Image default
জীবনী

আইয়ুব বাচ্চু : ব্যান্ডের রাজা

আইয়ুব বাচ্চু (১৬ আগস্ট ১৯৬২ – ১৮ অক্টোবর ২০১৮) একজন বাংলাদেশী সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক-গীতিকার এবং গীটারবাদক ছিলেন। তিনি রক ব্যান্ড এল আর বি এর গায়ক ও গীটারবাদক হিসেবে পুরো বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তাকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং গীটারবাদক বলা হয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধীন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন।

বাচ্চু চট্টগ্রামে ১৯৭৬ সালে কলেজ জীবনে “আগলি বয়েজ” নামক ব্যান্ড গঠনের মাধ্যমে তার সঙ্গীত জীবনের সূচনা করেছিল। ১৯৭৭ সালে তিনি “ফিলিংস” (বর্তমানে “নগর বাউল” নামে পরিচিত) এ যোগদান করেন এবং ব্যান্ডটির সাথে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন। একই বছরে তিনি জনপ্রিয় রক ব্যান্ড সোলস-এর প্রধান গীটারবাদক হিসেবে যোগদান করেন। সোলসের সঙ্গে তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, সুপার সোলস (১৯৮২), কলেজের করিডোরে (১৯৮৫), মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭) এবং ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট (১৯৮৮) চারটি অ্যালবামে কাজ করেছিল। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল তিনি তার নিজের ব্যান্ড লিটল রিভার ব্যান্ড গঠন করে, যা পরবর্তীকালে লাভ রান্স ব্লাইন্ড নামে বা সংক্ষেপে এল আর বি নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি তার মৃত্যু অবধি ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৭ বছর ধরে ব্যান্ডটির সঙ্গে ছিলেন। একজন একক শিল্পী হিসেবেও তিনি সফলতা পেয়েছিল। তার প্রথম একক অ্যালবাম রক্ত গোলাপ, যা ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় অ্যালবাম ময়না (১৯৮৮) দিয়ে, তিনি তার একক কর্মজীবনের সফলতা অর্জন করেন এবং পরে কষ্ট (১৯৯৫) অ্যালবামটি প্রকাশ করেন, যা প্রচুর সফলতা অর্জন করে। ২০০৭ সালে তিনি দেশের প্রথম বাদ্যযন্ত্রগত অ্যালবাম সাউন্ড অফ সাইলেন্স প্রকাশ করেন।

বাচ্চু এল আর বি’র সাথে এবং একজন একক শিল্পী হিসেবে প্রচুর অ্যালবাম বিক্রয় করেছেন। বাচ্চু বাংলাদেশে একজন অন্যতম সেরা গীটারবাদরক এবং অন্যতম প্রভাবশালী গীটারবাদক। এল আর বি’র সাথে সে ছয়টি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার এবং একটি সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস জিতেছেন। ২০০৪ সালে বাচসাস পুরস্কার জিতেছিলেন সেরা পুরুষ ভোকাল বিভাগে। ২০১৭ সালে সে টেলে সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার জিতেছিলেন।

বাচ্চু তার বান্ধবী ফেরদৌস চন্দনা’কে বিয়ে করেছিলেন ১৯৯১ সালের ৩১শে জানুয়ারিতে। তাদের দু’টি সন্তান আছে। মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব এবং ছেলে আহনাফ তাজওযার আইয়ুব। ছয় বছর ধরে ফুসফুসে পানি জমার অসুস্থতায় ভোগার পর ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ঢাকায় তার নিজ বাসভবনে মারা যান। মৃত্যুর দুইদিন আগে তিনি রংপুরে তার শেষ কনসার্ট করেন।

তাকে চট্টগ্রামের চৈতন্য গলি’তে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে, তার মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।

প্রাথমিক জীবন:

আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইশহাক চোধুরী এবং মা নুরজাহান বেগম। তাদের পরিবার ছিল একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। তার মতে তাদের পরিবারে সবাই “অতি ধার্মিক ছিলেন এবং সঙ্গীত নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা কেউ গ্রহণ করেননি।” তারা তিন ভাই-বোন ছিলেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তার বাবা চট্টগ্রাম শহরের জুবীলি রোড এলাকায় একটি বাড়ি ক্রয় করেন, যেখানে বাচ্চুর বেশিরভাগ কৈশর জীবন অতিবহিত হয়। ১৯৭৩ সালে তার বাবা তাকে তার ১১তম জন্মদিনে একটি গীটার উপহার দেন। তার কৈশর জীবনের শুরুর দিকে সে বিভিন্ন ব্রিটিশ এবং আমেরিকান রক ব্যান্ডের গান শোনা শুরু করে, যেমন তৎকালীন সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রক ব্যান্ড লেড জেপলিন, ডিপ পার্পল, কুইন, দ্য জিমি হেনড্রিক্স এক্সপেরিয়েন্স ইত্যাদি। তন্মধ্যে জিমি হেনড্রিক্স এর গীটার বাজানো তাকে বেশি মুগ্ধ করেছিল। তাকে গীটার শেখাতো জেকব ডায়াজ নামের একজন বার্মিজ মানুষ যে তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামে থাকতো। ১৯৭৬ এর দিকে সে তার এক বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে ইলেকট্রিক গীটার বাজাতো, যা ছিল একটি টিস্কো গীটার। পরে সে যখন গীটারটির প্রতি বেশি আগ্রহ দেখান, তার বন্ধু তাকে গীটারটি দিয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালে তাকে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। ১৯৭৯ সালে সে ওই স্কুল থেকে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। চট্টগ্রামে কলেজ জীবনে সহপাঠী বন্ধুদের নিয়ে তিনি একটি ব্যান্ডদল গড়ে তোলেন। এর নাম ছিল “গোল্ডেন বয়েজ”। পরে নাম বদলে করা হয় “আগলি বয়েজ”। সেই ব্যান্ডের গায়ক ছিল কুমার বিশ্বজিৎ এবং বাচ্চু ছিল গিটারিস্ট। সেই সময়ে তারা মূলত পটিয়ায় বিভিন্ন বিবাহ অনুষ্ঠানে গান গাইতো এবং শহরের বিভিন্ন ক্লাবে গান করতো। ১৯৮০ সালে বাচ্চু ও বিশ্বজিৎ যখন সোলসে যোগদান করে তখন ব্যান্ডটি ভেঙে যায়।

সঙ্গীতজীবন:

১৯৭৭-১৯৮০: ফিলিংস ও সোলস,

১৯৭৭ সালে তার নিজের ব্যান্ডে কাজ করার পাশাপাশি সে ফিলিংস নামের একটি রক ব্যান্ডে যোগ দেন গিটার বাদক হিসেবে, যেখানে তিনি কাজ করেছিলেন জেমস এর সঙ্গে। জেমস বলেছিল, সে বাচ্চুকে একটি চায়ের দোকানে গিটার বাজাতে দেখেছিল এবং বাচ্চুর গিটার বাজানো দেখেই সে তাকে ফিলিংসে যোগ করতে বলেন। বাচ্চু তার কথায় রাজি হয়ে যান এবং পরবর্তী তিন বছর, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ওই ব্যান্ডে কাজ করেন। ১৯৮০ সালে সোলসের গিটার বাদক সাজেদ উল আলম উচ্চশিক্ষার জন্যে আমেরিকায় চলে যায়। একরাতে যখন ফিলিংস চট্টগ্রামের একটি ক্লাবে অনুষ্ঠান করছিল, তখন সেখানে উপস্থিত ছিল সোলস ব্যান্ডের নকীব খান। বাচ্চুর গিটার বাজানো দেখে সে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং সোলসের গায়ক তপন চৌধুরী কে বাচ্চুর ব্যপারে বলেন। পরদিন রাতে তারা ফিলিংস এর অনুষ্ঠান দেখতে আসে এবং বাচ্চুকে সোলসে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে বলেন। বাচ্চু একই বছরের মাঝামাঝি সময়ে “আগলি বয়েজ” এর গায়ক কুমার বিশ্বজিৎ এর সাথে যোগ দেন। পরবর্তী দশ বছর সে সোলস এর মূল গিটার বাদক, গীতিকার এবং গায়ক (অনিয়মিত) হিসেবে কাজ করে। সে সোলসের সাথে চারটি অ্যালবামে কাজ করেছিল: সুপার সোলস (১৯৮২) যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম গানের অ্যালবাম, কলেজের করিডোরে (১৯৮৫), মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭) এই অ্যালবামটিতেই বাচ্চুর সোলসের হয়ে গাওয়া প্রথম গান “হারানো বিকেলের গল্প” প্রকাশ পায়। সোলসের সাথে তার শেষ অ্যালবামটি ছিল ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, যা প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৮৮ সালে। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে বাচ্চু ব্যান্ডটি ছেড়ে নিজের ব্যান্ড লিটল রিভার ব্যান্ড গঠন করেন, যা পরবর্তী সময়ে লাভ রানস ব্লাইন্ড বা সংক্ষেপে এল আর বি নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সোলস ত্যাগ করার পরেও বাচ্চু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তপন চৌধুরী, নকিব খান এবং কুমার বিশ্বজিৎ এর সাথে অনুষ্ঠান করেছে। ২০১২ সালে বাচ্চু দ্য ডেইলি স্টার কে বলেছিল:

