এসআর-৭১ ব্লাকবার্ড (ইংরেজি: Lockheed SR-71 Blackbird) হচ্ছে একটি উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন, দূর পাল্লার, ম্যাক-৩ মাত্রার কৌশলগত গোয়েন্দা বিমান। এটি তৈরি করা হয়েছে লকহিড এ-১২ ও ওয়াইএফ-১২ সংস্করণ দুটির উন্নয়নের মাধ্যমে। বিমানটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান লকহিড শ্রাঙ্ক ওয়ার্কস এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কালো প্রকল্পের আওতায়। দূর্ভাগ্যজনকভাবে এই বিমানটির নামকরণ করা হয় ব্ল্যাকবার্ড, এবং এর আরোহীদের কাছে এটি হাবু নামে পরিচিত। হাবু হচ্ছে ওকিনাওয়ান প্রজাতির পিট ভাইপার গোত্রীয় একটি সাপের নাম।এই বিমানটির বিভিন্নরকম নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে ছিলেন ক্লেয়ারেন্স জনসন। এই বিমানটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য উচ্চগতি ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল, এবং এজন্য ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য কোনো ক্ষেপণাস্ত্র এই বিমানের দিকে ধাবিত হলে স্ট্যান্ডার্ড ইভেশন অ্যাকশনের দ্বারা তাৎক্ষণিকভাবে এর গতিবৃদ্ধি ঘটে এবং ক্ষেপণাস্ত্র থেকে নিজেকে রক্ষা করে। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মোট ৩৪ বছর এই বিমান কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। প্রকল্পের আওতায় মোট ৩২টি বিমান নির্মিত হলেও বিভিন্ন দূর্ঘটনায় মোট ১২টি বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু কোনোটিই শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় নি। ১৯৭৬ থেকে এখন পর্যন্ত আকাশে বিমান চালকের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সক্ষম বিমানগুলোর মাঝে এটিই সবচেয়ে দ্রুতগামী বিমান।পূর্বে এই রেকর্ডটি ছিলো লকহিডের পূর্ববর্তী সংস্করণ ওয়াইএফ-১২-এর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এটি কোনো প্রথাগত যুদ্ধ নয়। একে অন্যকে মিলিটারি ও টেকনোলজিক্যাল দিক দিয়ে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র। এই যুদ্ধে এগিয়ে থাকতে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৬ সালে U-2 নামক একটি গোয়েন্দা বিমান বানায় যা সোভিয়েত আকাশসীমায় ঢুকে গোপনে ছবি তুলে নিয়ে আসতো। ১৯৬০ সালে ৭০ হাজার ফুট উপর থেকে ছবি তোলার সময় সোভিয়েত এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল হামলায় একটি ইউ-২ বিমান ভূপাতিত হয়। এর পাইলট গ্রেফতার ও জেলে যাওয়ার ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়।
এর পরেই রিকন বিমানের বদলে স্যাটেলাইট ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয় এবং ‘করোনা স্পাই স্যাটেলাইট’ প্রোগ্রাম ত্বরান্বিত হয়। এই স্যাটেলাইট সংক্রান্ত বিস্তারিত আর্টিকেলে উল্লেখ করা হয় যে করোনা স্যাটেলাইট দিয়ে সবসময় গোয়েন্দাগিরি করা সম্ভব ছিল না। তাই নতুন ধরনের গোয়েন্দা বিমানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে তৈরি হয় long-range, high-altitude, high speed শ্রেণীর রিকনসিস বিমান SR-71।
মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড করপোরেশনের তৈরি এই বিমানের ডাকনাম ছিল ‘Blackbird’ যা শব্দের গতির ৩.২ গুণ গতিতে ছুটতে সক্ষম ছিল! এর চেয়ে দ্রুতগতির জেট ইঞ্জিন চালিত বিমান পৃথিবীতে আর একটিও তৈরি হয়নি। এসআর-৭১ মার্কিন এয়ারফোর্স থেকে অবসর নেয়ার পর NASA এর মহাকাশ গবেষণা প্রোগ্রামেও ভূমিকা রেখেছিল। বর্তমানে ড্রোন দিয়ে যে ধরনের নজরদারি করা হয়, তৎকালে এসআর-৭১ সেই কাজটি করত। SR মূলত Strategic Reconnaissance এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
