Image default
ইসলাম

পরকালের বিশ্বাস, সফল জীবনের পাথেয়

শেষ বিচার দিবসের ওপর বিশ্বাস মানুষকে নিজ কর্মকাণ্ডের ওপর বিশ্লেষণ করতে শেখায়। নিজের জীবনকে সৎ, শুদ্ধ ও প্রতিশ্রুতিপরায়ণ হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করে। পরকালকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করে। সেই সঙ্গে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন ও আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনের ব্যাপারেও সঠিক নির্দেশনা দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অতি অল্প।’ (সুরা তওবা : ৩৮)। সুতরাং আখেরাতের জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা চাই। পরকালের দীর্ঘ সফরের জন্য বেশি বেশি উপকারী আসবাব জোগাড় করা দরকার।

শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস অন্তরে শাস্তি ও পরকালের হিসাব-নিকাশের প্রতি ভয়ের সঞ্চার করে। আল্লাহভীরু বান্দারা সৎকর্ম ও উত্তম প্রতিদানের দিকে ধাবিত হয়। পক্ষান্তরে আখেরাতের শাস্তি এবং জাহান্নামকে ভয় করে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামত দিবসে প্রত্যেকের হক আদায় করা হবে। এমনকি শিংবিহীন দুম্বার জন্য সেই শিংওয়ালা দুম্বার কাছ থেকে তার হক আদায় করা হবে, যে তার শিং ভেঙেছে।’ (মুসলিম : ৬৭৪৫)।

শেষ বিচার দিবসের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস মানুষকে আখেরাতের হিসাব-নিকাশ এবং প্রতিদানের ব্যাপারে সচেতন করে। বিচার দিবসে প্রতিদান দেওয়া হবে আমলের বিনিমিয়ে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করে থাকলে তাও দেখতে পাবে।’ (সুরা যিলযাল : ৭-৮)। ঈমানদার ও বেঈমানদারের মধ্যে পার্থক্য হলো, আল্লাহ বিচার দিবসে ঈমানদারদের কাজের উত্তম বিনিময় দান করবেন। আর যাদের ঈমান ছিল না, তাদের কোনো উত্তম প্রতিদান দেওয়া হবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই তারা ক্ষতিগ্রস্ত, যারা আল্লাহর সাক্ষাৎকে মিথ্যা মনে করেছে। এমনকি যখন কেয়ামত তাদের কাছে হঠাৎ এসে যাবে, তারা বলবে, হায় আফসোস! এ ব্যাপারে আমরা কতই না ভুল করেছি। তারা স্বীয় বোঝা স্বীয় পিঠে বহন করবে। আর তারা যা বহন করবে, তা অতি নিকৃষ্টতর বোঝা।’ (সুরা আনআম : ৩১)।

যখন আল্লাহ পৃথিবী ধ্বংসের অনুমতি দেবেন, তখন পুরো দুনিয়া ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। সূর্য আলোহীন হয়ে যাবে। নক্ষত্র মলিন হয়ে যাবে। পর্বতমালা অপসারিত হবে। আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাবে। আকাশের আবরণ অপসারিত হবে। নক্ষত্রগুলো ঝরে পড়বে। অপসারিত হবে ধুনিত রঙিন পশমের মতো। সমুদ্র বিস্ফোরিত ও উত্তাল হয়ে যাবে। জমিন প্রসারিত হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পৃথিবী তার গর্ভস্থিত সবকিছু বাইরে নিক্ষেপ করবে ও শূন্যগর্ভ হয়ে যাবে। পৃথিবী আল্লাহর আদেশ পালন করবে। এটাই তার করণীয়।’ (সুরা ইনশিকাক : ৪-৫)। আল্লাহতায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো। নিশ্চয়ই কেয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যধাত্রী তার দুধের শিশুকে ভুলে যাবে। প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে। মানুষ মাতাল হয়ে যাবে; অথচ তারা মাতাল নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি অনেক ভয়াবহ।’ (সুরা হজ : ১-২)।

আল্লাহতায়ালা? দুনিয়া ধ্বংসের সময় তাবৎ পৃথিবী বিস্ফোরণ ও কম্পনের আদেশ করবেন। যার মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে সব জীবন নিঃশেষ হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। ফলে যাদেরকে আল্লাহ? ইচ্ছে করেন, তাদের ব্যতীত আসমান ও জমিনে যারা আছে, সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে। এরপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। তৎক্ষণাৎ তারা দ-ায়মান হয়ে দেখতে থাকবে।’ (সুরা যুমার : ৬৮)। শিঙ্গায় হঠাৎ করেই ফুঁক দেওয়া হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা বলে, তোমরা সত্যবাদী হলে বলো, এ ওয়াদা কবে পূর্ণ হবে? প্রকৃতপক্ষে তারা একটি ভয়াবহ শব্দের অপেক্ষা করছে, যা তাদেরকে বিতর্কে থাকা অবস্থায়ই পাকড়াও করবে। তখন আর তারা কোনো অসিয়ত করতে পারবে না। পারবে না নিজ পরিবারের কাছে ফিরে যেতে।’ (সুরা ইয়াসিন : ৪৮-৫০)। এরপর আল্লাহতায়ালা দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়ার জন্য আদেশ করবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। তখনই তারা কবর থেকে উঠে তাদের পালনকর্তার দিকে ছুটে চলবে।’ (সুরা ইয়াসিন : ৫১)।

