ফুলছড়ি-সাঘাটা হানাদারমুক্ত: গরুর গাড়িতে করে আনা হয়েছিল ৫ বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ
বাংলাদেশ

ফুলছড়ি-সাঘাটা হানাদারমুক্ত: গরুর গাড়িতে করে আনা হয়েছিল ৫ বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ

১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর গাইবান্ধার ফুলছড়ি ও সাঘাটাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। এদিন দুটি উপজেলাকে হানাদার মুক্ত করে লাল-সবুজের বিজয় পতাকা ওড়ান তারা। দুই উপজেলাকে মুক্ত করতে গিয়ে পাঁচ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দুজন বেসামরিক ব্যক্তি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শাহাদাতবরণ করেন। এই যুদ্ধে ২২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

তারই আলোকে প্রতি বছর দিনটিকে ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলা মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করেন স্থানীয়রা। দিবসটি উপলক্ষে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। 

শহীদ পাঁচ বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেন- আফজাল হোসেন, কবেজ আলী, যাহেদুর রহমান বাদল, ওসমান গণি এবং আব্দুল সোবহান। পরদিন ৫ ডিসেম্বর শহীদ পাঁচ মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ গরুর গাড়িতে করে সাঘাটা উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের খামার ধনারুহা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নিয়ে সমাহিত করা হয়েছিল। 

পরবর্তীতে পাঁচ শহীদের স্মরণে বিদ্যালয়ের পাশেই নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভ। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেকের মরদেহ ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট রেললাইন-সংলগ্ন গণকবরে সমাহিত করা হয়। কয়েক বছর আগে গণকবরটির চার পাশে প্রাচীর দিয়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। তবে সেটি এখন অরক্ষিত অবস্থায় আছে।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল তৎকালীন ফুলছড়ি সিও অফিসের (বর্তমান উপজেলা পরিষদ কার্যালয়) চার কিলোমিটার দূরে তিস্তামুখ রেলওয়ে ফেরিঘাট এলাকায় ঘাঁটি করেছিল। এই ক্যাম্প থেকে আশপাশের বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন শুরু করেছিল তারা। হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার ছাত্র-যুবক সীমান্ত এলাকা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন জুন মাসের প্রথম দিকে। ১১ নম্বর সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ফুলছড়ির গলনারচরে ক্যাম্প স্থাপন করেন। পরে পার্শ্ববর্তী সাঘাটা পুলিশ স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালান। এ ছাড়া হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গৌতম চন্দ্র মোদকের নেতৃত্বে ৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে সামছুল আলম, নাজিম উদ্দিন, আব্দুল জলিল তোতা, এনামুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধারা চার ভাগে বিভক্ত হয়ে ফুলছড়ি থানার আশপাশে অবস্থান নেন।

পরদিন ৪ ডিসেম্বর ভোরে গেরিলা কমান্ডার সামছুল আলমের দলটি সর্বপ্রথম ফুলছড়ি থানা (পুলিশ স্টেশন) আক্রমণ করে গ্রেনেড হামলা ও গুলিবর্ষণ শুরু করলে অপর তিনটি দলের মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে গুলি ছুড়ে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যান। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফুলছড়ি থানার পুলিশ সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা থানার অস্ত্রাগারের সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নেন। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল ক্যাম্প থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর দিয়ে উত্তর দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এনামুলের দলের মুখোমুখি হয়। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে ২৫ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এর মধ্য দিয়ে ৪ ডিসেম্বর ফুলছড়ি উপজেলা, তিস্তামুখ রেলওয়ে ফেরিঘাট হানাদার এবং সাঘাটা হানাদার মুক্ত হয়।  

সাবেক উপজেলা ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আজহার আলী বলেন, ‘দুই উপজেলা মুক্ত হওয়ার পরদিন জাতির সূর্যসন্তানদের মরদেহ গরুর গাড়িতে করে নিয়ে এসে সগুনা ইউনিয়নের খামার ধনারুহা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাঁচ বীর শহীদের সম্মানার্থে ইউনিয়নের নাম পরিবর্তন করে মুক্তিনগর ইউনিয়ন রাখা হয়। মুক্তিনগর ইউনিয়ন বতর্মানে সাঘাটা উপজেলার অর্ন্তভুক্ত। এই উপজেলায় শহীদদের সম্মানে তাদের কবরের পাশে স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতি বছরই মুক্তিযোদ্ধাদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুক্তিনগরের ধনারুহা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।’

Source link

Related posts

চট্টগ্রাম নগরের ১৬ থানার জিডি করা যাবে এক জায়গায়

News Desk

ফল কিনতে গিয়ে প্রাণ গেলো র‍্যাব সদস্যের

News Desk

চট্টগ্রামে একদিনে করোনায় দুইজনের মৃত্যু, শনাক্ত ১৫৮

News Desk

Leave a Comment