ইঞ্জিনিয়ার ক্ল্যারেন্স জনসন এই অদ্ভুত বিমানের কনসেপ্ট তৈরি করেন। তার টার্গেট ছিল এমন হাই স্পিড ইন্টারসেপ্টর (শত্রু বিমানকে ধাওয়াকারী) বিমান তৈরি করা যা কিনা রাডারে সহজে ধরা পড়বে না। এরই ধারাবাহিকতায় তিনটি YF-12 প্রোটোটাইপ আসে, যা তিনটি করে এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল বহনে সক্ষম ছিল। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা CIA চাহিদা এবং ওয়াইএফ-১২ এর ফিল্ড পারফরম্যান্সে দেখা গেল এটি ইন্টারসেপ্টরের চেয়ে রিকনসিস (গোয়েন্দা) হিসেবে ভালো কাজ করবে। ফলে এই বিমানের নকশার উপর ভিত্তি করে ১২টি A-12 রিকনসিস বিমান বানানো হয়।
এতে একজন পাইলট দরকার হতো। ভিয়েতনাম যুদ্ধের এক মিশনে একটি এ-১২ গোয়েন্দা বিমান একসাথে ছয়টি ভিয়েতনামিজ সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল ফাঁকি দিয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। মার্কিনিরা এরপর পাইলটের ঝুঁকি কমাতে D-21 নামক ২০ ফিট লম্বা একটি সুপারসনিক ড্রোন তৈরি করে যা মূলত A-12 (১০২ ফুট) বামন ভার্সন। এই ড্রোন ঘন্টায় ৩,৬০০ কিলোমিটার বেগে ৯০ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে ছবি তোলার কাজ শেষে নিজে নিজেই ধ্বংস হয়ে যেত! ড্রোন বহন করার জন্য আবার A-12 এর দুজন পাইলট চালিত ভার্সন M-21 বানানো হয়। পরে দেখা গেলো দুজন পাইলটের বিমানটিই গোয়েন্দা মিশনে সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স দেখাচ্ছে। কিন্তু এর ড্রোনগুলো একবারের বেশি ব্যবহার সম্ভব নয় বিধায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাই এসআর-৭১ নামের সম্পূর্ণ নতুন মডেলের বিমানের প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়। এসব কথা বলার অর্থ হচ্ছে YF-12, A-12, M-21 এর সবাই SR-71 এর জাতভাই যা খালি চোখে দেখলে একইরকম মনে হয়।
একমাত্র ওয়াইএফ-১২ বাদে আর কোনো বিমানেই কোনোপ্রকার মিসাইল বা অন্য কোনো অস্ত্র ছিল না। এসআর-৭১ মোট সাড়ে তিন হাজার পাউন্ড ওজনের Itek KA-102A (910–1,220 mm) ক্যামেরা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক রিকনসিস পেলোড বহন করতো। এটি খুবই নিখুঁতভাবে ছবি তুলতে পারতো বিধায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনার উপর দিয়ে প্রায়ই উড়ে যেত। মাত্র এক ঘণ্টায় এক লাখ বর্গ মাইল এলাকা সার্ভে করতে পারতো বিমানটি। বলা হয়ে থাকে, ব্ল্যাকবার্ডের ক্যামেরা এতই আধুনিক ছিল যে রাস্তায় ঘন্টায় ২০০ কি.মি. গতিতে চলতে থাকা গাড়ির নাম্বার প্লেটের ছবি ৮৫ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে নিখুঁতভাবে তোলা সম্ভব।
তখনকার যুগে জিপিএস প্রযুক্তি ছিল না। আবার ৩৩ হাজার ফুট উচ্চতায় কম্পাসভিত্তিক নেভিগেশন সিস্টেম পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের কারণে ভুল রিডিং দেয়। তাই ব্ল্যাকবার্ডে আকাশের তারা দেখে পথ চলতো। কী? অবাক হলেন? এসআর-৭১ এ ব্যবহার করা হয়েছে Astro-inertial নেভিগেশন সিস্টেম। এই সিস্টেমে ছিল ব্লু লাইট নামক একধরনের Star tracker, যা কিনা আকাশের ৬১টি তারার অবস্থানের সাপেক্ষে বিমানের অবস্থান নির্ণয় করে সঠিকভাবে বিমান চালাতে সহায়তা করতো। একজন সাবেক ব্ল্যাকবার্ড পাইলট বলেছেন, এই সিস্টেম এতটাই নিখুঁত যে কখনো ভুল হলে কোর্স থেকে বড়জোর ৩০০ মিটার ডানে-বামে সরে যেত।
এসআর-৭১ এর এয়ারফ্রেম (বডি) এর ৮৫% টাইটেনিয়ামের তৈরি। ফলে এটি নির্মাণের সময় যোগানের তুলনায় প্রচুর চাহিদার সৃষ্টি হয়। তৎকালীন সময়ে এই মূল্যবান ধাতুর প্রধান রপ্তানিকারক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু ব্ল্যাকবার্ড একটি গোপনীয় প্রজেক্ট। এত বিপুল সংখ্যক টাইটেনিয়াম কিনতে গেলে সন্দেহ করবে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি। তাই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দেশে-বিদেশে বেশকিছু ভুয়া কোম্পানি তৈরি করে। এদের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কেনা ধাতু দিয়ে এমন বিমান তৈরি করে যা তাদের উপরেই গোয়েন্দাগিরির কাজ করতো!
