Image default
খেলা

রিয়ালকে হারানোর দিনটা ১৫ বছর পরও কাঁদায় রোনালদো ও বেকহামকে

১৫ বছরে কত কিছুই না বদলে যায়! রিক্রিয়েতিভো উয়েলভার সমর্থকদের ১৫ বছর আগের সঙ্গে এখনকার সময়ের তুলনা করলে দীর্ঘশ্বাসই ঝরে শুধু।

স্পেনের সবচেয়ে পুরোনো ক্লাব সেটি। জন্ম সেই ১৮৮৯ সালে। কিন্তু ১৫ বছর আগে লা লিগায় রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো দলের বিপক্ষে খেলা সেই রিক্রিয়েতিভো উয়েলভাকেই এখন খেলতে হয় স্প্যানিশ ফুটবলের পঞ্চম স্তর তেরসেরা দিভিসিওনের গ্রুপ-১০-এ। মাঠের পারফরম্যান্সে দৈন্য তো আছেই, আর্থিক দৈন্যও একটা বড় কারণ। বছর দুয়েক আগে তো আর্থিক সমস্যার কারণে প্রায় অবলুপ্ত হতে চলেছিল উয়েলভা।

সে সময়ে রিয়ালের কোচ ছিলেন ফাবিও কাপেলো

এত হতাশার মধ্যে আজকের দিনটা রিক্রিয়েতিভোর সমর্থকদের কাছে পুরোনো আনন্দের স্মৃতি বয়ে নিতে আসতে পারত। ২০০৬ সালে আজকের দিনেই যে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে গিয়ে রিয়াল মাদ্রিদকে ৩-০ গোলে গুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছিল রিক্রিয়েতিভো। যে রিয়াল দলে সেদিন খেলেছিলেন রোনালদো নাজারিও, ডেভিড বেকহাম, রাউল গঞ্জালেস, ইকার ক্যাসিয়াস, রুড ফন নিস্টলরয়ের মতো তারকা।

কিন্তু এমন আনন্দের দিনটিই বরং রিক্রিয়েতিভোর ইতিহাসে একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে।

১৯৭৯ সালের পর ২০০২-০৩ মৌসুমে একবার স্পেনের প্রথম বিভাগে খেলা রিক্রিয়েতিভো ২০০৬-০৭ মৌসুমে আবার উঠেছিল লা লিগায়। উঠেই চমক! দলবদলে লিভারপুল থেকে ফরাসি স্ট্রাইকার সিনামা-পঙ্গোল আর ভিয়ারিয়ালে তখনো তরুণ সান্তি কাজোরলাকে নিয়ে এসেছিল ক্লাবটি। মৌসুম শেষ করেছিল লিগের ৮ নম্বরে থেকে।

মৌসুমের সবচেয়ে বড় হাইলাইট হতে পারত সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সেই অবিশ্বাস্য জয়ই, কিন্তু হয়নি। রিক্রিয়েতিভোর সমর্থকেরা হয়তো উল্টো এ দিন ভুলে যেতে পারলেই বাঁচেন। প্রিয়জন হারানোর দিন কেই–বা আগ্রহ নিয়ে মনে রাখে!

রিক্রিয়েতিভোর কোচ মার্সেলিনো এখন অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের কোচ

২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে যাওয়ার জন্য বাস ভাড়া করেছিলেন রিক্রিয়েতিভোর সমর্থকেরা। এখন পর্যন্ত ১৩১ বছর বয়সী ক্লাবটি মাত্র ৫ মৌসুম খেলতে পেরেছে প্রথম বিভাগে, তাদের সমর্থকদের জন্য রিয়াল-বার্সার মতো ক্লাবের মাঠে গিয়ে খেলা কত বড় ব্যাপার, তা সহজেই অনুমেয়। সেদিনও তাই উৎসবের আমেজই ছিল বাসে।

উয়েলভা থেকে মাদ্রিদে প্রায় ছয় ঘণ্টার বাস সফরের ঝক্কি সয়েই রিক্রিয়েতিভোর প্রায় পাঁচ হাজার সমর্থক যাত্রা শুরু করেছিলেন আগের রাতে। বাসেও তাঁদের কত গান, কৌতুক! আর বার্নাব্যুতে দলকে খেলতে দেখার অবিশ্বাসকে সত্যি হতে দেখার রোমাঞ্চ তো ছিলই।

কিন্তু উয়েলভা থেকে রওনা দেওয়ার ঘণ্টাখানেক যেতে না যেতেই উৎসব ঢেকে গেল শোকের চাদরে।

রাত ১২টা ৩৫ মিনিট। সেভিলের কাছে একটা ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় উয়েলভার সমর্থকদের বহনকারী একটি বাসের। একই পরিবারের তিনজনসহ মোট চারজন ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন। আহত হলেন ৩৫ জন, কারও আঘাত ছিল জীবনসংশয়ে ফেলার মতো, কারও আবার হালকা আঘাত। এক সপ্তাহ পর এল পঞ্চম মৃত্যুর খবর। মারিয়ানো, ফ্রান্সিসকো, হাভিয়ের, ইসাবেল, সেবাস্তিয়েন…পাঁচটি নাম এখনো দীর্ঘশ্বাস ঝরায় উয়েলভায়।

