দিনাজপুর সদরের দাইনুর গ্রামের সাদেক আলী গত ২৫ দিন ধরে জমির দলিলের একটি সার্টিফাইড কপি (নকল) পাওয়ার জন্য জেলা সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে ধরনা দিচ্ছেন। প্রতিদিন সকালে ১৮ কিলোমিটার দূর থেকে সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে এসে নকল না পেয়ে আবার বিকালে বাসায় ফিরছেন। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে গত ৩৮ দিন ধরে নকলনবিশরা কর্মবিরতি পালন করছেন। ফলে নতুন দলিল নিবন্ধনসহ সব ধরনের সেবা বন্ধ রয়েছে। এতে সাদেক আলীর মতো জেলার সব সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) সকালে দিনাজপুর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের সামনে কথা হয় সাদেক আলীর সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জমির দলিলের নকলের জন্য ২৫ দিন ধরে এই কার্যালয়ে ঘুরছি। টাকা-পয়সা খরচ করেও হয়রানির শিকার হচ্ছি। এখানের কার্যক্রম ভালো না, অন্য রকম অবস্থা। যারা নকল দেবে তারা বলছেন, আমরা কী করবো, আমরা তো কাজের জন্য বসি আছি। অফিস বললেই আমরা কাজ শুরু করবো। কিন্তু অফিসও বলছে না, তারাও কাজ করছেন না। এজন্য আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’
শুধু সাদেক আলী নন, একই অবস্থা সব সেবাগ্রহীতার। জেলার ১৩টি সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে জমির দলিলের নকল পাচ্ছেন না সেবাগ্রহীতারা। কারণ গত ১৯ অক্টোবর থেকে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে নকলনবিশরা কর্মবিরতি পালন করছেন। বাংলাদেশ এক্সট্রা মোহরার (নকলনবিশ) অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে এ কর্মসূচি পালন করছেন তারা। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষজন।
মানুষের ভোগান্তি
মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত জেলা সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, জমি বেচাকেনার জন্য এবং দলিলের নকলের জন্য ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। কেউ কার্যালয়ের নিচে চেয়ারে বসে আবার কেউ কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ কথা বলছেন নকলনবিশদের সঙ্গে, যাতে কাজটা করে দেওয়া হয়। কার্যালয়ের দোতলাতেও একই অবস্থা। মানুষ আসছেন, ঘুরছেন; খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। কারণ নতুন দলিল নিবন্ধনসহ সব ধরনের সেবা বন্ধ রেখেছেন। নকলনবিশরা বলছেন, অপেক্ষা করতে।
এদিন দুপুরে সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে এসেছেন সদর উপজেলার সুন্দরবন এলাকার আব্দুল হাকিম। গত ২৮ দিন ধরে ধরনা দিচ্ছেন দলিলের নকলের জন্য। ভোগান্তির কথা জানিয়ে হাকিম বলেন, ‘আমার এক একর ৭৮ শতক জমির একটি মামলা চলছে। মামলার জন্য দলিলের নকল প্রয়োজন। যদি সঠিক সময়ের মধ্যে এই কপি না পাই তাহলে মামলায় হেরে যাবো। সেইসঙ্গে আমি, আমার পরিবার, আমার ভাইয়ের পরিবার সবাই সমস্যায় পড়বো। বিষয়টি বারবার নকলনবিশদের বুঝিয়ে বলেছি। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। কর্মকর্তাদেরও বলেছি, তারা বলেছেন অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই তাদের। নকলনবিশদের কাজ অন্য কেউ করতে পারবে না। এখন তাদের দাবি-দাওয়ার জন্য আমাদের সমস্যা। কোথায় গেলে সমাধান পাবো, বুঝতেছি না।’
চিরিরবন্দর উপজেলার নানিয়াটিকর গ্রামের বেলাল হোসেন বলেন, ‘অনেকদিন ধরে আন্দোলন করছেন নকলনবিশরা। আমার দলিলের কাজ আছে। কিন্তু দলিল পাচ্ছি না। প্রতিদিন এসে হয়রানির শিকার হচ্ছি। মনে হচ্ছে এই ভোগান্তি দেখার কেউ নেই। বিষয়টি দ্রুত সমাধানের জন্য দায়িত্বশীলদের কাছে অনুরোধ করছি।’
একই ভোগান্তির কথা জানিয়ে বিরল উপজেলার নাড়াবাড়ি এলাকার ওহিদুর রহমান বলেন, ‘আমি দলিলের নকল নেওয়ার জন্য ১৫ দিন ধরে ঘুরছি। তারা কাজ বন্ধ রেখেছেন, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের। আদালতে মামলা চলছে। আমি হয়রানির শিকার হচ্ছি। কিন্তু এসব নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই নকলনবিশদের। আমাদের জিম্মি করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাচ্ছেন তারা। নকলনবিশরা এভাবে আমাদের জিম্মি করে কাজ না করলে অন্যভাবে কাজ চালু করা জন্য সরকারের দায়িত্বশীলদের কাছে অনুরোধ করছি।’
চাকরি জাতীয়করণের দাবি ১৬ হাজার ২৪৬ নকলনবিশের
আন্দোলনরত নকলনবিশদের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার ১৩টি উপজেলায় নকলনবিশ রয়েছেন এক হাজার ৪০৪ জন। তারা সবাই চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে কলমবিরতি কর্মসূচি পালন করছেন।