“আমি সোলস ত্যাগ করেছি কেননা আমার সাথে তাদের পার্থক্য ছিল। তারা একধরনের গান করতে পছন্দ করতো আর আমি আরেকধরনের গান করতে পছন্দ করতাম। আমার পছন্দ ছিল উচু আওয়াজের, বেশি রকিং গিটারের গান। আর বাকিদের পছন্দ ছিল শান্ত, সুমধুর গান। আপনি দিনের পর দিন শুধু আপোস করতে পারবেন না। আমাদের মাঝে তেমন একটা বড় ধরনের ঝগড়া হয় নি কোনোদিন। আমার মনে হয়েছিল যে, আমি নিজের মতো গান করলে ভালোই হবে।”

১৯৯১-২০১৮: এল আর বি,

১৯৯০ এর দশকের শেষদিকে বাচ্চু সোলস থেকে বের হয়ে আসার পর ১৯৯১ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং জানুয়ারিতে ফেরদৌস চন্দনার সাথে বিয়ে করেন, যার সাথে তার ১৯৮৬ সাল থেকে সম্পর্ক ছিল। তিনি ‘”ইয়েলো রিভার ব্যান্ড”‘ নামের একটি ব্যান্ড গঠন করেন ৫ এপ্রিল ১৯৯১ সালে, এস আই টুটুল (কীবোর্ডস), সাইদুল হাসান স্বপন (বেজ গিটার) এবং হাবিব আনোয়ার জয় (ড্রামস)। ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তারা ভারতে অনুষ্ঠান করতে গেলে তাদের ভুলে “লিটল রিভার ব্যান্ড” নামে পরিচিত করানে হয়। নামটি বাচ্চু পছন্দ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তার ব্যান্ড নামকরণ করে। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে, এলআরবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রথম কনসার্টটি করে। কনসার্টটি বামবা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, যা স্বৈরাচারী নেতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর পতনের উদযাপন করেছিল। ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে, তারা বাংলাদেশে প্রথম ডাবল অ্যালবাম: এলআরবি ১ এবং এলআরবি ২ প্রকাশ করেছিল। ব্যান্ডটির তৃতীয় স্টুডিও অ্যালবাম সুখ, জুনে মুক্তি পায় এবং এটি বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রক অ্যালবামগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। এতে “চলো বদলে যাই” গানটি ছিল যা বাচ্চুর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হিসাবে বিবেচিত। তারা ১৯৯০ এর দশকে আরও কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশ করে এবং শীঘ্রই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রক ব্যান্ডের মধ্যে একটি হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সালে, তারা ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠান করেছিল, যা বাংলাদেশের বাইরে তাদের প্রথম কনসার্ট ছিল। এলআরবি নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন অনুষ্ঠান করা একমাত্র বাংলাদেশী ব্যান্ড।

বাচ্চুর মৃত্যুর পর, এলআরবির অন্যান্য সদস্যদের বালাম জাহাঙ্গীর কে তাদের নতুন গায়ক হিসাবে ঘোষণা করেন। বাচুর স্ত্রী এবং মেয়ে এলআরবির নামে নতুন গায়কের সাথে এবং ব্যান্ড সদস্যদের সদস্যদের সন্তুষ্ট ছিল না। তারা ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করতে বলে সদস্যদের। ব্যান্ড কয়েক দিনের জন্য বন্ধ করা হয় এবং পুরোনো সদস্যরা বালামের সাথে “বালাম এবং দ্য লেগ্যাসি” নামক একটি নতুন ব্যান্ড গঠন করে। বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস বলেছেন যে: “বাচ্চু এলআরবি এর একমাত্র মালিক, শুধুমাত্র তার উত্তরাধিকারী একই নামে ব্যান্ড চালাতে পারে।” ১৫ এপ্রিল ২০১৯ সালে, বাচ্চুর ছেলে আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব তার ফেসবুক একাউন্টে পোস্ট করেছেন যে তিনি ব্যান্ডের অন্যান্য সদস্যদের সাথে এল আর বি নাম ব্যবহারে বাধা দেবে না এবং পরে বাচ্চুর স্ত্রী ও কন্যাও একমত হয়েছিলেন।

একক শিল্পী হিসেবে বাচ্চু:

