি দ্রুত বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছে যান, অবরোধ করেন বায়তুল মুকাদ্দাস। এদিকে খৃষ্টানরাও তাদের পবিত্র ভুমি ছাড়তে নারাজ। তারাও আমরণ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। সেখানকার প্রায় সব মুসলিমই বন্দি। তারা জেলের ভিতর থেকেই আজান আর তাকবীর ধ্বনি দিচ্ছেন। অনুরূপ খৃষ্টানরাও গির্জায় গান গাইছে ও প্রার্থনা করছে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। দুই পক্ষই দুই পক্ষকে আহত নিহত করে চলছে। শহিদদের সংখ্যা জেনে সুলতান অবাক হন। পরে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ৫৮৩ হিজরীর ২৭ রজব মোতাবেক ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ ২ অক্টোবর শুক্রবার সালাহুদ্দীন আইয়ুবি বিজয়ী বেশে বায়তুল মুকাদ্দাস প্রবেশ করেন। এটিই ছিল সেই রাত যেদিন আমাদের প্রিয় নবী রাসুল (সাঃ) বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মিরাজে গমন করেন। বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত হয়ার পর সেখানকার মুসলিমরা প্রায় ৯০ বছর পর ক্রুসেডারদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেল।

ইংল্যান্ডের সম্রাট রিচার্ড যাকে ”ব্লাক প্রিন্স” বলা হত সে এর প্রতিশোধ নিতে ৫২০ যুদ্ধ জাহাজ ও অনেকগুলো মালবাহী বড় জাহাজ নিজে রোম সাগর আসে। তখনই ঝড়ের কবলে পরে প্রায় অনেক জাহাজ তলিয়ে যায়। যা বাকি থাকে তা দিয়েই সে বায়তুল মুকাদ্দাস আবার দখল করতে আসে। তখন তার সৈন্য ছিল ২ লাখ।

সুলতান চাচ্ছিলেন তারা যেন আগে উপকূলীয় অঞ্চল আক্রা অবরোধ করে, এতে করে তাদের সেখানেই ব্যস্ত রেখে শেষ করে দিতে পারলে বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষা করা যাবে।

রিচার্ড যখন আক্রা আগমন করে তারও আগেই তার জোটভুক্ত রাষ্ট্ররা আক্রা অবরোধ করে। রক্ত ক্ষয়ী ও দীর্ঘ যুদ্ধের পর সকলে মিলে প্রায় ৬ লাখেরও বেশি সৈন্য নিয়ে আক্রা দখল করে নেয়। এতে তারা দখলের পর আক্রার প্রায় ৩ হাজার নিরস্ত্র মুসলিমের হাত পা বেধে পিচাশের মত ঝাপিয়ে পরে হত্যা করে।

রিচার্ড আক্রা দখলের পর উপকূলীয় বাকি অঞ্চল আসকালান ও হিফা দখল করতে যায়, যেন সেগুলোকে দখল করে ক্যাম্প বানিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করা সম্ভব হয়। কিন্ত তারা যেন সেটা করতে না পারে তার জন্য সুলতান আইয়ুবি আগেই সেখান থেকে জনগনকে সরিয়ে সেগুলোকে পুড়িয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন। পরে ক্রুসেডাররা সেখানে যেয়ে আর কিছু পায় নি। শেষে একসময় রিচার্ড অসুস্থ হয়ে পড়লে সে যুদ্ধ ত্যাগ করে নিজ দেশে চলে যায়, আর বলে যায় সে আবার আসবে বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করতে। কিন্তু পরে আর কেউ পারেনি বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করতে।

কিন্তু না, ইসলামিক খিলাফতের শেষের দিকে যখন মুসলিম আমিররা ক্রুসেডারদের সাথে বন্ধুত্বের কথা বলে মূলত তাদের দাসত্বকে গ্রহণ করল। তখনই ক্রুসেডাররা আবারো তুচ্ছ ও সংকীর্ণমনা জাতীয়তাবাদের নীতিতে ইসলামিক রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে দিল। আবারো ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিনে ইহুদীদের প্রবেশের মাধ্যমে মূলত নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করল। সেখানে মুসলিমদের হত্যা করল, তাদের নিজ ভুমি থেকে ছাড়া করল, গঠন করল সেখানে ইসরাইল রাষ্ট্র, আর সেটা কতিপয় নামধারি মুসলিম শাসকদের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।