এছাড়া উচ্চগতির কারণে বিমানটির বাতাসের সাথে ঘর্ষণের ফলে প্রচুর তাপ (৩১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) উৎপন্ন হতো যা মেটাল পার্টগুলোর দৈর্ঘ্য কয়েক মিলিমিটার বাড়িয়ে দিত। ফলে বেশ কিছু প্রোটোটাইপ সমস্যার কবলে পড়ে। এর সমাধান করতে পরবর্তী বিমানগুলোর কিছু পার্টসের সাইজে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু পরে দেখা গেলো যে এখন বিমানটি ফুয়েল লিক করে! ফলে ব্ল্যাকবার্ড কখনো সম্পূর্ণ ফুয়েল ট্যাংক ভর্তি করে আকাশে উড়তো না। টেকঅফের কিছুক্ষণ পরে যখন পার্টসগুলোর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পাওয়ার সমস্যার সমাধান নিজে নিজেই হয়ে যেত তখনই ব্ল্যাকবার্ড আকাশে থাকা অন্য কোনো অয়েল ট্যাংকার বিমান থেকে উড়ন্ত অবস্থায় প্রয়োজনীয় জ্বালানী সংগ্রহ করত। এছাড়া ল্যান্ডিং গিয়ার ও এয়ারব্রেকের উপর চাপ কমাতে এমনটি করা হয়। এসআর-৭১ বিমানটি প্রায় সাড়ে ৪৬ হাজার লিটার জ্বালানী নিয়ে ৫,২৩০ কি.মি. দূরে গিয়ে অপারেশন চালাতে সক্ষম ছিল।
প্রয়োজনে একাধিকবার জ্বালানী নিয়ে এর রেঞ্জ বা এনডিউরেন্স বাড়ানো হতো। কারণ ব্ল্যাকবার্ড ল্যান্ড করার পর আবার আকাশে উড়াতে কমপক্ষে এক সপ্তাহ রুটিন মেইন্টেইন্স করতে হতো। অনেক সময় মাসখানেকও লেগে যেত। এর পার্টস ড্যামেজের পরিমাণ ছিল বেশি। কখনো কখনো দেখা গিয়েছে যে প্রচন্ড গতিতে চলার কারণে দুই একটা নাটবল্টু খসে গেছে! এছাড়া বিমানে এমন বেশ কিছু যন্ত্রাংশ ছিল যা একবারের বেশি ব্যবহার করা যেত না। এসব কারণে বছরে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার ব্ল্যাকবার্ডের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যয় হতো। এছাড়া এই বিমান ওড়াতে প্রতি ঘন্টায় ৮৫ হাজার ডলার খরচ হতো। ১৯৮১ সালে একবার সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন নেভাল বেসের ছবি তুলতে গিয়ে বিমানটি নরওয়েতে ইমারজেন্সি ল্যান্ড করে। কোনো পার্টসে সমস্যা হলে সেটি দ্রুততম সময়ে নির্ণয় করা সম্ভব নয় বিধায় রক্ষণাবেক্ষণ ক্রুরা এর এক ইঞ্জিনসহ পুরো উইং (ডানা) পরিবর্তন করে বিমানটি আবার আকাশে ওড়ায়! এসব কারণে এসআর-৭১ ছিল তৎকালের সবচেয়ে স্পর্শকাতর সামরিক প্রযুক্তি। ১৯৬৬ সালের হিসেবে প্রতিটি ব্ল্যাকবার্ডের দাম ছিল ৩৪ মিলিয়ন ডলার, যা আজকের দিনের ২৭৮ মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য।
ব্ল্যাকবার্ডে দুটি Pratt & Whitney J58 আফটারবার্নিং টার্বোজেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। এটি প্রয়োজন মোতাবেক টার্বোজেট থেকে র্যামজেটে রূপান্তরিত হতে পারে। এই কার্যপ্রণালী বেশ জটিল। আগ্রহী পাঠকের বুঝার সুবিধার্থে লেখার শেষে একটি ভিডিও সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ব্ল্যাকবার্ড অনায়াসে ৮৫ হাজার ফুট বা ২৫.৯ কিলোমিটার উচ্চতায় উঠে যেতে সক্ষম ছিল। এছাড়া এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ডের সর্বোচ্চ গতি ৩,৫৪০ কিলোমিটার/ঘন্টা (২,২০০ মাইল/ঘন্টা), যা শব্দের গতির স্কেলে ম্যাক ৩.২ এর সমতুল্য।
তৎকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো মিসাইলের সাধ্য ছিল না একে ভূপাতিত করার। বিমানটির ২৪ বছরের সার্ভিস লাইফে এর উদ্দেশ্যে সব মিলিয়ে চার হাজারের বেশি এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল ফায়ার করা হয়েছিল। এর একটিও তাকে ছুঁতে পারেনি। এছাড়া এ সময়ে এটি ২০০ যুদ্ধবিমানকে গতির জোরে পরাস্ত করে। ১৯৮৭ সালে লিবিয়ার আকাশে মিসাইল ফাঁকি দেয়ার সময় একটি ব্ল্যাকবার্ড ম্যাক ৩.৫ গতি তুলে বিশ্বরেকর্ড গড়ে। ভিয়েতনামে A-12 এর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে SR-71 এর সফটওয়্যার সিস্টেম এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছিল যে বিমানটির আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম কোনো মিসাইল ফায়ারিং শনাক্ত করলেই নিজে নিজে গতি বাড়িয়ে মিসাইল রেঞ্জের বাইরে চলে যেত। ফলে তেমন পাইলট দুজনের তেমন কিছুই করতে হতো না। এত উচ্চতায় ওড়ার মতো এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইলও তখনকার যুগে ছিল না। মোট ৩২টি ব্ল্যাকবার্ড বানানো হয়েছিল, যার ১২টি বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়। তবে একটিও শত্রুর হাতে ধ্বংস হয়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ গতির ইন্টারসেপ্টর (ম্যাক ২.৮৩) বিমান মিগ-২৫ যুদ্ধবিমান ১৯৮৭ সালে বাল্টিক সাগরে এক ইঞ্জিন নষ্ট হওয়া এসআর-৭১ এর পিছু ধাওয়া করে টার্গেট লক করে ফেলেছিল। কিন্তু মিসাইল ফায়ারের আগেই সুইডিশ এয়ারফোর্সের চারটি যুদ্ধবিমান ব্ল্যাকবার্ডকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে। এই ঘটনা ব্যতীত বিমানটিকে শত্রুরা নাগালে পেয়েছে এমন কোনো উদাহরণ নেই।
উল্লেখ্য, ব্ল্যাকবার্ডের চেয়ে বেশি গতির বিমান হলো এক্স-১৫। কিন্তু সেটি জেট ইঞ্জিন নয়, রকেট ইঞ্জিন চালিত। আবার এক্স-১৫ সাধারণ বিমানের মতো সরাসরি আকাশে উড়ত না। বি-৫২ বোমারু বিমানের ডানায় করে একে নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে লঞ্চ করা হতো। এজন্য ৬.৭০ ম্যাক বা ৭,২৭৪ কি.মি./ঘন্টা গতির এক্স-১৫ কে মজা করে মানুষ চালিত মিসাইলও বলা হয়। তাই এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ডকেই সর্বোচ্চ গতির বিমানের খেতাব দেয়া হয়।
১৯৭৪ সালে ঘন্টায় ২,৯০৮ কি.মি. (ম্যাক ২.৭২) গতিতে উড়ে মাত্র ১ ঘন্টা ৫৫ মিনিটে নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডনে (দূরত্ব ৫,৫৭০ কি.মি.) উড়ে গিয়েছিল একটি ব্ল্যাকবার্ড। তৎকালে কনকর্ড সুপারসনিক যাত্রীবাহী বিমান একই পথে প্রায় তিন ঘন্টা সময় নিত। এর আগে ১৯৭১ সালে সাড়ে দশ ঘন্টায় ২৪ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছিল ব্ল্যাকবার্ড! ১৯৮৮ সালে পেন্টাগনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে এসআর-৭১ বিমানগুলোকে অবসরে পাঠানোর দুই বছরের মাথায় আবারও সার্ভিসে আনা হয়। ১৯৯৮ সালে মার্কিন এয়ারফোর্স থেকে অবসরের পর নাসাতে নভোচারীদের টেস্ট ফ্লাইটের কাজে কিছুদিন ব্যবহার হয়।