প্রথম কিছু কাজ: ১৯৮৬-১৯৮৮,

সোলস এ কাজ করার সময়কাল থেকেই বাচ্চু একজন একক শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেছিল এবং দুটি অ্যালবাম বের করেছিল: রক্ত গোলাপ (১৯৮৬) এবং ময়না (১৯৮৮)। উভয় অ্যালবামেই মূলত পপ রক গান ছিল৷ ওই অ্যালবাম গুলোর কিছু গানে বাংলা আধুনিক গানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এবং তবলার মতো যন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়৷ রক্ত গোলাপ অ্যালবামটিতে মূলত পপ, বাংলা আধুনিক গান এবং একটি মাত্র রক ঘরানার গান রয়েছে “অনামিকা”। ময়না অ্যালবামটিতে পপ রক, হার্ড রক এবং বাংলা আধুনিক ঘরানার গান রয়েছে। ওই অ্যালবাম দিয়েই বাচ্চু জনপ্রিয়তা লাভ করে। পুরো দেশে অ্যালবামটির ৬০,০০০ হাজার কপি বিক্রিত হয়েছিল। রক্ত গোলাপ, ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বের হয় এবং ওই অ্যালবামটিতে বাচ্চুর প্রথম হার্ড রক গান ছিল, “অনামিকা”। জাহেদ ইলেকট্রনিক্স অ্যালবামটি বের করেছিল। ফিলিংস ব্যান্ডের ড্রামার এহসান এলাহি ফান্টি অ্যালবামটিতে ড্রাম বাজিয়েছিল, মাইলস ব্যান্ডের মানাম আহমেদ কীবোর্ডস বাজিয়েছিল। বাচ্চু ইলেক্ট্রিক গীটার ও বেজ গীটার উভয়ই বাজিয়েছিল৷ ময়না অ্যালবামটিতে একই সদস্যেরা ছিলেন এবং আরও ছিলেন খায়েম পিয়ারু (বেজ গীটার), ইমন ও মিন্টু (কীবোর্ডস)।

কষ্ট: ১৯৯৫,

১৯৯০ সালের শেষের দিকে সোলস ব্যান্ডটি ত্যাগ করে বাচ্চু ১৯৯১ সালে ঢাকায় আসেন। ওই বছরের ৩১শে জানুয়ারি বাচ্চু তার বান্ধবি ফেরদৌস চন্দনা কে বিয়ে করেন। ৫ই এপ্রিল বাচ্চু তার ব্যান্ড এল আর বি গঠন করেন। ওই বছর থেকেই নিজের ব্যান্ডের সাথে ব্যাস্ত থাকায় বাচ্চু নিজের কোনো অ্যালবাম বের করেনি। ১৯৯৫ সালে এল আর বি এর ঘুমন্ত শহরে অ্যালবামের পর বাচ্চু নিজের অ্যালবাম কষ্ট রেকর্ড করার জন্যে অডিও আর্ট স্টুডিও তে যান, যেখানে তার ব্যান্ডের অ্যালবামটি রেকর্ড করা হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের অক্টোবরে অ্যালবামটি সাউন্ডটেক ইলেকট্রনিকস থেকে বের হয়। অ্যালবামটি বের হওয়া মাত্রই প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনেকের মতে এটি বাচ্চুর সবচেয়ে সেরা অ্যালবাম। “কষ্ট পেতে ভালোবাসি”, “কষ্ট কাকে বলে” এবং “জেগে আছি একা” এর মতো জনপ্রিয় কিছু গান আছে অ্যালবামটিতে। আজম বাবু ছিলেন অ্যালবামের প্রযোজক আর বাচ্চু ছিলেন সহ-প্রযোজক। বাচ্চুর ব্যান্ড এল আর বি এর সদস্য এস আই টুটুল এই অ্যালবামে কীবোর্ডস বাজিয়েছিল এবং ফিলিংস ব্যান্ডের এহসান এলাহি ফান্টি অ্যালবামটিতে ড্রামস বাজিয়েছিল। এক বছরের ভেতরেই অ্যালবামটির ৩ লক্ষ কপি বিক্রিত হয়েছিল।

সময় ও একা: ১৯৯৮-১৯৯৯,

যদিও বাচ্চু সোলস ছেড়ে দিয়েছিল, হার্ড রক গান করার জন্যে, একজন একক শিল্পী হিসেবে সে মূলত পপ রক ও সফট রক ঘরানার গান করতো। সংগীত জীবনের শুরু থেকেই বাচ্চু ব্লুজ, জ্যাজ ও ফাংক ঘরানার গানের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিল৷ সে তার ব্যান্ড এল আর বির অনেক গানে এইসব ঘরানার গান করেছে, কিন্তু সে তার একক সংগীত জীবনেও তার ব্যবহার করতে চেয়েছিল। ১৯৯৮ সালের শুরুর দিকে সে এবি কিচেন নামের একটি স্টুডিও গঠন করে ঢাকার মগবাজারে, যা পরবর্তীকালে একটি রেকর্ড লেবেলে পরিণত হয়। বাচ্চু একজন একক শিল্পী হিসেবে একটি ডবল অ্যালবাম বের করতে চেয়েছিল। তাই সে তার চতুর্থ ও পঞ্চম অ্যালবামটি একটি ডবল অ্যালবাম হিসেবে বের করার চিন্তা করে৷ ১৯৯৮ এর মাঝামাঝি সময়ে অ্যালবাম দুটির রেকর্ড শুরু হয় তার নিজের স্টুডিওতে। ১৯৯৯ সালের শুরুর দিকে সময় ও একা অ্যালবাম দুটি সাউন্ডটেক ইলেকট্রনিকস থেকে বের হয়৷ তার পূর্বের অ্যালবাম গুলোর তুলনায় এই দুটি অ্যালবাম তেমন একটি কপি বিক্রি ও করেনি আর মানুষের তেমন পছন্দ ও হয়নি৷ বাচ্চু এই অ্যালবাম দুটি সম্পর্কে বলেছিলেন যে:

