Image default
ইসলাম

ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উত্তম সমাজ গঠনের উপায়

নবীগণের মুল দাওয়াত

হযরত মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর যে বাণী নিয়ে দুনিয়ায় এসেছিলেন তা ছিল সৃষ্টির আদিকাল থেকে আল্লাহর নবীগণ কর্তৃক প্রচারিত বাণী পরস্পরারই সর্বশেষ ধাপ। মাবনজাতির সমগ্র ইতিহাস জুড়ে এ বাণী এক ও অভিন্নরূপে বিরাজমান। আর তা হচ্ছে, এক ও অদ্বিতীয় প্রভু এবং প্রতিপালককে স্বীকার করে নিয়ে তার সমীপে আত্মসমর্পণ ও মানুষের সকল প্রকার প্রভুত্বের অবসান ঘোষণা। মানবজাতির ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দু’একজন লোক ছাড়া মানব সমাজ সামগ্রিকভাবে কখনো আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব কিংবা বিশ্ব-জগতের উপর তার সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করেননি।

বরং তারা সমান্তরে আল্লাহ তাআলার গুণাবলী সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেছে অথবা তার সাহায্যকারী হিসেবে আরও অনেক খোদার কল্পনা করেছে। তারা আকীদা-বিশ্বাস এবং পূজা-উপাসনার ক্ষেত্রে অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন শক্তির সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতির মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্যকারী বা অংশীদার নিরূপন করেছে।এ উভয়বিধ পন্থায় শিরক।* কারণ এগুলো মানুষের আন্বিয়া আলাইনিহিমকুস সালামের প্রতি অবতীর্ণ দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। প্রত্যেক নবীর তিরোধানের পর তাঁর অনুসারীগণ কিছুকাল সঠিকভাবে দ্বীনের নির্দেশ মুতাবিক জীবন যাপন করেন। কিন্তু দীর্ঘকাল পর ক্রমে ক্রমে তারা ভ্রান্তির পথে অগ্রসর হয়। এমন কি তারা পুনরায় জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে শিরকের জীবন যাপন শুরু করে। কোন কোন সময় ঈমান-আকীদা ও পূজা –উপাসনায় শির্‌ক করে। কোন কোন সময় আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তির সার্বভৌম ক্ষমতা স্বীকার করে, আবার কোন সময় উভয় প্রকারের শির্‌কেই তারা লিপ্ত হয়।

সৃষ্ট জগতে মানুষের মর্যাদা

ইতিহাসের সকল স্তরেই আল্লাহর দ্বীন একই ধরনের বাণী পেশ করছে। এ দ্বীনের লক্ষ্য হচ্ছে ইসলাম। ইসলামের অর্থ মানুষকে আল্লাহর অনুগত ও ফরমাবরদার করা এবং মানুষের দাসত্ব থেকে তাদেরকে মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর দাসত্বে নিয়োজিত করা; মানুষের সার্বভৌমত্ব থেকে মানব রচিত জীবন বিধান ও মূল্যবোধের অক্টোপাশ থেকে মানব সমাজকে উদ্ধার করে জীবনের সকল দিক ও বিভাগে আল্লাহ তাআল্লার সার্বভৌমত্ব, কর্তৃত্ব ও আইন-বিধান প্রবর্তন করা। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এ উদ্দেশ্য নিয়েই দুনিয়ায় এসেছিলেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী নবীগণেরও ঐ একই দায়িত্ব ছিল।

সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি আল্লাহ তাআলার আইন-শাসন মেনে চলছে এবং মানুষ বিশ্বপ্রকৃতিরই একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ হিসেবে প্রাকৃতিক আইন মেনে চলতে বাধ্য। মানব দেহের অংগ-প্রত্যংগ যে আইন মেনে চলছে তার সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য ব্যবহারিক জীবনেও বিধানদাতা আল্লাহর আইন-শাসন মেনে চলা অপরিহার্য। মানুষ কখনো এ আইনের শাসন প্রত্যাখ্যান করে নিজের জন্যে একটি পৃথক ব্যবস্থা বা জীবন যাপনের ভিন্ন পন্থা আবিস্কার করতে পারে না। মানুষের দেহে পুষ্টি সাধন, তার রোগ ও সুস্থতা, জীবন ও মরণ সবকিছুই আল্লাহর আইনের নিকটে সম্পূর্ণ অসহায়। বিশ্ব-জগতে বিরাজমান আল্লাহর বিধান পরিবর্তনের কোন শক্তিই মানুষের নেই। তাই জীবনের যে অংশে মানুষকে আল্লাহ তাআলার বিধান মানা বা না মানার অধিকার দান করা হয়েছে, সে অংশেও আল্লাহর সার্বভৌম সর্তৃত্ব মেনে নিয়ে জীবনে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য স্থাপন দরকার।

