আমাদের সংস্কৃতিতে সরস্বতী পূজা এবং এর কিছু প্রথা গভীর ধর্মীয় ভাবধারার সাথে মিশে রয়েছে। তেমনি একটি প্রথা হলো সরস্বতী পূজার আগে কুল না খাওয়া। এই প্রথার পেছনে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনি এবং স্বাস্থ্যগত কারণ। এছাড়াও বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশনাও এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসুন, সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া নিষিদ্ধের কারণ নিয়ে বিশদে আলোচনা করি।
পৌরাণিক কাহিনি এবং সরস্বতী পূজার কাহিনি:
অনেক পৌরাণিক কাহিনির মতে, মহামুনি ব্যাসদেব সরস্বতী দেবীকে তুষ্ট করতে উত্তরাখণ্ডের বদ্রিকাশ্রমে তপস্যায় বসেন। সরস্বতী দেবী ব্যাসদেবের তপস্যা স্থলে একটি কুলবীজ রাখেন এবং তাঁকে একটি শর্ত দেন। শর্তটি ছিল, সেই কুলবীজটি ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়ে চারা, তারপর বৃক্ষে পরিণত হবে এবং শেষে ফুল ও ফল ধরবে। একদিন যখন সেই কুল পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পড়বে, তখনই সরস্বতী দেবী তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হবেন।
এই দীর্ঘ অপেক্ষার মধ্য দিয়ে ব্যাসদেবের তপস্যা চলতে থাকে এবং সেই সময়টি কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে। একদিন সেই কুল পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পড়লে তিনি বুঝতে পারেন যে সরস্বতী দেবী তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। এই দিনটি ছিল ‘পঞ্চমী’, যা এখন বিদ্যাদেবী সরস্বতীর পূজার দিন হিসেবে পালিত হয়।
পঞ্চমী দিবসে কুল নিবেদন
পৌরাণিক মতে, ব্যাসদেব সেদিন সরস্বতী দেবীকে কুল ফল নিবেদন করে তাঁর অর্চনা করেন এবং পরে তিনি ব্রহ্মসূত্র রচনা করেন। এই দিনটিকে ‘শ্রীপঞ্চমী’ বা ‘সরস্বতী পূজা’র দিন হিসেবে স্মরণ করা হয়, এবং সেই থেকেই ঐতিহ্য অনুযায়ী পঞ্চমী দিবসেই প্রথম কুল ফল আহার করা হয়। সরস্বতী পূজার আগে কুল না খাওয়ার এই প্রথাটি এমনভাবে প্রচলিত হয় যে, সেই সময় পর্যন্ত এটি একটি অঙ্গীকৃত সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
স্বাস্থ্যগত কারণ
এছাড়া, সরস্বতী পূজার আগে কুল না খাওয়ার একটি স্বাস্থ্যগত কারণও রয়েছে। মাঘ মাসের প্রথম দিকগুলোতে কুল ফল অনেক ক্ষেত্রে কাঁচা বা কষযুক্ত থাকে। কাঁচা বা আধা-পাকা কুল খেলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। মাঘ মাসের শেষের দিকে বা ফাল্গুন মাসে কুল পুরোপুরি পেকে যায় এবং তা খাওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। সুতরাং, সরস্বতী পূজার আগে কুল না খাওয়ার মাধ্যমে শারীরিক স্বাস্থ্যও রক্ষা করা হয়।
বৈদিক নির্দেশনা
বৈদিক শাস্ত্রেও কিছু নির্দিষ্ট ফল খাওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। বলা হয়েছে, “বার্তাকু কার্তিকে বর্জ্যং মূলং বা বদরং মাঘে। চৈত্রে শিম্বী পুনস্তুম্বী ভাদ্রে বর্জ্যং দ্বিজাতিভিঃ” অর্থাৎ, বিভিন্ন ঋতুতে নির্দিষ্ট কিছু খাদ্যদ্রব্য ত্যাগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেমন, কার্তিক মাসে বেগুন, মাঘ মাসে মূলা বা কুল, চৈত্র মাসে শিম এবং ভাদ্র মাসে গোলাকার লাউ খাওয়া নিষিদ্ধ। তবে এই বিধানটি দ্বিজাতিদের জন্য মূলত প্রযোজ্য হলেও পরবর্তীতে এটি লোকাচারে ছড়িয়ে পড়েছে।
লোকাচার ও সংস্কৃতির প্রভাব
লোকাচারে সরস্বতী পূজার আগে কুল না খাওয়ার একটি সংস্কার রয়েছে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মেনে চলা হয়েছে। যদিও সরস্বতী পূজা ফাল্গুন মাসে পালিত হলেও, অনেক সময় এটি মাঘ মাসেও পালিত হয়। সরস্বতী পূজার আগে কুল না খাওয়ার এই প্রথাটি একটি ধ্রুপদী ভাবধারার প্রতীক হিসেবে স্থান পেয়েছে।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সরস্বতী পূজার আগে কুল না খাওয়া যুক্তিযুক্ত। কুল ফল সাধারণত মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকতে শুরু করে। এই সময়ে এটি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হলেও, ফসল কাটা এবং বাজারে আনতে সময় লাগে। এছাড়া কাঁচা কুলে ট্যানিন ও কষ থাকে যা পেটের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
সারসংক্ষেপ
সরস্বতী পূজার আগে কুল না খাওয়ার পেছনে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনি, স্বাস্থ্যগত কারণ, বৈদিক নির্দেশনা এবং লোকাচারের প্রভাব। এই প্রথার মাধ্যমে আমরা একদিকে সরস্বতী দেবীর প্রতি আমাদের সম্মান প্রদর্শন করি, অন্যদিকে নিজেদের স্বাস্থ্যেরও যত্ন নিতে পারি।