মেহেরুন্নেছা পায়েল জন্ম থেকেই অন্ধ। এটা মেনে নেননি তাঁর বাবা। তিনি স্ত্রী-কন্যাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।
কয়েক বছরের মাথায় মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত হন তিনি। তাঁর মাকে আবার বিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের সঙ্গে থাকার সুযোগ হয় না তাঁর। নানা-নানির কাছে বড় হতে থাকেন পায়েল।
শিশু পায়েল তখন কীই-বা আর বোঝে! কেবল সাক্ষী হয় এক রূঢ় বাস্তবতার।
সেই শিশু বয়স থেকেই পায়েলের লড়াই-সংগ্রাম শুরু। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও হাল ছাড়েন না তিনি।
অদম্য পায়েল তাঁর লড়াইয়ের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলেন। ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রামের হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনি। গতকাল রোববার এ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়।
জন্ম থেকে কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার যাত্রায় এইচএসসির এমন ফল পায়েলের জন্য ‘বসন্তের বার্তা’ হয়ে এসেছে। আজ প্রকৃতিতে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। বসন্তের রূপ পায়েল দেখতে না পারলেও তাঁর মনে আজ আনাবিল আনন্দ।
গতকাল ফল শোনার পর থেকেই পায়েল আনন্দে ভাসছেন। পায়েল বলেন, ‘পরীক্ষা ভালোই দিয়েছিলাম। ফল পেয়ে এখন খুব ভালো লাগছে। এত আনন্দ জীবনে আগে কখনো হয়নি।’
এসএসসিতে জিপিএ–৪ দশমিক শূন্য ৬ পায় পাওয়া পায়েল এত দূর আসতে পারবেন, তা তিনি ছোটবেলায় ভাবতে পারেননি। মা চলে যাওয়ার পর তাঁর জীবন আরও কঠিন হয়ে যায়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যোগ হয় আরও অনেক প্রতিবন্ধকতা। পড়ালেখা না হওয়ার ঝুঁকিতেও পড়েছিল তাঁর জীবন। তবে নিজের অদম্য ইচ্ছার কারণেই পড়ালেখা চালিয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি।
পায়েলের লড়াই-সংগ্রাম-সাফল্যের গল্পটা তাঁর মুখেই শোনা যাক—‘বাবা চলে যায় জন্মের পর। মাকেও বিয়ে দেওয়া হয়। নানা-নানি আমাকে বড় করেন। একসময় আমি পড়ার জন্য জেদ ধরি। আর সবার মতো পড়তে চাই। বড় হতে চাই। তারপর আমাকে মুরাদপুর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আবদুস সামাদ স্যার আমাকে বাবার স্নেহে গড়ে তোলেন। তাঁর প্রেরণাতেই এগিয়ে চলি আমি।’
পায়েল জানান, প্রথম দিকে তাঁর পড়ালেখার খরচ নানাবাড়ি থেকে দেওয়া হচ্ছিল। সপ্তম শ্রেণিতে এসে আর নানাবাড়ি থেকে খরচ আনতে হয়নি। সপ্তম শ্রেণি থেকে বিভিন্ন বৃত্তি পেতে থাকেন। এই বৃত্তির টাকা দিয়েই তাঁর পড়ালেখাসহ নিজের অন্যান্য খরচ চলে।
স্কুলে পড়ার সময় আবাসিক ছাত্রীনিবাসে থেকেছেন পায়েল। কলেজে ওঠার পর কখনো নানাবাড়ি পটিয়ার শান্তিরহাটে, কখনো–বা বান্ধবীদের বাসায় থেকে ক্লাস-পড়ালেখা করেছেন তিনি। এভাবে কষ্টের পর এক দারুণ সাফল্যের দেখা পেলেন পায়েল।
এইচএসসির ফল পেয়েই প্রিয় মানুষ সামাদ স্যারকে আনন্দের খবর দেন পায়েল। সাবেক শিক্ষক আবদুস সামাদ বলেন, ‘পায়েল খুব ভালো ছাত্রী। পড়ালেখার পেছনে তার অনেক সংগ্রাম আছে। তার সাফল্যে আজ আমার খুব ভালো লাগছে।’
মায়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হয় পায়েলের। দেখা-সাক্ষাৎও হয়। তবে তাঁর মা অন্য সংসারে থাকায় সেখানে পায়েলের ঠাঁই হয় না। সাফল্যের কথা মা, নানা-নানিকেও জানিয়েছেন তিনি।
আগে পায়েলের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ায় তাঁর প্রত্যাশা বেড়ে গেছে।
পায়েল বলেন, ‘আমি এখনো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই। এইচএসসিতে ফল যেহেতু ভালো হয়েছে, তাই আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়তে চাই। পড়ালেখা শেষে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখি।’
চোখে দৃষ্টি না থাকলেও পায়েলের ‘চোখ’ অনেক দূর। পায়েল জানেন, তাঁর চলার পথ মসৃণ নয়। তবে পথের বাধা ডিঙিয়ে চলার অভিজ্ঞতা ও সাহস উভয় আছে তাঁর। আত্মবিশ্বাস নিয়ে পায়েল বলেন, এবার নতুন স্বপ্নপূরণের পালা।