জাহেলিয়াতের অক্টোপাশ থেকে মুক্তির উপায়

জাহেলিয়াত প্রকৃতপক্ষে মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্বেরই অপর নাম। তাই এটা প্রাকৃতিক জগতে প্রচলিত আইনের পরিপন্থী। জাহেলিয়াতের আদর্শ গ্রহণের ফলে মানুষ জীবনের যে অংশ প্রাকৃতিক বিধান মেনে চলতে বাধ্য সে অংশের সাথে ব্যবহারিক জীবনে সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর পূর্ববর্তী সকল নবীগণ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার বাণী প্রচার করে উপরোক্ত জাহেলিয়াতের উপরই আঘাত হেনেছিলেন। জাহেলিয়াত একটি মতবাদ মাত্র নয়। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তার কোন মতবাদই নেই। জাহেলিয়াতের সর্বত্রই একটি প্রতিষ্ঠিত সমাজের রূপধারণ করে এবং একটি সক্রিয় আন্দোলন সর্বদাই প্রতিষ্ঠিত সমাজের রূপধারণ করে এবং একটি সক্রিয় আন্দোলন সর্বদাই তার পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। এ সমাজ তার নিজস্ব নেতৃত্ব, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, স্বভাব-প্রকৃতি ও চিন্তা-ভাবনা প্রবর্তন করে। জাহেলিয়াত সুসংগঠিত।

এ সমাজের লোকেরা পারস্পরিক যোগাযোগ, সহযোগিতা, সংগঠন ও শৃংখলার মাধ্যমে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হয় যে, সমগ্র সমাজ নিজেদের জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে ঐ সমাজ ব্যবস্থা সংরক্ষণের জন্যে সমভাবে তৎপর থাকে ; তার অস্তিত্বের জন্যে যারা অনিষ্টকারী বিবেচিত হয় তাদেরকে সে ধরাপৃষ্ঠ থেকে সরিয়ে দেয়। জাহেলিয়াত যখন একটি মতবাদ মাত্র না হয়ে একটি সক্রিয় আন্দোলনের রূপ ধারণা করে তখন তাকে উৎখাত করে মানব সমাজকে পুনরায় আল্লাহ তাআলার বন্দগীর অধীনে আনয়নের জন্য ইসলামী আদর্শকে নিছক একটি মতবাদ হিসেবে পেশ করে কখনো সফলতা অর্জন করা যাবে না।

জাহেলিয়াত বস্তুজগতকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং একটি সক্রিয় সংগঠণ তার পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বদা সক্রিয় রয়েছে। এমতাবস্থায় শুধু মতবাদের সাহায্যে তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াই করা তো দূরের কথা তার সামনে দাঁড়ানোও সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই এ সিদ্ধান্তে পৌছতে হয় যে, প্রতিষ্ঠিত জাহেলিয়াতের আদর্শকে উৎখাত করে সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও রীতিনীতি বিশিষ্ট আদর্শ প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের লক্ষ্য এবং জাহেলিয়াত একটি সুসংগঠিত সমাজ ও সংগঠন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে তাকে উৎখাত করার অভিযানও একটি সুসংগঠিত আন্দোলনের রূপ ধারণ করেই রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবে। আর এ নতুন আন্দোলন জাহেলিয়াতের তুলনায় অধিকতর সংগঠিত এবং আন্দোলনকারীদের পারস্পরিক সম্পর্ক অধিকতর দৃঢ় ও শক্তিশালী হতে হবে।

ইসলামী সমাজের আদর্শিক ভিত্তি

ইসলামী ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে যে আদর্শিক বুনিয়াদের উপর তার নিজস্ব সমাজ রচনা করেছে তা হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার সাক্ষ্য দান। এ কালেমার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ-ই প্রভু, তিনিই বিশ্ব-জগতের ব্যবস্থাপক, তিনিই প্রকৃত শাসক এবং সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। মন-মস্তিষ্ক তাঁরই একত্বের নূরে উদ্ভাসিত হতে হবে। ইবাদাত-বন্দগীতে তাঁর একত্বের প্রমাণ পেশ করতে হবে। ব্যবহারিক জীবনের রীতিনীতি আইন –কানুনে তাঁর একত্বের পরিস্ফুরণ হতে হবে। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষ্য এরূপ পরিপূর্ণ সার্বিক পন্থা ব্যতীত বাস্তব ক্ষেত্রে অন্য কোন প্রকারে দেয়া যেতে পারবে না। শরীয়তের দিক দিয়েও এ ধরনের সাক্ষ্যই হবে নির্ভরযোগ্য।