এ সময় জমিন প্রচ-ভাবে প্রকম্পিত হবে। জমিনের ভেতরে যা থাকবে, সব বের করে দেবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন কবরগুলো উন্মোচিত হবে, তখন প্রত্যেকে জেনে নেবে, সে সামনে কী পাঠিয়েছে এবং পেছনে কী রেখে গেছে।’ (সুরা ইনফিতার : ৪-৫)। সেদিন আল্লাহতায়ালা নগ্ন পায়ে উলঙ্গ অবস্থায় পূর্বাপর সবাইকে একত্রিত করবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব। প্রতিশ্রুতি পালন আমার কর্তব্য। আমি এটা পালন করবই।’ (সুরা আম্বিয়া : ৪)।

এরপর মানুষদের হাশরের ময়দানের দিকে আল্লাহর সামনে হিসাব-নিকাশের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন তোমাদের উপস্থিত করা হবে। তোমাদের কোনো কিছু গোপন থাকবে না।’ (সুরা হাক্কাহ : ১৮)। সেদিন সবার মধ্যে এমন আতঙ্ক, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হবে, যে ভয়ে শিশুরা বৃদ্ধদের মতো হয়ে যাবে। আমলনামা পরিমাপের ব্যবস্থা করা হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জান্নাত আল্লাহভীরুদের নিকটবর্তী করা হবে। বিপথগামীদের সামনে জাহান্নাম উন্মোচিত করা হবে।’ (সুরা শুআরা : ৯০-৯১)। সেদিন সব কৃতকর্ম প্রকাশ করা হবে। ছোট-বড় কোনো কাজই বাদ দেওয়া হবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে, তার হিসাব-নিকাশ সহজে হয়ে যাবে। সে তার পরিবার-পরিজনের কাছে হৃষ্টচিত্তে ফিরে যাবে। আর যাকে তার আমলনামা পিঠের পেছন দিক থেকে দেওয়া হবে, সে মৃত্যুকে আহ্বান করবে এবং জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা ইনশিকাক : ৮-১২)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘সেদিন সত্যিকার রাজত্ব হবে আল্লাহর। সেদিন কাফেরদের জন্য হবে অতি কঠিন।’ (সুরা ফোরকান : ২৬)।

আল্লাহতায়ালা সেদিন লিখিত কাগজপত্রের মতো আকাশকে গুটিয়ে নেবেন। পুরো আসমান থাকবে আল্লাহর ডান হাতের ওপর। পুরো জমিন থাকবে আল্লাহর অন্য হাতে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে বোঝেনি। কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তার হাতের মুঠোয়। আসমানগুলো ভাঁজ করা থাকবে তার ডান হাতে। তিনি পবিত্র। এরা যাকে শরিক করে, তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।’ (সুরা যুমার : ৬৭)। এরপর আল্লাহ? সাত আসমান এক আঙুলের ওপর এবং সাত জমিন আরেক আঙুলের ওপর রেখে নাড়াবেন। বলতে থাকবেন, ‘আমি বাদশাহ, আজ রাজত্ব কার? এক প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহর। আজ প্রত্যেকেই তার কৃতকর্মের প্রতিদান পাবে। আজ জুলুম নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। আপনি তাদেরকে আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করুন; যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হবে, দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। পাপিষ্ঠদের জন্য এমন কোনো বন্ধু নেই, সুপারিশকারীও নেই; যার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে।’ (সুরা মোমিন : ১৬-১৮)।

শেষ বিচারের দিন এমন ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে, যে প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন মানুষ তাদের ভাইদের কাছ থেকে পলায়ন করবে, মাতাপিতার কাছ থেকে পলায়ন করবে, পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকেও পলায়ন করবে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত রাখবে।’ (সুরা আবাসা : ৩৪-৩৭)। এ দিন সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘অপরাধী সেদিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য সন্তান-সন্তুতিকে মুক্তিপণ হিসেবে দিতে চাইবে তার স্ত্রীকে, তার ভাইকে, তার গোষ্ঠীকে; যারা তাকে আশ্রয় দিত এবং পৃথিবীর সবকিছুকে। অতঃপর নিজেকে রক্ষা করতে চাইবে।’ (সুরা মাআরিজ : ১১-১৪)।

অন্তর ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। দৃষ্টিশক্তি নত হয়ে যাবে। ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যেদিন প্রকম্পিত করবে প্রকম্পিতকারী, অতঃপর পশ্চাতে আসবে পশ্চাৎগামী, সেদিন অনেক হৃদয় ভীত-বিহ্বল হবে। তাদের দৃষ্টি নত হবে। তারা বলে, আমরা কি উল্টো পায়ে প্রত্যাবর্তিত হব গলিত অস্থি হয়ে যাওয়ার পরও? তবে তো এ প্রত্যাবর্তন সর্বনাশা হবে। এটা তো কেবল এক বিকট আওয়াজ। তখনই তারা ময়দানে আবির্ভূত হবে।’ (সুরা নাযিআত : ৬-১৪)।

২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৩ হিজরি মোতাবেক ২৮ জানুয়ারি ২০২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর আল মামুন নূর।

তথ্য সূত্র : https://www.alokitobangladesh.com/

Related posts

যে ৭ শ্রেণীর আমলকারীর জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন

News Desk

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও ইসলামের দৃষ্টিকোণ

লেমন কাওসার

ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরের ইতিহাস

News Desk

Leave a Comment