“ওই দুটি অ্যালবাম মানুষ একেবারেই পছন্দ করেননি৷ আমার প্রতিদিনের দর্শকেরা ভেবেছিল যে, অ্যালবাম গুলো বেশি বাজে হয়েছে। তারা তেমন কিছু চায়নি। এরপর আমি আমার একক সংগীত জীবনে তেমন একটা অন্য ঘরানার সাথে রক গান করিনি। কেউ যদি পছন্দ না করে অ্যালবাম বের করে লাভ কি?”

ব্যক্তিগত জীবন:

আইয়ুব বাচ্চু ১৯৮৬ সালে যখন তার একক অ্যালবাম রক্ত গোলাপ রেকর্ডের জন্যে ঢাকায় আসে তখন সে তার এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিল। তার বন্ধুর বাসায় একটি আয়নায় ফেরদৌস চন্দনার ছবি লাগানো ছিল৷ বাচ্চু সেই ছবি দেখেই তার বন্ধুকে বলেছিল যে, “সে চন্দনাকে বিয়ে করতে চায়”। তার সাথে যখন চন্দনার দেখা হয় তখন তারা একজন আরেকজন খুবই পছন্দ করে ফেলে৷ পরে যখন চন্দনার পরিবারে সবাই বাচ্চুর ব্যাপারে জেনে যায়, তখন তারা তাকে বাচ্চুর সাথে দেখা করতে দিত না। বাচ্চু বলেছিল যে, তার ব্যান্ড এলআরবি এর প্রথম অ্যালবাম এল আর বি – ১ এর একটি গান “ফেরারি মন”, চন্দনাকে যখন তার পরিবার বাচ্চুর সাথে দেখা করতে দিচ্ছিলেন না, তখন বাচ্চুর কেমন মনে হচ্ছিলো তার কথাই বলে: “ফেরারি এই মনটা আমার, মানে না, কোনো বাধা৷ তোমাকে পাওয়ারই আশাই। ফিরে আসে বারে বার।” বাচ্চু তখন ঢাকায় এলিফ্যান্ট রোড এর একটি বাসায় থাকতো। তার কাছে মাত্র ৬০০ টাকা ছিল, যা দিয়ে সে কিছুই করতে পারছিলোনা৷ অ্যালবাম রেকর্ড করে সে আবার চট্টগ্রাম চলে আসে। কিন্তু তাও সে প্রায় সময়েই চন্দনা কে দেখতে ঢাকা আসতো৷ যখন সে ১৯৯০ এর শেষের দিকে সোলস ছেড়ে দেয়, তখন সে ঢাকায় আসে আর চন্দনা কে বিয়ের প্রস্তাব দেয়৷ চন্দনার পরিবার প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হয়ে যায়। ১৯৯১ সালের ৩১শে জানুয়ারি বাচ্চু চন্দনা কে বিয়ে করে। তাদের দুটি সন্তান আছে: মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব (জ. ১৯৯৪) এবং ছেলে আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব (জ. ১৯৯৬)।

মৃত্যু:

আইয়ুব বাচ্চুর ফুসফুসে পানি জমার কারণে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন (২৭ নভেম্বর, ২০১২)।সেখানে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি সুস্থ হন।

বাচ্চু ১৮ই অক্টোবর ২০১৮ সালে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। একই দিন সকালে অসুস্থবোধ করায় তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তাররা ৯টা ৫৫ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

স্বীকৃতি:

আইয়ুব বাচ্চুকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে ১৮ ফুট উচ্চতার একটি গিটারের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। রূপালী গিটার আইয়ুব বাচ্চুর একটি জনপ্রিয় গানের শিরোনাম অনুসারে এই ভাস্কর্যের নাম রাখা হয় রূপালী গিটার। চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন।

ডিস্কোগ্রাফি:

ব্যান্ড অ্যালবাম

★ এল আর বি ১ ও এল আর বি ২ (ডেবু ও বাংলাদেশের প্রথম ডাবল এলবাম ) (১৯৯২)

★ সুখ (১৯৯৩)

★ তবুও (১৯৯৪)

★ ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫)

★ স্বপ্ন (১৯৯৬)