এ পূর্ণাঙ্গ সার্বিক পন্থা মৌখিক সাক্ষ্যকে এমন এক কার্যকর ব্যবস্থার রূপদান করে যার ভিত্তিতে এ সাক্ষ্যদানকারীকে মুসলিম এবং এর প্রত্যাখ্যানকারীকে অমুসলিম বলা যেতে পারে। আদর্শের দিক দিয়ে এ ভিত্তি স্থাপনের অর্থ এই যে, মানব জীবনকে পুরোপুরি আল্লাহর আনুগত্যের অধীন করে দিতে হবে। জীবনের কোন ক্ষেত্রেও মানুষ নিজেই কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। বরং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাঁরই আনুগত্য করবে। আল্লাহর নির্দেশ জানবার একটি মাত্র উপায় আছে এবং তাহলো আল্লাহর রাসূল। কালেমায়ে শাহাদাতের দ্বিতীয় অংশে এ উপায়কে ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ বলা হয়েছে। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ — আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসূল।
এ হলো সেই আদর্শিক বুনিয়াদ যার উপরে ইসলামী প্রাসাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এটাই হলো ইসলামের প্রকৃত প্রাণবস্তু। এ ভিত্তি মানব জীবনের পূর্নাংগ জীবন বিধান রচনা করে যা জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করতে হবে। এ জীবন বিধান প্রতিটি সমস্যার সমাধান করে। সে সমস্যা দারুল ইসলামে উদ্ভুত হোকা অতবা তার বাইরে। মুসলিম সমাজের সাথে সম্পৃক্ত সম্পর্ক সন্বন্ধের বেলায় হোক অথবা মুসলিম সমাজ ও অমুসলিম সমাজের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের বেলায়।

জাহেলী সমাজের মুসলমান অধিবাসী

উপরের বর্ণনা অনুযায়ী ইসলাম এমন কোন স্থবির ও অর্থহীন মতবাদ নয় যে, ইচ্ছা করলে কেউ তাকে একটি আকীদা-বিশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করবে এবং পূজা পাঠ করেই তার কাজ তার কাজ শেষ করবে। অতপর বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও সক্রিয় জাহেলী সমাজের অনুসারী হয়ে চলবে। ইসলাম গ্রহণকারীদের অবস্থা এমন হলে বাস্তবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়; তারা সংখ্যায় যত বেশীই হোক না কেন। কারণ, যেসব তথাকথিত মুসলমান জাহেলী সমাজের অংগ-প্রত্যংগ হয়ে পড়ে, তারা অবশ্যম্ভাবীরূপে সে সমাজেরই সাংগাঠনিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য থাকবে। অতপর ঐসব মৌলিক প্রয়োজন যা সমাজ জীবনের প্রাণ-চাঞ্চল্য ও অস্তিত্বের জন্য অনিবার্য, তা পূর্ণ করার জন্যে জ্ঞাতে হোক অজ্ঞাতে হোক তৎপর হয়ে পড়বে। অধিকন্তু এ সমাজের রক্ষক হিসেবে দণ্ডায়মান হবে এবং যেসব উপায়-উপাদান তার অস্তিত্ব ও ব্যবস্থাপনার জন্যে বিপজ্জনক মনে হবে তার উচ্ছেদ সাধন করবে। কারণ, গোটা সমাজ যখন এ সমুদয় কর্তব্য সম্পাদন করবে, তখন তার অনিবার্য অংশরূপে জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে সেসব কর্তব্য সম্পাদনের জন্যে গোটা সমাজের সাথেই চলতে হবে।