অতি উচ্চতায় অতি উচ্চগতিতে চলার কারণে ব্ল্যাকবার্ড পাইলটদের নভোচারীদের মতো এয়ার প্রেশার স্যুট পরিধান করতে হতো যা ককপিটের প্রেশার নিয়ন্ত্রণ সিস্টেমের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকত। যদি কখনো মিসাইল হামলা/কারিগরি ত্রুটির কারণে বিমান ধ্বংস হয়ে যায় এবং ম্যাক ৩.২ গতিতে পাইলট ইজেক্ট (প্যারাশুট নিয়ে বেরিয়ে আসা) করে, তবে তাকে ২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে হবে। তাই ককপিটে থাকা প্রেশার নিয়ন্ত্রণ সিস্টেমের একটি পোর্টেবল ভার্সন ইজেকশন সিটের সাথে সংযুক্ত থাকতো যা প্যারাসুট নিয়ে নিচে নামার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতাসের চাপের সঙ্গে পাইলটকে মানিয়ে নিতে সহায়তা করত।
এছাড়া বিমানের নিজস্ব লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম ছিল যা অতি উচ্চতায় অক্সিজেন স্বল্পতায় পাইলটদের শ্বাস নিতে সহায়তা করতো। এই মাস্ক সিস্টেম পুরো ফ্লাইটে আর খোলা সম্ভব হতো না। তার দীর্ঘ সময় আকাশে উড়ার মিশনে পাইলটরা বিশেষ বোতলে থাকা পানীয় পাইপ (স্ট্র) দিয়ে পান করতো। একই কারণে টুথপেস্টের মতো দেখতে টিউবের ভেতরে জেলির ন্যায় খাবার দেয়া হতো, যা মাস্ক না খুলেই খেতে সাহায্য করত। এছাড়া পাইলটরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বিশেষ ধরনের ইউরিন বোতল, এডাল্ট প্যাম্পার্স ব্যবহার করত। সর্বোচ্চ গতিতে চলার সময় বিমানের বডির তাপমাত্রা ২৬০-৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এবং ককপিট উইন্ডশিল্ডের তাপমাত্রা ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যেত। ফলে পাইলটদের সুরক্ষার জন্য ককপিটে খুবই শক্তিশালী এয়ার কন্ডিশন কুলিং সিস্টেম যোগ করা হয়েছিল যা দিয়ে বিমানের নাইট্রোজেন গ্যাস ভর্তি ল্যান্ডিং গিয়ার (চাকা) ঠান্ডা করার কাজ ও চালানো হতো। মজার ব্যাপার হলো, এই সিস্টেমে ককপিটের বাড়তি তাপকে অতি উচ্চতার ঠান্ডায় জমে যাওয়া ফুয়েল গরম রাখার কাজে ব্যবহার করা হতো।
এসআর-৭১ ছিল প্রথম যুগের স্টেলথ বিমান। এর রাডার ক্রস সেকশন (RCS) এর মান মাত্র দশ স্কয়ার মিটার। আজকের যুগে এটি সাধারণ ব্যাপার হলেও পঞ্চাশ বছর আগে এটিই ছিল বিস্ময়। আধুনিক ড্রোন ও স্পাই স্যাটেলাইটের যুগে এ ধরনের গোয়েন্দা বিমানের চাহিদা শেষ হয়ে গেছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র বহু আগে থেকেই ব্ল্যাকবার্ডের উত্তরসূরি এসআর-৭২ বানানোর কাজ করছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৫ সালে এটি আকাশে উড়বে। তবে ব্ল্যাকবার্ড ছিল তার যুগের তুলনায় কয়েকগুণ এগিয়ে থাকা কিংবদন্তি। এর সমতুল্য কোনো বিমান আজ অবধি কোনো দেশ বানিয়ে দেখাতে পারেনি। একে এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারিং জগতের বিস্ময় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আরো খুঁটিনাটি জানতে চমৎকার এই ভিডিওটি দেখে নিন।