★ আমাদের বিস্ময় (ডাবল এলবাম) (১৯৯৮)

★ মন চাইলে মন পাবে (২০০১)

★ অচেনা জীবন (২০০৩)

★ মনে আছে নাকি নাই (২০০৫)

★ স্পর্শ (২০০৭)

★ যুদ্ধ (২০১২)

একক অ্যালবাম:

রক্ত গোলাপ (১৯৮৬)
ময়না (১৯৮৮)
কষ্ট (১৯৯৫)
সময় (১৯৯৮)
একা (১৯৯৯)
প্রেম তুমি কি! (২০০২)
দুটি মন (২০০২)
কাফেলা (২০০২)
প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩)
পথের গান (২০০৪)
ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬)
জীবন (২০০৬)
সাউন্ড অব সাইলেন্স (২০০৭)
রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮)
বলিনি কখনো (২০০৯)
জীবনের গল্প (২০১৫)

সোলস:

সুপার সোলস (১৯৮২)
কলেজের করিডোরে (১৯৮৫)
মানুষ মাটির কাছাকাছি (১৯৮৭)
ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট (১৯৮৮)

নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী:

লুটতরাজ (১৯৯৬)
সাগরিকা (১৯৯৮)
লাল বাদশা (১৯৯৯)
আম্মাজান (১৯৯৯)
গুন্ডা নাম্বার ওয়ান (২০০০)
ব্যাচেলর (২০০৪)
রং নাম্বার (২০০৪)
চাঁদের মত বউ (২০০৯)
৮:০৮-এর বনগাঁ লোকাল (২০১২)
চোরাবালি (২০১২)
টেলিভিশন (২০১৩)
এক কাপ চা (২০১৪)

আইয়ুব বাচ্চুর গানের বাণিজ্যিক ব্যবহারের অধিকার শুধু উত্তরাধিকারীদের:

‘এলআরবি একটি পরিবার। সারা জীবন এ পরিবার থাকবে। আমরা না থাকলেও আমাদের উত্তরাধিকারীরা এই পরিবারে থাকবে। তারাই এগিয়ে নিয়ে যাবে এলআরবিকে।’ প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটিই বলেছিলেন এলআরবি ব্যান্ডের প্রধান উদ্যোক্তা শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। দুই বছর হতে চলেছে নিজের ‘রুপালি গিটার’ ফেলে তিনি চলে গেছেন। রয়ে গেছে তাঁর সংগীতকর্ম, প্রশ্ন উঠেছে এসবের মেধাস্বত্ব বা কপিরাইট নিয়ে। তাঁর গাওয়া, সুর করা গান নিয়ে নানা আলাপ চলছে হরহামেশা, তাঁর ব্যান্ড দল নিয়ে ঘটছে নানা ঘটনা। যে যেভাবে পারছেন, ব্যবহার করছেন তাঁর গান। তবে কি আইয়ুব বাচ্চুর অনুপস্থিতিতে তাঁর গান এবং এলআরবি হয়ে যাবে নাটাইছেঁড়া ঘুড়ি?

বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস সূত্রে জানা গেছে, মোট ২৬টি অ্যালবাম নিবন্ধন করেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সেগুলোর মধ্যে ১৩টি একক এবং ১৩টি ব্যান্ড অ্যালবাম। এই ২৬ অ্যালবামের সব গান আইয়ুব বাচ্চুর নামে নিবন্ধিত। অর্থাৎ ব্যক্তি আইয়ুব বাচ্চুর নামে, এলআরবি ব্যান্ডের নামে নয়। নিয়ম অনুযায়ী কপিরাইট অফিসে কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের লোগোর নিবন্ধন হয়। এলআরবির লোগোটিও নিবন্ধিত হয়েছে, একই সঙ্গে ‘এলআরবি’ নামটি তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও শুধু আইয়ুব বাচ্চুর নামেই এলআরবির লোগো এবং নাম নিবন্ধন করা হয়েছে। তাঁর গানগুলো এবং এলআরবির মালিকানা কেবল আইয়ুব বাচ্চুর উত্তরাধিকারীদের।

রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস (যুগ্ম সচিব) জাফর রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু গানগুলো ব্যক্তি আইয়ুব বাচ্চু নিজের নামে নিবন্ধন করেছেন, সেহেতু বাণিজ্যিকভাবে এ গানগুলো ব্যবহারের অধিকার কেবল তাঁর আইনগত উত্তরাধিকারীদের। অন্য শিল্পী বা দূরে থাকা এলআরবির অন্য সদস্যরা এ গানগুলো বাণিজ্যিকভাবে পরিবেশন করতে পারবেন না।’ কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, আইয়ুব বাচ্চুই দেশের প্রথম অনলাইন নিবন্ধন আবেদনকারী। ই-কপিরাইট সিস্টেমে কোনো সৃজনকর্মের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের প্রথম আবেদনকারী আইয়ুব বাচ্চু তাঁর ‘জীবনের গল্প’ অ্যালবামটি ই-কপিরাইট পদ্ধতিতে নিবন্ধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করেছিলেন।