জাহেলী পরিবেশে ইসলামী পুনর্জাগরণের পন্থা

যে মুহূর্তে এক ব্যক্তির মুখ থেকে কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লহু মুহাম্মাদুর রাসূলল্লাহ উচ্চারিত হয় ঠিক সে মুহূর্ত থেকেই বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ বিপ্লবী পদক্ষেপ ব্যতীত মুসলিম সমাজ বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারেনা দুনিয়ার মৌলিক ইসলাম বিশ্বাসী এ ইসলাম দরদীর সংখ্যা যত বেশীই হোক না কেন, তারা যতদিন পর্যন্ত না পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে উঠবে এবং একটি জীবন্ত মানব দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মত যতদিন না বিভিন্ন শ্রেণীর লোক সংগঠিত হয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করবে এবং আক্রমণকারী শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্যে জাহেলিয়াতের সমাজ থেকে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত নেতৃত্বের অধীনে যে পর্যন্ত সংঘবদ্ধ আন্দোলন শুরু না করবে, সে পর্যন্ত ইসলামী সমাজ কায়েম হতে পারবে না। এ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে উল্লেখিত নেতৃত্ব একমূখী উদ্যম-প্রচেষ্টা, সাংগঠনিক কর্মতৎপরতার সামঞ্জস্য বিধান, ইসলামী চরিত্র গঠন ও তার বিকাশ সাধন এবং বাতিল সমাজের সকল প্রভাব পরিশুদ্ধি করণের মাধ্যমে আন্দোলনকে গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

ইসলাম এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একটা সংক্ষিপ্ত আকীদা-বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে ইসলাম সমগ্র জীবনকেই পরিবেষ্টিত করে নেয়। এ জীবন বিধানের প্রতি ঈমান আনয়নের সাথে সাথেই একটি বলিষ্ঠ ও সক্রিয় আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল। এ আন্দোলন শুধু জাহেলিয়াত থেকে নিজকে পৃথক করে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, উপরন্তু প্রতিষ্ঠিত বাতিল সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বাস্তবে অস্তিত্বহীন একটি কাল্পনিক মতবাদ হিসেবে ইসলাম দুনিয়ায় আসেনি। আর ভবিস্যমেও তার অস্তিত্ব একটি বাস্তব ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রকাশ লাভ করতে পারে। জাহেলি সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান অন্ধকারে যদি নতুন করে ইসলামের আলোকবর্তিকা প্রজ্জলিত করা যায়, তাহলে যে কোন যুগ ও দেশের জন্যে এ ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না যে, প্রথমেন ইসলামের এ মেজাজ –প্রকৃতি অনিবার্যরূপে বুঝে নিতে হবে। আর তা হচ্ছে এই যে, তার পরিস্ফুরণ ও উন্নতি একটি আন্দোলন এবং আংগিক ব্যবস্থা ব্যতিরেকে কিছুতেই সম্ভব নয়।

মানবতার উন্নয়ন

উপরে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে ইসলাম যখন তাওহীদের ভিত্তিতে একটি মুসলিম উম্মাতের ভিত্তি রচনা করে এবং অতপর এ উম্মাত যখন সক্রিয় হয়ে একমাত্র তাওহীদী বিশ্বাসই পারস্পরিক সম্পর্কের যোগসূত্র নির্ধারণ করে, তখন তার প্রধান লক্ষ্য হয় মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত ও উন্নত করা, তাকে বলিষ্ট ও শক্তিশালী করে তোলা এবং মনুষ্যত্বকে মানুষের অন্যান্য বৃত্তিনিচয়ের উপর প্রাধান্য বিস্তারের গোগ্য করে দেয়া। ইসলাম তার উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে চায়। কোন কোন দিক থেকে পশুর সাথে এমনকি জড় পদার্থের সাথেও মানুষের সাদৃশ্য আছে। তাই জাহেলিয়াতের বৈজ্ঞানিকগণ মানুষকে জন্তু বা কোন কোন ক্ষেত্রে জড় পদার্থ বিবেচনা করার ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জন্তু-জানোয়ার ও জড় পদার্থের সাথে মানুষের অনেক বিষয়ে সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও তার এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলোর কারণা মানুষ সৃষ্টির সেরা হিসেবে গণ্য। জাহেলী বিজ্ঞানের ধারক –বাহকগণও নিরুপায় হয়ে এ বাস্তব সত্যটিকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। তবে তাদের এ স্বীকৃতি আন্তরিকও নয় এবং সুস্পষ্টও নয়।