দুঃস্বপ্ন হয়ে আসা সংবাদটি যখন জানাজানি হলো, রিক্রিয়েতিভো উয়েলভার সে সময়ের সভাপতি ফ্রান্সিসকো মেন্দোজা (কিছুদিন আগে মারা গেছেন) ম্যাচটি পিছিয়ে দিতে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের কাছে অনুরোধ করেছিলেন। টুর্নামেন্টের নিয়মে সে অনুরোধ রাখার সুযোগ নেই বলে তাঁর অনুরোধ ফিরিয়ে দেয় ফেডারেশন।

সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ম্যাচ হলো, কিন্তু গ্যালারিতে প্রাণ ছিল না। রিয়াল মাদ্রিদ দারুণ একটি সিদ্ধান্ত নেয় তারই মধ্যে। ঘোষণা দেয়, ম্যাচের টিকিট বিক্রি থেকে যত আয় হয়েছে, সেটি দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে দিয়ে দেওয়া হবে।

সান্তি কাজোরলার দ্বিতীয় গোলের উদ্‌যাপনে রিক্রিয়েতিভোর খেলোয়াড়েরা বারবার তাকাচ্ছিলেন গ্যালারিতে

শোক চেপে রেখে মাঠে নামে রিক্রিয়েতিভোর খেলোয়াড়েরা। কালো বন্ধনী ছিল দুই দলের খেলোয়াড়দের বাহুতে। কিন্তু রিক্রিয়েতিভোর দর্শক তখন আর তেমন গ্যালারিতে নেই। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, ম্যাচটি পিছিয়ে দেওয়া হবে। অনেকের কাছে এমন দুঃস্বপ্নের পর ম্যাচ দেখতে যাওয়া ছিল অসহনীয়। আর যাঁরা মাঠে ছিলেন, তাঁরা ছিলেন দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের একটু ভিন্নভাবে সর্বোচ্চ সম্মান জানাতে। এক মিনিটের নীরবতা পালনের সময়ে আবেগ বাধ মানেনি অনেকের।

এরপর ম্যাচ যখন শুরু হলো, সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রিক্রিয়েতিভো খেলোয়াড়েরা। তাঁদের চোয়াল যেন তখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যে ম্যাচ দেখতে আসার পথেই প্রাণ হারিয়েছেন সমর্থকেরা, সেই ম্যাচে সবটুকু দিয়ে লড়েই সম্মান জানাবেন অন্যলোকে চলে যাওয়া সমর্থকদের।

কে জানে, মারিয়ানো-ফ্রান্সিসকোরা হয়তো অন্যলোক থেকেই চোখ রেখেছিলেন ম্যাচে। রিক্রিয়েতিভো ৩-০ গোলে রিয়ালকে বিধ্বস্ত করেছে, এমন সুখস্বপ্ন হয়তো অনেক দেখেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে দেখে যাওয়া হলো না তাঁদের।

বাস্তবে সেটি সম্ভব হওয়াও অবশ্য অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার বটে। রিয়ালের সেদিনের একাদশটাই দেখুন: ইকার ক্যাসিয়াস, মিশেল সালগাদো, ফাবিও কানাভারো, সের্হিও রামোস, রবার্তো কার্লোস, ডেভিড বেকহাম, এমারসন, গুতি, রাউল গঞ্জালেস, রোনালদো, রুড ফন নিস্টলরয়!

তুলনায় রিক্রিয়েতিভোর একাদশে এক সান্তি কাজোরলা, উচে আর সিনামা পঙ্গোল ছাড়া চেনা নামই খুঁজে পাওয়া ভার।

কিন্তু কোচ মার্সেলিনো গার্সিয়া তোরালের অধীন স্বপ্নের মতো মৌসুম কাটাতে থাকা রিক্রিয়েতিভো দুঃস্বপ্নসম দিনটিতেও ঝলসে উঠল। প্রথম মিনিট থেকেই রিয়ালকে দমিয়ে রেখেছিল। ৩৫ মিনিটে সিনামা পঙ্গোলের গোলে তাদের এগিয়ে যাওয়া, উচের গোলে ব্যবধান দ্বিগুণ হলো দ্বিতীয়ার্ধের ষষ্ঠ মিনিটে। আর ৮৬ মিনিটে এমিলিও ভিকেইরার ফ্রি-কিক জড়াল রিয়ালের জালে।

একেকটা গোল হয়েছে, আর রিক্রিয়েতিভো গ্যালারিতে চোখগুলো যেন হয়েছে আরও বাষ্পায়িত। উদ্‌যাপন হলো একটু-আধটু, তবে তাতে উচ্ছ্বাস তেমন ছিল না।

১৫ বছর পর আরেকটি ২০ ডিসেম্বরেও রিয়ালকে হারানোর গর্বটা হয়তো রিক্রিয়েতিভোকে ছুঁয়ে যায় না। অনুভূতি যে আগেই প্রিয় হারানোর বেদনায় ভোঁতা!

Related posts

আমিরাত-নামিবিয়া দ্বৈরথ ‘চেনা প্রতিপক্ষ’ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী দু’দলই

News Desk

হান্টিংটন বিচ ওপেনে অলিম্পিক প্রিভিউ জিতেছে কানাডিয়ান হুমানা পেরেডেস এবং উইলকারসন

News Desk

ইবেই মিজুহারার আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে শোহেই ওহতানিকে বড় করতে হবে

News Desk

Leave a Comment