১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মানুষের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল পাশের ঘ্যাংরাইল নদের পানি। একটি এলাকায় একদিনে এত মানুষ আর হত্যার শিকার হয়নি। সেদিনের শহীদদের স্মরণে ২০০৬ সালে সাত লাখ টাকা ব্যয়ে ‘চুকনগর গণহত্যা স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করেছিল গণপূর্ত বিভাগ। গত ১৮ বছরেও পূর্ণতা পায়নি এই স্মৃতিস্তম্ভ। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আজ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে সীমানাপ্রাচীরের বড় একটি অংশ ভেঙে পড়েছে।
পাশাপাশি খুলনা মহানগরের প্রবেশপথে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান গল্লামারী বধ্যভূমি। ২০০৯ সালে এখানে নির্মিত হয়েছিল ‘গল্লামারী স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ’। মূলস্তম্ভ তৈরি হলেও অর্থ সঙ্কটে বাকি কাজ ১৫ বছরেও হয়নি। কাজের জন্য অর্থ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েও সাড়া পায়নি জেলা পরিষদ। ফলে পূর্ণতা পায়নি স্মৃতিসৌধটি। সীমানাপ্রাচীর না থাকায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে এটি।
একাত্তরে রক্তাক্ত চুকনগর
খুলনা শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে ভারত সীমান্তবর্তী ভদ্রা নদীর তীরবর্তী একটি অঞ্চল চুকনগর। জায়গাটি পড়েছে ডুমুরিয়ার আটলিয়া ইউনিয়নে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিক থেকেই ভয়াবহ গণহত্যার পথ বেছে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে শুরু হওয়া বর্বর গণহত্যা স্তব্ধ করে দেয় সবাইকে। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করা মানুষজন ছুটতে থাকে। ফলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। ভৌগোলিক কারণে চুকনগর বাজার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ তিন দিকে নদী ঘেরা চুকনগর থেকে ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারলেই ভারতে যাওয়া যেতো। চুকনগর যেহেতু ছিল যশোর, খুলনা এবং সাতক্ষীরার সংযোগস্থল, তাই সহজেই স্থানটি সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২০ মে’র আগ পর্যন্ত এই সীমান্ত দিয়ে অনেক মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু রাজাকার আলবদর বিষয়টি জেনে যায় এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে জানিয়ে দেয়।
স্থানীয় লোকজন ও সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার, নির্যাতন ও লুণ্ঠন সহ্য করতে না পেরে বাগেরহাট, রামপাল, মোরেলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মোংলা, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনা, ফরিদপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। ১৮ ও ১৯ মে দুই দিনে নৌকায় করে ভদ্রা নদী ও ঘ্যাংরাইল নদ দিয়ে চুকনগর বাজার এবং এর আশপাশ এলাকায় জড়ো হন তারা। উদ্দেশ্য, ভারতে পৌঁছানো। চুকনগর এলাকাকে তখন ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতেন লোকজন।
১৯৭১ সালের ২০ মে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন সকালে ভারতের পথে রওনা দিয়েছিলেন অনেকে। অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ সাতক্ষীরা-খুলনা সড়ক ধরে ১৪-১৫ জন পাকিস্তানি সেনা একটি ট্রাক ও একটি খোলা জিপে করে এসে থামে চুকনগর বাজারের পশ্চিম পাশে ঝাউতলায়। সামনে পাতখোলা মাঠ তখনো লোকে লোকারণ্য। আচমকা শুরু হলো গুলিবর্ষণ। রক্তে ভেসে যায় পাতখোলা মাঠ।
অন্য ট্রাকটি চুকনগর বাজারের দিকে যায়। সেখানেও চলে ব্রাশফায়ার। রক্তে ভিজে যায় চুকনগর মন্দির প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকা। ভদ্রা নদীতে অবস্থান করছিলেন অনেক মানুষ, তারাও রেহাই পাননি। বিকাল ৩টা পর্যন্ত চলে হত্যাযজ্ঞ। তখন ফজলুর রহমান মোড়লের বয়স ১৪-১৫ বছর। গোলাগুলির মধ্যে পড়েছিলেন। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণে রক্ষা পান।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ঘ্যাংরাইল ও ভদ্রা নদীর জোয়ারে ভেসে যায় অসংখ্য লাশ। ঘটনার দিন থেকে পরের ছয়-সাত দিন স্থানীয় কয়েকজন পড়ে থাকা লাশ জোয়ারের সময় পানিতে নামিয়ে রাখতেন। ভাটার সময় নদীতে লাশগুলো একসঙ্গে গেঁথে দূরে গাছে বেঁধে রাখতেন, যাতে জোয়ারে আবার ফিরে না আসে। অনেক লাশ নদীর আরও দূরে ঠেলে দিতেন। কতজন নিহত হয়েছিলেন এই হত্যাকাণ্ডে? ফজলুর রহমান মোড়লের অনুমান, ১০-১২ হাজারের মতো।
এত ভয়াবহ ঘটনা নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত অনেকের অজানা ছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের দলিলে চুকনগর গণহত্যার কথা উল্লেখ নেই। ১৯৯৩ সালে গঠিত হয় ‘চুকনগর গণহত্যা ৭১ স্মৃতি রক্ষা পরিষদ’। ২০০৪ সালে গণহত্যা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য সরকার এই গ্রামের বিলের ৭৮ শতক জমি অধিগ্রহণ করে। এরপর গণপূর্ত বিভাগ ২০০৬ সালে ওই জমির একাংশে সাত লাখ টাকা ব্যয়ে ‘চুকনগর গণহত্যা স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করে।