ইসলামী জীবন পদ্ধতির কল্যাণকারিতা অত্যন্ত বাস্তব ও অতুলনীয়। বর্ণ, ভাষা দেশ, বৈষয়িক স্বার্থ, ভৌগলিক সীমারেখা ইত্যাদির দুর্বল বন্ধনকে ছন্ন করে ইসলাম শুধু ঈমানকেই সমাজ ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি নির্ধারণ করেছে। মানুষ ও পশুর সদৃশ বিষয়গুলোর পরিবর্তে এ সমাজ শুধু মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ সাধন করে। সেগুলোকে মানব সমাজে প্রাধান্য দান করে। সমগ্র বিশ্বব্যাপী এ মহান কাজের সুফল প্রত্যক্ষ করছে। ইসলামী সমাজ একটি উন্মুক্ত ও উদার সমাজে পরিণত হয়। সকল বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চলের লোকদের পক্ষেই এ সমাজের দ্বার চিরতরে উন্মুক্ত হয়ে যায়। ইসলামী সমাজের এ মহাসমুদ্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিভা ও গুণাবলীর নদ-নদীগুলো মিশে একাকার হয়ে যায়। এ মহামিলনের ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের বিস্ময় সৃষ্টিকারী এক সত্যতা সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সেকালে যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল থাকা সত্ত্বেও মানব সমাজের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা চিন্তা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান এ সত্যতার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল।

ইসলামী সমাজের মহাসাগরে আরব, পারস্য, সিরিয়া, মিসর, মরক্কো, তুর্কী, চীন, ভারত, রোম,গ্রীস, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের সকল জাতি ও গোত্রের লোকেরা সমবেত হয়েছিল। তাদের বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য একসূত্রে গ্রথিত হয়ে যায় এবং তারা পারস্পরিক সহযোগিতা ও মেলামেশার মাধ্যমে ইসলামী উম্মাত ও ইসলামী সংস্কৃতি গড়ে তোলার কাজে অংশ গ্রহণ করে। এ মহিমাময় সভ্যতা একদিনের জন্যেও আরব সভ্যতা ছিল না বরং তা ছিল নির্ভেজাল ইসলামী সভ্যতা। আর ইসলামী সভ্যতা কখনও কোন জাতি সৃষ্টি করেনি বরং ঈমানের ভিত্তিতে একটি উম্মাত গঠন করেছিল।

প্রত্যেক দেশের সকল ভাষাভাষী লোক এ সভ্যতা গড়ে তোলার কাজে সমান অংশীদার ছিল। ভালবাসা ও নৈতিকতার বন্ধনে তারা পরস্পরের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করেন। তাঁরা সকলে একই পথের পথিক ছিলেন। তাই বাঞ্ছিত সমাজ গড়ে তোলার জন্যে তাঁরা তাদের সকল যোগ্য তা নিয়োগ করেছিলেন। তাদের গোত্রীয় বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিগত ও জাতীয় গুণাবলী উজাড় করে দিয়ে তারা এ সমাজকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। কারণ, তারা ইসলামী সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকেই সমান দায়িত্বশীল ছিলেন। তাদের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল আল্লাহর সাথে গভীর ভালবাসা। আর তাই এ সমাজ বিনা বাধায় সকলের ব্যক্তিত্ব বিকাশ লাভ করে। সে যুগের লোকদের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়ে উঠে, মানব জাতির ইতিহাসে তার কোন নযীর পাওয়া যায় না।

প্রাচীন ইতিহাসে রোমান সমাজই উত্তম সমাজ হিসেবে পরিচিত। এ সমাজেও বিভিন্ন গোত্র, ভাষা, বর্ণ ও স্বভাবের লোক একত্রিত হয়েছিল। কিন্তু মানবীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে তাদের ঐক্য সংগঠিত হয়নি। কোন উচ্চতর আদর্শ তাদের মধ্যে ঐক্যসূত্র রচনা করেনি। বরং শ্রেণীগত বিভাগই ছিল তাদের একতার ভিত্তি। সমগ্র সাম্রাজ্যটিতে একদিকে ছিল সম্ভ্রান্ত শ্রেণী ও অপরদিকে বিপুল সংখ্যক দাস। এ দু’শ্রেণীই সাম্রাজ্যটিকে দু’টো শ্রেণীতে বিভক্ত করে রেখেছিল। তাছাড়া গোত্রীয় বৈশিষ্ট্যও বিশেষ প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিল। রোমীয় গোত্রের লোকেরা সর্বত্র নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং অন্যান্য গোত্রের সকল লোকই ছিল তাদের দাস। তাই এ সমাজ কখনো ইসলামী সমাজের মত উন্নত মর্যাদায় পৌছতে পারেনি এবং ইসলামী সমাজ মানবতাকে যেসসব কল্যাণ দান করেছে তা দেয়ার সাধ্য এ সমাজের কোন দিনই হয়নি।

