‘কলকাকলি স্টেশন’ থেকে যাত্রা শুরু করে ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’ ট্রেন। চলাচল করে ধাদাশ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত। দূর থেকে দেখে মনে হয়, ট্রেনের কয়েকটি বগি থেমে আছে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মূলত স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে দেওয়া হয়েছে রঙ-তুলির আঁচড়। সাজানো হয়েছে নতুনরূপে, যা শিক্ষার্থীদের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রশংসা কুড়াচ্ছে এই উদ্যোগ।
বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, একেকটি ক্লাসরুমকে ট্রেনের একেকটি বগির রূপ দেওয়া হয়েছে। আন্তনগর ট্রেনের বগির আদলে রঙ করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পুরোনো ভবন। এ ছাড়া পুরো ক্যাম্পাসটি যেন একটি শিশুপার্ক। ফুলের বাগানে পশুপাখির ভাস্কর্য, দোলনা। অফিসকক্ষের সামনে সুন্দর মঞ্চ। ছোট্ট মাঠের পুরোটিতেই দৃষ্টিনন্দন টালি বসানো। সব কটি শ্রেণিকক্ষই সাজানো-গোছানো। দেয়ালগুলো রঙিন হয়েছে ফুলে-ফলে। কাগজের ফুল দিয়ে শ্রেণিকক্ষ সাজিয়ে রেখেছে শিক্ষার্থীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে ১৯৬৭ সালে। ২০০০ সালে কয়েকটি ক্লাসরুম তৈরি করা হয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে। বিদ্যালয়ের জরাজীর্ণতা আড়াল করতেই পুরোনো ভবনে রঙ করে নতুনরূপে সাজানো হয়।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রঙ করা স্টেশনের নাম রাখা হয়েছে ‘কলকাকলি স্টেশন’। ট্রেনের নাম ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’। গন্তব্য দেওয়া হয়েছে ‘বিদ্যালয়-টু-মহাকাশ’। এখানে বিদ্যালয় মানে ‘ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান আহরণ করে যাবে জ্ঞানের সর্বোচ্চ উৎকর্ষতা, এ জন্য ‘মহাকাশ’ ব্যবহার করা হয়েছে। এই বিদ্যালয়ে ৩০৯ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এর মধ্যে ছাত্র ১৩৮ ও ১৭১ জন ছাত্রী। প্রথম শ্রেণিতে ২৩ জন ছাত্র ও ২৫ জন ছাত্রী, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩৪ জন ছাত্র ও ২৩ জন ছাত্রী, তৃতীয় শ্রেণিতে ২৭ জন ছাত্র ও ৩৮ জন ছাত্রী, চতুর্থ শ্রেণিতে ২৪ জন ছাত্র ও ২৭ জন ছাত্রী এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ১৫ জন ছাত্র ও ২৮ জন কোমলমতি ছাত্রী পড়াশোনা করে।
শিক্ষার্থী রাফিয়া খাতুন বলে, ‘এই ট্রেন গাড়িতে ক্লাস করতে আমাদের খুব ভালো লাগে। আমাদের স্কুলের মতো ট্রেনগাড়ি কোনও স্কুলে নেই। আমাদের আপারা ট্রেনগাড়ি সর্ম্পকেও বলেছেন। ট্রেনগাড়ির একটা নাম থাকে। স্টেশন থাকে।’
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রতনা খাতুন বলেন, ‘বিদ্যালয়ের পাশাপাশি দুটি ভবন। মাঝে খেলার মাঠ। পশ্চিমের ভবন ২০০০ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠার সময়ের ভবনের অবস্থা তেমন ভালো না। তাই শিক্ষার্থীরা এখানে ক্লাস করতে চাইতো না। আমরা প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে নতুনরূপ দিতে রঙ করার পরিকল্পনা করি। প্রথমে আমরা বিভিন্ন ডিজাইন করার বিষয়ে ভেবেছিলাম। পরে প্রধান শিক্ষক বললেন, আমরা এমন কিছু করবো, যাতে করে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান আহরণ করতে পারে। তারই অংশ হিসেবে ট্রেনর বগির আদলে ক্লাস রুমের সামনের দেয়াল রঙ করা হয়েছে।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা দিলরুবা খাতুন বলেন, ‘আমরা চাচ্ছিলাম, শিক্ষার্থীদের অন্যরকম কিছু উপহার দিতে। আমাদের চিন্তাভাবনা ছিল ক্লাসরুমটা এমন করা যাতে শিক্ষার্থীদের ভালো লাগে। সেই চিন্তাধারা থেকে ট্রেনের বগির আদলে রঙ করা হয়েছে। এই ট্রেনের বগিগুলো শুধু বগি না। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন মেসেজ দেওয়া হয়েছে। যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট কোড, সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমির কোড, পুঠিয়ার কোড ব্যবহার করা হয়েছে। এতে পড়াশোনা ও স্কুলে আসার প্রতি মনোযোগী হয়েছে শিক্ষার্থীরা। আমাদের কাছে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনা। আমরা সেটা পেরেছি। শিক্ষার্থীরা স্কুলে এসে সব ধরনের বিনোদনও পাচ্ছে।’
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই উদ্যোগটি প্রশংসা কুড়িয়েছে। শামিমা নাসরিন সনিয়া নামের একজন তার ফেসবুকে বিদ্যালয়ের ছবি শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, ‘এমন সৃজনশীল ভাবনা সত্যিই প্রশংসনীয়। জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেসের মতো অনুপ্রেরণামূলক ধারণা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে জ্ঞান অন্বেষণের সুদূর গন্তব্যের স্বপ্ন বুনবে। উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই শিক্ষকতার পথকে গৌরবান্বিত করেছে।’
শামসের নেওয়াজ মুক্তা নামে আরেকজন লিখেছেন, ‘এটি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জ্ঞান অর্জনের ট্রেন, যা শিক্ষার মূল ভিত্তি। এটাকে নিত্যনতুনভাবে ক্রমাগত উপস্থাপন ও সজ্জিত করে চলেছেন ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।’
জানা গেছে, ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে সক্ষম হওয়ায় বিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক-২০২২ অর্জন করেছে ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ‘প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২২’ পেয়েছেন। এ ছাড়াও চলতি বছর বিভাগীয় পর্যায়ে এই প্রতিষ্ঠান শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছে। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটিশ কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। মাইক্রোসফট এডুকেশন প্রোগ্রামসের মাইক্রোসফট শোকেস স্কুলের তালিকাতেও রয়েছে এই স্কুল।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার জন্য গঠন করেছেন ‘দরিদ্র তহবিল’। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক ড. আফরোজা খানম ও রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে যুক্ত করেছেন দাতা হিসেবে। প্রতিবছর এই তহবিলে তারা ২০ হাজার করে টাকা দেন। সেই টাকায় ২০ জন করে শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা করা হয়।