আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। একটি রক্তগোলাপ ফোটার দিন পার করলো ৫০ বছর। তাই, বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তানি বাহিনীর পাশবিকতাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনা। ১৯৭১ সালে লন্ডন টাইমসে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, রক্তই যদি হয় স্বাধীনতার দাম, তাহলে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ দামেই তা কিনেছে।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় এই জাতির ইতিহাসে প্রধানতম বেদনাদায়ক ও গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা, মহান মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস বর্বরতায় বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘটায় ইতিহাসের জঘণ্যতম গণহত্যা। পাক হানাদারদের পাশবিকতা থেকে প্রাণে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয় প্রায় এক কোটি বাঙালি। দেশজুড়ে খণ্ড খণ্ড প্রতিরোধ যুদ্ধ, এপ্রিলে মুজিব নগর সরকার গঠন, জেনারেল ওসমানীর অধিনায়কত্বে ১১টি সেক্টরে যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ রূপ ফুটে উঠা জুলাই- একেকটি দিন আত্মত্যাগের গৌরবগাঁথা রচনা করতে থাকে বাঙালি জাতি। গেরিলা পদ্ধতিতে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাক বাহিনী ও রাজকাররা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। টানা দুই মাসের বৃষ্টিতেও সুবিধা পেয়েছিল মুক্তিবাহিনী।
বাঙালির স্বাধীনতার প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। তার অনুপস্থিতিতে প্রবাসী সরকার সংগঠিত করেছে মুক্তিযুদ্ধ। দেশের ভেতরে-বাইরে অগণিত শত্রুর রক্তচোখ উপেক্ষা করে তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামরা বাংলাদেশের নাম বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে চালিয়ে গেছেন সংগ্রাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি ও সাহায্য অর্জনের জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন।
প্রথম দিকে নিজস্ব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সুশৃঙ্খল পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাঙালিদের। তারপর ভারতীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রাপ্তিতে গতি সঞ্চারিত হয় সম্মুখ যুদ্ধে। প্রাণ হারানোর ঝুঁকি সত্ত্বেও দেশের মানুষ সর্বতোভাবে মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের সহায়তা করেছে। অস্ত্র ও যুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে বন্ধু রাষ্ট্র ভারত। ট্রেনিং ফেরত গেরিলা যোদ্ধাদের অপরিসীম সাহস ও কিংবদন্তীতুল্য আত্মত্যাগে ধীরে ধীরে পাকিস্তানি বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলতে থাকে মুক্তিবাহিনী।
ডিসেম্বরের ৩ তারিখ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতে বিমান হামলা করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে মধ্যরাতে এক বেতার ভাষণে ঘোষণা করেন, এতদিন বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল, আজ তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হলো।
পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রমণের প্রেক্ষাপটে তাজউদ্দীন আহমেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম যৌথভাবে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান, পাকিস্তানকে সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত শক্তি দরকার। এই উদ্যোগে কাজ হলো। এরপর ৪ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণ শুরু হয়। ৪, ৫ ডিসেম্বর অব্যাহত গতিতে এগিয়ে আসতে থাকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সম্মিলিত যৌথ বাহিনী। এর সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের বিমান বাহিনী শুরু করে আকাশপথে আক্রমণ। সেই সাথে নৌপথেও চলে সাঁড়াশি আক্রমণ। ৬, ৭, ৮ তারিখের অগ্রযাত্রার পর মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতার সাংবাদিকদের বলেন, এখন ঢাকা দখলের জন্য আমরা প্রস্তুত।
ডিসেম্বরের ১২ তারিখে ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা অবতরণ করে টাঙ্গাইলে। এরমধ্যে পাক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান জেনারেল নিয়াজীর স্নেহভাজন জেনারেল রহিম আহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যৌথ বাহিনীর কাছে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানায় পাক বাহিনী। ১৪ তারিখে ঢাকার গভর্নর আবদুল মোতালেব মালেকসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পদত্যাগ করে ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালে রেড ক্রসের আশ্রয় গ্রহণ করে। এদিন আরও দুই পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন। চিফ সেক্রেটারি, পুলিশের আইজি এবং ঢাকা বিভাগের কমিশনারও আত্মসমর্পণ করে রেড ক্রসের আশ্রয় নেন।
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেক কালো দিন। পাকিস্তানিদের চক্রান্তের সাথে কতিপয় বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতায় জাতির মগজ ও মেরুদণ্ড হারিয়ে ফেলার দিন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। যৌথ বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানি বাহিনী যখন পরাজয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তখন তাদের মিত্র রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের একের পর এক হত্যা করে। উদ্দেশ্য- এ দেশ যেন কোনোদিন মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে।
১৫ তারিখে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠান ভারতীয় জেনারেল মানেকশ’র কাছে। পরের দিন অর্থাৎ, ১৬ তারিখ পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন ধার্য করা হয়।
এরপর আসে এক ঐতিহাসিক দিন, আনন্দাশ্রুর দিন, ১৬ ডিসেম্বর। একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য, দেশমাতৃকার সম্মান সমুন্নত রাখার জন্য শুরু হয়েছিল যে মুক্তিযুদ্ধ; তার শেষে আসে এই সোনালি দিন। এদিন ২ নং সেক্টরের ক্র্যাক প্ল্যাটুনের প্রধান জেনারেল হায়দার দলবল’সহ শহরে প্রবেশ করে বেতার ভবন দখল করে নেন।
৪ টা ৩১ মিনিট। রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের জন্য রাখা হয়েছে টেবিল। যৌথ বাহিনীর সৈন্যরা পুরো মাঠ কর্ডন করে রেখেছে। লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা, কয়েকশো সাংবাদিকের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হলো ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ দলিল। পাকিস্তানের পক্ষে পরাজিত জেনারেল নিয়াজী এবং যৌঠ বাহিনীর পক্ষে উপস্থিত ছিলে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার এবং কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান কাদের সিদ্দিকী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
নীল আকাশের দিকে শীতের পড়ন্ত বিকেলে ছোঁড়া হচ্ছিল অগণিত গুলি। বিজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধারা হাতে রাইফেল ও স্টেনগান উচিয়ে লক্ষাধিক লোকের সাথে সমস্বরে স্লোগান দিচ্ছিল, জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু!
যে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে স্বাধীনতা শব্দটি হয়েছিল আমাদের, সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটলো যুদ্ধের। জন্ম হলো বাংলাদেশের। বাংলাদেশিরা পেলো বিজয়ীয় বেশে মুক্ত স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দানের সুযোগ। তবে যে চড়া দামের বিনিময়ে এসেছিল এই স্বাধীনতা, তাতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে উপস্থিত মানুষের মনে অবিমিশ্র ভাবের উদ্ভবের হয়তো ছিল না কোনো সুযোগ। মানুষ তখন একইসাথে হাসছে এবং কাঁদছে। সেখানে ছিল স্বাধীনতার হাসি। কিন্তু তা এত বেশি রক্তের দামে কিনে নিতে হয়েছিল যে কান্নার স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল হাসি। সর্বোচ্চ দাম দিয়েই স্বাধীনতার মূল্য চুকিয়েছে প্রিয় বাংলাদেশ।