অভিজ্ঞতা অর্জনেই প্রকল্প পরিচালক স্ট্যাডি ট্যুরের নামে ব্যয় করেছেন ৬০ লাখ টাকা। আর যানবহন ভাড়া ও ফটোকপি মেশিন কিনতে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। দুটি জাহাজ কেনাসহ অন্যান্য কাজ ২০১৭ সালে মধ্যেই শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হলে প্রকল্প সংশোধন করে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়।
এ প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স নিউ ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডকেও প্রায় পুরো টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু বাড়তি সময়েও ৬৫ শতাংশের বেশি কাজ হয়নি। সংশোধনের সময় আইএমইডি থেকে তদারকি আরও জোরদার করতে বলা হলে প্রকল্প পরিচালক কর্তৃপক্ষকে কিছুই জানাননি।
আড়াই বছর আগে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও জাহাজের কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। ফলে এ প্রকল্পের ৭২ কোটি টাকা একেবারে জলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা কর্তৃপক্ষ। ঢাকাপ্রকাশের অনুসন্ধানে এমনই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
এটি যেনতেন কোনো প্রকল্প নয়, যাত্রীদের চাপ সামলাতে ‘ঢাকা-বরিশাল-খুলনা রুটে দুইটি নতুন যাত্রীবাহী জাহাজ সংগ্রহ’ প্রকল্পের বাস্তব চিত্র। সরকার ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা হচ্ছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)।
প্রথম থেকেই প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিআইডব্লিউটিসির সাবেক মহাব্যবস্থাপক (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত সরদার। তার সময়ে টেন্ডার আহ্বান, স্ট্যাডি ট্যুরসহ অন্যান্য কাজ হয়েছে।
আসলে ঘটেছে কী? জানতে ঢাকাপ্রকাশ থেকে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করা হয়। অনুসন্ধানেও জানা গেছে অজানা কাহিনী। তখনকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেউ দায় নিতে চাচ্ছেন না। আবার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কর্তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন।
তাই প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য প্রথম প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ২০২০ সালে অবসরে গেছি। সব কিছু কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছি চাকরি থেকে। কাজেই কোনো কথা বলা সম্ভব নয়।’
মেয়াদ শেষের পরও বিআইডব্লিউটিসি জাহাজ দুইটি বুঝিয়ে না পাওয়ায় সার্বিক ব্যাপারে কাজ করতে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় জিএম (মেরিন) খন্দকার মহিউদ্দিন আহমেদকে। বর্তমানে তিনিও চাকরি থেকে অবসরে।
তিনি বলেন, ‘আমি কখনো পিডির দায়িত্বে ছিলাম না। কাজেই জাহাজের ব্যাপারে কোনো কথা নেই। বরং ক্যাপ্টেন ডিজিএম (মেরিন) বাপ্পি কুমারই এর দায়িত্ব পালন করেন। আমি কিছু না।’
এদিকে বাপ্পির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ওই সময়ে পিডি ক্যাপ্টেন শওকত সরদারের চাকরিও শেষ হয়ে যায়। তাই কাউকে পিডি হিসেবে অফিশিয়ালি দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। শুধু কাগজপত্র দেখার জন্য খন্দকার মহিউদ্দিন আহমেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি যাওয়ার সময় অফিসে কাগজপত্র বুঝিয়ে দেননি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব আহমদ শামীম আল রাজী বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়েই জাহাজ দুটি উদ্ধারে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। আইএমইডির কাছেও সাহায্য চাওয়া হয়েছে। শেষ সময়েও এলসি খোলার জন্য ঠিকাদারকে অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিদর্শনেও গেছি। কোনো সাড়া পায়নি। বাধ্য হয়ে ঠিকাদারকে শোকজ করা হয়েছে। তার কোনো জবাবও পাইনি। বাধ্য হয়ে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ঠিকাদারকে। তাদের অর্ডারও ক্যান্সিল (আদেশ বাতিল) করা হয়েছে।’
পরিকল্পনা কমিশনের সূত্র জানায়, প্রকল্প সংশোধনের সময় আইএমইডি থেকে ২০১৮ সালে সুপারিশে বলা হয়েছিল গুণগত মান বজায় রেখে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে আরও তদারকি জোরদার করতে হবে। পরবর্তীতে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ আর বৃদ্ধি করা যাবে না।
তারপরও কেন এমন অবস্থা? কাজ শেষ না হলেও ঠিকাদারকে কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছিল?
এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রায় ৯৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। কাজের পরিমাণ সঠিকভাবে বলা মুসকিল। তবে প্রায় ৬৫ শতাংশ হতে পারে। প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে গাফিলতি ছিল, এটা বলা যায়। কারণ, সে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও জাহাজ বুঝে নিতে পারেনি। আবার কর্তৃপক্ষকে তা জানাননি। জানালে সময় বাড়ানো হত।
পিডির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘তার যেহেতেু চাকুরি শেষ এবং তার পাওনা আছে সরকারের কাছে। তাই তাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেহেতু এটি একটি প্রকল্প ছিল এবং সেটার মেয়াদ শেষ। আমি এখানে কিছুদিন আগে এসেছি। তবে ইতিহাসে কখনো এমন ঘটনা দেখিনি। প্রকল্প সংশোধন হয়, সময় বাড়ে, খরচ বাড়ে। কিন্তু সব কিছু করার পর প্রকল্প শেষ হলেও কাজ হলো না। মন্ত্রণালয়েও এ ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
পরিকল্পনা কমিশন ও বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, দেড় হাজারের বেশি যাত্রী ধারণ ক্ষমতার দুইটি জাহাজ কেনার জন্য ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল সরকার এ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। দুটি জাহাজ কেনার জন্য একই ঠিকাদারের সঙ্গে আলাদা করে ২০১৬ সালের ১ জুন ও ১৯ ডিসেম্বর দুটি চুক্তি হয়েছে। মোট ৩৪ কোটি টাকা করে ৬৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের আগস্টে জাহাজ দুটির নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা এবং একটি স্টাডি ট্যুরে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ও করা হয়।
এ ছাড়া, যানবহন ভাড়া ও ফটোকপি মেশিন কিনতে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। এভাবে বিভিন্ন খাতে ব্যয় করে প্রকল্পের কাজ শেষও করা হয়েছে। কিন্তু জাহাজ পায়নি বিআইডব্লিউটিসি।
নদীপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে দুটি যাত্রীবাহী জাহাজ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতিটিতে ৭৬৪ জন করে যাত্রী বহনের এ জাহাজ কেনার জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল মোট ৭২ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। যাত্রীবাহী জাহাজ নির্মাণে লট-১ এবং লট-২ নামে মেসার্স নিউ ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বিআইডব্লিউটিসি। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লট-১ এবং আগস্টে লট-২ এর জাহাজ দুইটি হস্তান্তর করার কথা ছিল। চট্রগ্রামের পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁওতে নির্মাণ করা হচ্ছিল এ দুটি জাহাজ।
অগ্রগতি কম হওয়ায় সংশোধন করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এক বছর সময় বাড়ায়। সে অনুযায়ী ২০১৮ সালে নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা। তারপরও ঠিকাদার বিভিন্ন সমস্যার অজুজাত দেখায় এবং প্রকল্পটি সংশোধন করে এর বাস্তবায়নকাল ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করে বিআইডব্লিউটিসি।
সে সময় ঠিকাদারকে নির্ধারিত সময়ে বুঝিয়ে দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু সংশেধিত নির্ধারিত সময়ের আড়াই বছর পার হয়ে গেলেও জাহাজ দুটি পেতে কোনো উপায় বের করতে পারছে না বিআইডব্লিউটিসি। এক সময়ের নাম করা এ কোম্পানিটিতে কী কারণে যেন বেশ পতন নেমে গেছে। তারপর থেকেই নিউ ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্সে তেমন কোনো জাহাজ নেই।
তাই সার্বিক বিষয়ে জানতে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অব.) ক্যাপ্টেন সোহেল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তার ফোন বন্ধ থাকায় মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে অন্য এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প চলা অবস্থায় ছিলাম। বর্তমানে নেই। তাই কিছু বলা যাবে না।’
১৯৭২ সালে বিআইডব্লিউটিসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ রুটটিতে যাত্রী পরিবহণের জন্য ৬টি জাহাজ ছিল। এরমধ্যে পাঁচটি জাহাজ বেশ পুরাতন হাওয়ায় জাহাজগুলোর মাধ্যমে নিরাপদ যাত্রীবাহী সার্ভিস সম্ভব না হওয়ায় ঢাকা-বরিশাল রুটে জাহাজ দুটি কেনার সিদ্ধান্ত হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, কোনো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে দুই মাসের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্তকরণ প্রতিবেদন (পিসিআর) দেওয়ার কথা। আইএমইডি তার প্রতিবেদন করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে। কিন্তু আড়াই বছর পার হলেও তা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিসি বলছে, যেহেতু প্রকল্পটি কাগজে শেষ, কিন্তু বাস্তবে জাহাজ বুঝে পাওয়া যায়নি। সুতরাং পিসিআর করাও সম্ভব হয়নি।