এটা স্পষ্ট, নিবন্ধন অনুযায়ী এলআরবির মালিক শুধু তাঁর দুই সন্তান, ফাইরুয সাফরা আইয়ুব এবং আহনাফ তাযওয়ার আইয়ুব। সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন তাঁরা। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি আমাদের অনুমতি ছাড়াই তাঁর (আইয়ুব বাচ্চুর) লেখা, সুরারোপিত ও গাওয়া গানগুলোর স্ট্যান্ডার্ড বজায় না রেখে যেনতেনভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে গাইছেন, এমনকি বাণিজ্যিকভাবেও ব্যবহার করছেন।

এখন থেকে আমাদের সম্মতি ছাড়া এলআরবি নামের অপব্যবহার করে আইয়ুব বাচ্চুর কপিরাইট করা গানগুলো পরিবেশন থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করছি। অন্যথায় আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’ তাঁদের ভাষায়, ‘বাবুই তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের মাঝে যেভাবে ছিলেন, সেভাবেই যেন থাকেন, সেটাই আমরা শতভাগ নিশ্চিত করব। আইয়ুব বাচ্চুর ভক্তদের কাছে একটাই চাওয়া-এই মুহূর্তে তাঁর সৃষ্টিকর্মের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটু সময় দিন। আমরা বাবা হারিয়েছি, কিন্তু আইয়ুব বাচ্চুকে আপনারা কোনো দিন হারাবেন না, তিনি আপনাদেরই থাকবেন।’

ভক্তদের মনে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে, আইয়ুব বাচ্চুর গিটারগুলো কোথায়? প্রথম আলোর সঙ্গে এক আলাপে তৎকালীন এলআরবির অন্যতম সদস্য মাসুদ জানান, কিছু গিটার আইয়ুব বাচ্চু বিক্রি করেছিলেন, কিছু উপহার হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছিলেন। বাকি গিটারগুলোর ছবি তুলে বিস্তারিত তথ্যসহ আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি সেগুলো বাসায় নিয়ে গেছেন। আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রী চন্দনা ফেরদৌস আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্তানেরা আপাতত তাঁদের বাবার সৃষ্টিকর্মের আইনি মালিকানার প্রতিকূলতা নিয়ে ভাবছে। গিটার নিয়ে সামনে আমাদের বড় পরিকল্পনা আছে। যথাসময়ে সেটা জানানো হবে।’ তিনি জানান, আইয়ুব বাচ্চুর অবশিষ্ট গিটার রয়েছে ৫০টি।

আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর দু’বছর পর এলআরবি এখন কোন পথে?

নব্বইয়ের দশক থেকে আজকের দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের রক মিউজিক শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় গানের দল বা ব্যান্ড “এলআরবি”। ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর থেকে এর কার্যক্রম এক প্রকার থমকে আছে। প্রায় তিন দশকের পুরান এই ব্যান্ডটি কবে আবার পুনর্দমে চালু হবে সেটা নিয়েও ধোঁয়াশা কাটছে না। লাভ রানস ব্লাইন্ড ‘এলআরবি’ ব্যান্ড ১৯৯১ সালের ৫ই এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে। শুরুটা হয়েছিল ইংরেজি গানের কভার থেকে। তারপর রক, সফট রক, হার্ড-রক, ব্লুজ, অল্টারনেটিভ রক, মেলোডি- এমন নানা জনরার গানের সাথে শ্রোতাদের পরিচয় হতে থাকে এই ব্যান্ডের মাধ্যমে। আইয়ুব বাচ্চুই একাধারে ছিলেনে এই ব্যান্ডটির গায়ক, লিড গিটারিস্ট, গীতিকার ও সুরকার।