আধুনিককালেও বিভিন্ন সমাজ জন্ম লাভ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ বৃটিশ সাম্রাজ্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এটা রোমান সাম্রাজ্যেরই উত্তরাধিকারী। জাতীয় স্বার্থের লোভই এ সাম্যাজ্যের ভিত্তি এবং বৃটিশ জাতি এর নেতা। সাম্রাজ্যের সকল উপনিবেশগুলোকে শোষণ করাই এদের লক্ষ্য। অন্যান্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলোর বেলায়ও ঐ একই কথা প্রযোজ্য। অতীতের স্পেনীয় ও পর্তুগীজ সাম্রাজ্য এবং বর্তমানের ফ্রান্স শোষণ ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে একই পথ অবলন্বব করেছে।

কম্যুনিজম বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও ভৌগলিক জাতীয়তার প্রাচীর ভেঙ্গে দিয়ে একটি নতুন সমাজ গঠন করার দাবী নিয়ে ময়দানে আসে। কিন্তু সে সমাজও মানবতার সম্পর্ক বাদ দিয়ে শ্রেণী বিভাগকে সমাজের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। এদিক দিয়ে কমুনিষ্ট সমাজক প্রাচীন রোমান সমাজেরই অপর দিক। রোমান সমাজে সম্ভ্রান্তদের প্রাধান্য ছিল। কমুনিষ্ট সমাজে প্রলেটোরিয়েটদের প্রাধান্য। অপর শ্রেণীর প্রতি হিংসা ও বিদ্বষ পোষণ করাই এ সমাজের মূলমন্ত্র। এ জাতীয় স্বার্থপর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ সমাজ মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে জাগ্রত করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। পশু প্রবৃত্তিকে উৎক্ষিপ্ত করে অধিকতর শক্তিশালী করাই এর কর্মসূচী। সম্যুনিজমের দৃষ্টিতে মানুষের মৌলিক প্রযোজন পশুরই মত যথা— খাদ্য, বাসস্থান এবং যৌন ক্ষুধার পরিতৃপ্ত। তাই তাদের দৃষ্টিতে মানবজাতির সমগ্র ইতিহাস খাদ্য সংগ্রহের ইতিহাস ব্যতীত আর কিছুই নয়।

ইসলাম-ই একমাত্র আল্লাহর জীবন বিধান যা মানুষের মহান গুণাবলী ও সুকুমার বৃত্তিনিচয়কে জাগ্রত করে বিকাশ সাধনের মাধ্যমে একটি উচ্চমানের মানব সমাজ প্রতিষ্ঠির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। আজ পর্যন্ত ইসলামের এ বৈশিষ্ট্য একক ও নযীর বিহীন। যরা এ ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে জাতীয়তাবাদ, স্বদেশবাদ, বর্ণ, গোত্র, ভাষা বা শ্রেণীর ভিত্তিতে সমাজ গড়ার প্রয়াস পায় তারা প্রকৃতপক্ষে মানবতার দুশমন। তারা মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত গুণাবলীতে বিভূষিত করতে প্রস্তুত নয়। আর তারা এটাও চায় না যে, মানব সমাজ সকল বংশ ও গোত্রের সামগ্রিক গুণাবলী ও যোগ্যতা থেকে উপকৃত হোক এবং একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সম্মিলিত সমাজ গড়ে তুলে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করুক। এ জাতীয় লোকদের সম্পর্কেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

“হে নবী। আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেব না কোন কোন লোক নিজেদের আমলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ? এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত লোক যারা ইহকালের জীবনে ভ্রান্ত পথে চলে এবং মনে করে যে, তারা ঠিক পথ ধরেই চলেছে। তারা তাদেরই রবে র আয়াতগুলোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর দরবারে প্রত্যাবর্তনের প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে। এ জন্যে তাদের সকল আমল নষ্ট হয়ে গেছে এবং কেয়ামতের দিন তাদের কোনই গুরুত্ব থাকবে না। তারা যে কুফরী করেছিল আর আমার আয়াত ও রাসূলগণের প্রতি ঠাট্টা –বিদ্রূপ করতো তার প্রতিদানে তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে” — আল কাহাফ: ১০৩-১০৬

Related posts

আজ মক্কা বিজয় দিবস

News Desk

শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজার আশ্চর্য ফজিলত

News Desk

রমজানের ৩০ দিনের আমল ও ফজিলত

News Desk

Leave a Comment