বাংলাদেশ এক্সট্রা মোহরার অ্যাসোসিয়েশনের (নকলনবিশ) দেওয়া তথ্যমতে, দেশের ৫১৬টি সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে কর্মরত ১৬ হাজার ২৪৬ জন নকলনবিশ চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছেন। গত ৩৮ দিন ধরে কর্মবিরতি পালন করছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের নকলনবিশ মিনু আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরিবার কিংবা সন্তানদের আমরা বলতে পারি না, আমাদের বেতন কতো? কলমের মাধ্যমে আমরা স্থায়ী রেকর্ড করছি। কিন্তু আমাদের চাকরি স্থায়ী করা হচ্ছে না। আমাদের দাবি একটাই, চাকরি স্থায়ীকরণ।’
আপনাদের কর্মবিরতির কারণে মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জানালে নকলনবিশ মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হয়। বলার কোনও ভাষা নেই। আমাদের কোনও মূল্যায়ন নেই। সবাই জানে আমরা বেতনভুক্ত, কিন্তু আমরা যে কী আমরাই জানি। এক পাতা নকল লিখলে ২৪ টাকা পাই, আর সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে নেওয়া হয় ৬০ টাকা। ৩৮ দিন ধরে কর্মসূচি পালন করছি। কেউ আমাদের কাছে আসছে না। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, অন্তত যে ৬০ টাকা সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে নেওয়া হয়, তার পুরোটাই আমাদের দেওয়া হোক। এতে সরকারের কোনও ক্ষতি হবে না।’
আমাদের কষ্ট কেউ দেখে না আক্ষেপ করে নকলনবিশ সুরাইয়া আক্তার বলেন, ‘একজন শ্রমিক দিনে ৫০০ টাকা পায়, আমরা সেটাও পাই না। ৩৮ দিন ধরে কর্মসূচি চলছে। কারও কাছ থেকে কোনও সাড়া পাইনি, আশ্বাস পাইনি। যত দিন সাড়া পাবো না, ততদিন কর্মবিরতি চালিয়ে যাবো আমরা।’
সমাধান কী
কর্মবিরতি ও মানুষের ভোগান্তির সমাধান কী জানতে চাইলে বাংলাদেশ এক্সট্রা মোহরার অ্যাসোসিয়েশনের (নকলনবিশ) দিনাজপুর সদর শাখার সহসভাপতি মিনহাজুল আবেদিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ৩৮ দিন ধরে পড়ে আছি। কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। চাকরি স্থায়ীকরণ কিংবা জাতীয়করণের কোনও আশ্বাস পাচ্ছি না। গত তিন দিন ধরে আমরা আমরণ অনশন করছি। আমাদের খুব সামান্য টাকা দেওয়া হয়, যা দিয়ে আমরা চলতে পারি না। মাসে ছয়-সাত হাজার টাকা উপার্জন করি। বর্তমান সময়ে এই টাকা দিয়ে কীভাবে সংসার চলে। চাকরি স্থায়ী না করলে অন্তত আমাদের কাজের মাধ্যমে যে অর্থ সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে সরকার নিচ্ছে, সেই অর্থ পুরোপুরি আমাদের দেওয়া হলে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবো। এতে কারও ক্ষতি হবে না।’
একই অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কেন্দ্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরা কর্মসূচি পালন করছি। আমরা সরকারি কাজ করি। বালাম লেখার মাধ্যমে স্থায়ী রেকর্ডের সৃষ্টি করি। এটির মাধ্যমে সরকারের স্থায়ী রেকর্ড সৃষ্টি হয়, রয়্যালটি উপার্জন হয় সরকারের। নকলনবিশ একসময়ে মারা যাবে। কিন্তু এই রেকর্ড অক্ষয় থাকবে। ততদিন পর্যন্ত সরকারের রাজস্ব আয় চলতেই থাকবে। এই নকলের কাজকে আরও অগ্রগতি করা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা করতে আমাদের স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। সরকারের কাছে আবেদন, আমাদের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
অ্যাসোসিয়েশনের সদর শাখার সভাপতি রনজিৎ কুমার রায় বলেন, ‘আমাদের দাবি-দাওয়া পূরণ করা হবে, স্কেলভুক্ত করা হবে। এই আশ্বাসে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর সমাধান হয়নি। ফলে আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। ৩৮ দিন চলছে। এখনও কোনও আশ্বাস পাইনি আমরা।’
রেজিস্ট্রার বললেন অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই
নকলনবিশরা কর্মবিরতি পালন করায় ৩৮ দিন ধরে নতুন দলিল নিবন্ধনসহ সব ধরনের সেবা বন্ধ রয়েছে বলে জানালেন দিনাজপুর জেলার রেজিস্ট্রার সাজেদুল হক। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘নকলনবিশদের কর্মবিরতির কারণে মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তাদের কারণে আমরাও কাজ করতে পারছি না। মানুষকে নকল সরবরাহ করতে পারছি না। আপাতত সাধারণ মানুষকে অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই। তবে আদালত থেকে আমাদেরকে কাছে যে বালামগুলো তলব করছেন, ইনডেক্স বই চাইছেন, আমরা সেগুলো দিচ্ছি। নকলনবিশদের কর্মবিরতির কথা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানেন। তাদের কিছু করতে হবে।’