তবে ব্যান্ডটির প্রথম নাম এলআরবি নয় বরং ছিল ওয়াইআরবি – ইয়েলো রিভার ব্যান্ড। সে সময় একটি ক্লাবে পারফর্ম করার সময় সেখানকার উদ্যোক্তারা ভুল করে ব্যান্ডটির নাম লেখেন – লিটল রিভার ব্যান্ড। সেই ভুলটাই আইয়ুব বাচ্চুর পছন্দ হয়ে যাওয়ায় ব্যান্ডটি পরিচিতি পায় এলআরবি নামে। কিন্তু পরে জানা যায় যে, এই একই নামে অস্ট্রেলিয়াতে আরেকটি ব্যান্ড রয়েছে। কিন্তু এলআরবি নামটি ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের শ্রোতাদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠায়, নামটি পরিবর্তন করতেও চাইছিলেন না ব্যান্ডের সদস্যরা। এমন অবস্থায় এল-আর-বি এই তিনটি অক্ষর ঠিক রেখে এর ভেতরের শব্দ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর আইয়ুব বাচ্চু এলআরবির নাম রাখেন “লাভ রানস ব্লাইন্ড”। নতুন এই নামেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসছে সঙ্গীতের এই দলটি। এলআরবির প্রায় প্রতিটি অ্যালবাম সুপারহিট হওয়ায় রাতারাতি তারা জনপ্রিয়তা শীর্ষে উঠে যায়। এমনও হয়েছে যে অ্যালবাম বাজারে আসতে দেরি হওয়ায় শ্রোতাদের অসংখ্য ফোন পেতে হয়েছে রেকর্ড বিক্রেতাদের।

বালামের সংযুক্তি:

তবে ২০১৮ সালের ১৮ই অক্টোবর ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর ব্যান্ডের ভেতরে নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ায় এই এলআরবি’র ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ২০১৯ সালে মাঝামাঝি সময়ে ব্যান্ডটির নতুন শিল্পী হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন বালাম। তবে এ নিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর পরিবার এবং ব্যান্ডের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। আইয়ুব বাচ্চুর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, তারা এলআরবির নাম ব্যবহার করে গান গাইতে পারবে না। এমন অবস্থায় এলআরবি ছেড়ে বালাম গঠন করেন নতুন ব্যান্ড “বালাম এন্ড দ্য লিগ্যাসি”।

এ ধরনের একের পর এক ঘটনার পর শ্রোতাদের মনে প্রশ্ন জাগে: তাহলে কি আইয়ুব বাচ্চুর সাথে এলআরবি ব্যান্ডও চির বিদায় নিতে যাচ্ছে? জনপ্রিয় ব্যান্ডটির টিকে থাকা নিয়ে এমন অনিশ্চয়তা যেন কিছুতেই মানতে পারছিলেন না ভক্তরা। এজন্য আইয়ুব বাচ্চুর পরিবারকেও ভক্তদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। পরে আইয়ুব বাচ্চুর ছেলে এবং ‘আইনগতভাবে ব্যান্ডটির একজন উত্তরাধিকার’ আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব গত বছরের ৫ই এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে জানান যে তিনি ও তার পরিবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। তারা চান ব্যান্ড সদস্যরা ‘বালাম এন্ড দ্য লিগ্যাসি’ নয় বরং এলআরবি নামেই এগিয়ে যাক এবং তারা ‘এলআরবি’ নামে গান করতে পারেন। এ নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও বাধা নেই। আইয়ুব বাচ্চুর পরিবারের এমন আহ্বানের পর “বালাম অ্যান্ড দ্য লিগ্যাসি” তাদের এই নতুন দল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে । তারা পুনরায় এলআরবিতেই ফেরেন।

ব্যান্ডে বিভক্তি:

কিন্তু সেই সিদ্ধান্তও বেশিদিন টেকেনি। কারণ শিল্পী বালামকে নিয়ে এলআরবি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্তে আবার ব্যান্ড সদস্যদের মধ্যেও বিভক্তি দেখা দিতে শুরু করে। ব্যান্ডের একটি পক্ষ চাইছিল বিরতি নিতে এবং ‘ভয়েস হান্টের’ মাধ্যমে নতুন ভোকাল নিয়ে যাত্রা শুরু করতে। অন্যদিকে আরেকপক্ষ চাইছিল বালামকে নিয়েই দ্রুত এই ব্যান্ডের কার্যক্রম শুরু করতে। মতের অমিল হওয়ায় ব্যান্ড থেকে সরে দাঁড়ান গিটারিস্ট আবদুল্লাহ আল মাসুদ এবং ম্যানেজার শামীম আহমেদ। এ নিয়ে শামীম আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দোষটা আসলে আমাদেরই। বাচ্চু ভাই মারা যাওয়ার পর আমরা কেউ ঠিকমতো ব্যান্ডটাকে লিড করতে পারছিলাম না। এ কারণে অনেক ভুলভ্রান্তির জন্ম হয়েছে।”

এরপর ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বেইজ গিটারিস্ট স্বপন পরে ড্রামার রোমেলকে নিয়ে ‘এলআরবি’র নতুন লাইনআপ সাজানোর চেষ্টা করেন। সেটাও বেশিদূর এগোয়নি।

Related posts

ভগবান বিষ্ণুর রাম অবতার: নেপথ্যের কাহিনি

Sanjibon Das

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু,ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি নেতা

News Desk

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা জন্ম, পেশা, ধর্ম, কর্মজীবন ও রাজনৈতিক জীবন

News Desk

Leave a Comment