১১৯৩ সালের ৪ মার্চে অবশেষে ইসলামের মহান নেতা সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবি ইন্তিকাল করেন। সেদিন সমগ্র ফিলিস্তিনের নারী-পুরুষ তাদের ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে তাদের সুলতানের জন্য মাতম করছিল (যদিও মাতম করা ঠিক নয়)। নগরীর অলিতে-গলিতে কান্নার রোল বয়ে যাচ্ছিল। আজও সেই কান্নার রোল শোনা যায় সেই ফিলিস্তিনের অলিতে গলিতে আজও তারা তাদের সেই সালাহুদ্দীন আইয়ুবিকেই খুজছে ক্রুসেডারদের অত্যাচার থেকে তাদের মুক্তির জন্য।

কৌশলী সামরিক নেতা ও ন্যায়পরায়ণ শাসক

সালাউদ্দিন ছিলেন অসাধারণ রণকৌশলের অধিকারী। তিনি সামরিক ক্ষেত্রে তাঁর দূরদর্শিতা, কৌশল এবং শত্রুর মনোবল ভেঙে ফেলার কৌশলগত দক্ষতায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। তিনি যুদ্ধে সাহসিকতা এবং দানশীলতা দেখিয়ে শত্রুপক্ষের মনেও সম্মান অর্জন করেন।

তাঁর শাসনকালে সালাউদ্দিন মুসলিম জনগণের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর শাসিত অঞ্চলে শৃঙ্খলা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করেন। তিনি কর ব্যবস্থা সহজ করেন, বিচার প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেন এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজ করেন।

মানবিকতা ও দানশীলতার উদাহরণ

সালাউদ্দিন আইয়ুবী তাঁর মানবিক গুণাবলীর জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। যুদ্ধের সময় আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করানো, যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন এবং শত্রু পক্ষের সাধারণ জনগণের প্রতি সদয় আচরণ তাঁর চরিত্রের উজ্জ্বল দিক। তিনি এমনকি ক্রুসেডের শীর্ষ নেতাদের প্রতি দানশীলতা প্রদর্শন করেছেন। অসুস্থ ক্রুসেডার রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্টের চিকিৎসার জন্য নিজ চিকিৎসক পাঠানো এবং তাঁকে নিজের ঘোড়া দান করা তাঁর মহত্বের পরিচয় বহন করে।

ইসলামের সেবা ও নৈতিক শিক্ষা

সালাউদ্দিন শুধু সামরিক শক্তি ও নেতৃত্বগুণেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; বরং তিনি ইসলামের নৈতিক শিক্ষা, দানশীলতা, এবং আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যের উদাহরণ ছিলেন। তিনি তাঁর জীবনে ইসলামের মূলনীতিগুলো অনুসরণ করতেন এবং মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করতে সদা সক্রিয় ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে শক্তি ও ক্ষমতা আল্লাহর অনুগ্রহ এবং সেই শক্তি মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা উচিত।

সালাউদ্দিনের মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

১১৯৩ সালে সালাউদ্দিন মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে মুসলিম বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর ন্যায়পরায়ণতা, সাহসিকতা এবং বীরত্ব স্মরণীয় হয়ে থাকে। সালাউদ্দিনের জীবন ও কাজ ইসলামের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে।

 

সালাউদ্দিন আইয়ুবী কেবল একজন বীর সেনাপতি ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন ইসলামের সেবক, ন্যায়পরায়ণ শাসক এবং অসাধারণ মানবিক গুণাবলীর অধিকারী। তাঁর জীবন আমাদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতা ও নৈতিক গুণাবলী একসঙ্গে মানবজাতির কল্যাণে কাজে লাগানো যায়। সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জীবনগাঁথা মুসলিম বিশ্বে এক চিরন্তন গর্বের প্রতীক, এবং তিনি আজও আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।

Related posts

খন্দকের যুদ্ধের অমর ইতিহাসে

News Desk

বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য রিসার্চ সেন্টার তৈরি করেছে গুগল

News Desk

একাত্তরের জন্মদিনে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি

News Desk

Leave a Comment