চুকনগর গণহত্যা ৭১ স্মৃতি রক্ষা পরিষদের সভাপতি ও চুকনগর কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ওই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। তবে সেটা অনেকটাই অবহেলিত। বধ্যভূমিতে একটি পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা আজও সম্ভব হয়নি।
ডুমুরিয়া উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. নুরুল ইসলাম মানিক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণহত্যার স্থান চুকনগর। এখানে স্মৃতিস্তম্ভ করা হলেও পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হয়নি। এটি কষ্টদায়ক।’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান গল্লামারী
শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের পাশের এই স্থানটি ছিল একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলোতে জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয় এখানে। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর খুলনা মুক্ত হওয়ার পর এখান থেকে উদ্ধার হয় কয়েকশ মানুষের মাথার খুলি। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খুলনা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে গল্লামারী বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়। ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ এটির উদ্বোধন করেন শহীদের বাবা আলতাব উদ্দিন আহম্মদ। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হক ও পুলিশ সুপার আওলাদ হোসেনের উদ্যোগে সেখানে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং ওই বছরের ২৬ মার্চ বিজয় মঞ্চের উদ্বোধন হয়। ২০০৯ সালে এখানে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা জেলা পরিষদ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। দুই কোটি ব্যয়ে নির্মিত মূল স্তম্ভ। এরপর কেটে গেছে ১৫ বছর। দফায় দফায় এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েও সুফল পায়নি জেলা পরিষদ। ফলে স্বাধীনতা সৌধের মূল স্তম্ভ নির্মিত হলেও অর্থ সঙ্কটে বাকি কাজ শেষ হয়নি আজও।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে গল্লামারীতে স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১০ কোটি টাকা। প্রকল্পে রয়েছে মূল স্তম্ভ নির্মাণ, স্তম্ভের চারপাশে ১০ ফুট লাল টাইলস বসানো, পায়ে হাঁটার পথ, পার্কিং ইয়ার্ড, সীমানাপ্রাচীর, গেট, সিকিউরিটি শেড, রেস্টুরেন্ট, দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান, পানির ফোয়ারা ইত্যাদি। ২০০৯ সালের ২৩ জুন দরপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে কাজটি পায় খুলনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আজাদ-ইলোরা জেভি। ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয় ২০০৯ সালের ১৫ নভেম্বর। স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১১ সালের নভেম্বরে। ২০১১ সালের মার্চে স্মৃতিসৌধের স্থপতি আমিনুল ইসলাম ইমন নির্মিত স্তম্ভটি পরিদর্শন করেন। তখন তিনি স্মৃতিসৌধটিকে পূর্ণতা দিতে মূল নকশা বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন। নকশা অনুযায়ী বাকি কাজ সম্পন্ন করতে আরও আট কোটি টাকা প্রয়োজন। ওই টাকা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও কোনও সাড়া মেলেনি। বর্তমানে সীমানাপ্রাচীর না থাকায় স্মৃতিস্তম্ভটি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে।
গল্লামারী দেশের অন্যতম বৃহৎ বধ্যভূমি, যেখানের মাটির পরতে পরতে মুক্তিকামী মানুষের রক্ত ছড়িয়ে আছে, সেখানে এত বছরেও একটি স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণ না হওয়া দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মহাসিন আলী।
তিনি বলেন, ‘গল্লামারী বধ্যভূমির প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া যায়নি। কারণ ওখানে যাদের নেওয়া হয়েছিল তারা কেউ ফিরে আসেননি। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী দৃশ্য অনেকে দেখেছেন। রক্তমাখা ছেঁড়া জামাকাপড়, দেয়ালে রক্তে লেখা নানা আকুতি আমরা দেখেছি। পাঁচ ট্রাক মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়েছিল। সেখানে মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে হাজারো মানুষের পদভার থাকলেও সারা বছর অরক্ষিত থাকে। স্বাধীনতার এত বছর পরও স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়নি। এখানে স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স তৈরি না হওয়া দুঃখজনক।’
খুলনার গণকবর ও বধ্যভূমি শনাক্তকরণ কার্যক্রমে যুক্ত থাকা হুমায়ুন কবির ববি বলেন, ‘খুলনার গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো শনাক্ত করার পর নামফলক দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। এসব স্থান সংরক্ষণে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। গল্লামারী বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হলেও পূর্ণতা পায়নি। এটি পূর্ণাঙ্গ করার দাবি জানাই।’