কোথাও কেউ নেই। মাথার ওপর শুধু বোমারু বিমানের শব্দ—পেট থেকে পড়া বোমাগুলো আগুনের লেলিহান শিখা আর ধ্বংসযজ্ঞ ছড়িয়ে ফাটছে বিকট শব্দে। এই নরক–গুলজারের মধ্যে সাততলার এক অ্যাপার্টমেন্টে একজন মানুষ একাই বসবাস করছেন। চাইলে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেন। পারছেন না পশুপ্রেমের বিনি সুতার মালায় বাঁধা পড়ায়।
এটুকু পড়ে মনে হতে পারে সিনেমার চিত্রনাট্য। পশুপ্রেম নিয়ে ভালো সিনেমা আছে বৈকি। ‘ওল্ড ইয়েলার’–এর ট্রাভিস, ‘ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন’–এর অ্যালেক কিংবা ‘হোয়াইট ফ্যাং’–এর জ্যাক—চরিত্রগুলো সিনেমায় পোষা প্রাণীর প্রতি ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক। কিন্তু জীবনের গল্প তো সিনেমাকেও ছাপিয়ে যায়। কোবাস অলিভিয়ের তেমনই এক বাস্তব গল্পের চরিত্র। কে জানে, ইউক্রেনে রক্তপাত থামার পর হয়তো তাঁকে নিয়ে সিনেমাও বানানো হতে পারে। তত দিন পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকবেন তো!
ইউক্রেনে বর্তমান সময়টা অতীতের আর দশটা সাধারণ দিনের মতো হলে অলিভিয়ের হয়তো স্কুলে পড়াতেন, ক্রিকেটের বীজ গেঁথে দিতেন তরুণ ইউক্রেনিয়ানদের মধ্যে। কিন্তু পূর্ব ইউরোপের দেশে এখন সময়টা অন্য রকম। গত বৃহস্পতিবার থেকে জল, স্থল ও আকাশপথে আক্রমণ শুরু করেছে রাশিয়া। সাধারণ মানুষ প্রাণভয়ে ভীত।
মাথার ওপর বোঁ বোঁ করে চক্কর মারা রাশান বিমানের পেট থেকে এই বুঝি বোমা পড়ল! লোকে ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুটছে আশ্রয়কেন্দ্রে। অলিভিয়ের যেতে পারছেন না। পোষা কুকুরগুলোকে যে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখতে পারবেন না। যেখানে সাধারণ মানুষেরই তিল ঠাঁই নেই, সেখানে কুকুরকে জায়গা দেওয়া তো বিলাসিতা।
কিন্তু অলিভিয়েরের কাছে তাঁর চার কুকুর টিকে, ওলি, কায়া ও জেসির জীবন তাঁর নিজের জীবনের মতোই দামি। তা না হলে, কুকুরদের ছেড়ে তিনি অনায়াসেই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে পারতেন। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ভুলে থাকতে পারতেন কিয়েভে নিজের বাসায় রেখে আসা পোষা প্রাণীগুলোকে। বাকি অবহেলার শেষটুকু সেরে দিতে পারত অনাহার কিংবা রাশান বোমা। কিন্তু অলিভিয়ের যেন ‘এইট বিলো’ সিনেমার জেরি শেফার্ড!
প্রাণ বাঁচাতে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে স্লেজ টানা কুকুরগুলোকে রেখে বাসায় ফিরে জেরি শান্তিতে থাকতে পারেননি, পোষা প্রাণীগুলোকে ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে আবারও ফিরে যান অ্যান্টার্কটিকায়। আর অলিভিয়ের? মানুষের মতো পশুদেরও বাঁচার অধিকারটুকু তাঁর শিরা–উপশিরায় জেগে ওঠায় বাসা ছেড়ে আর যাননি। কুকুরগুলোকে নিয়ে দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়ার প্রহর গুনছেন। নইলে একসঙ্গেই…।
‘ভোর চারটায় বোমা পড়া শুরু হয়। পাঁচটার দিকে কুকুরগুলোকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিলাম। খুব কাছেই বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হয়। দৌড়ে নিজের ফ্ল্যাটে চলে আসি। এরপর আর বাইরে বের হইনি। আমার তো ইউক্রেনিয়ান কিংবা রাশিয়ান ভাষা জানা নেই। প্রতিবেশীদের কাছে জানতে পারি, কম্বল, গরম কাপড় ও পানি নিয়ে নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হয়েছে মুঠোফোনে। পাতাল রেলস্টেশনগুলোকে বোমা থেকে বাঁচার আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমার ভবন এবং আশপাশের প্রায় সবাই এলাকা ছেড়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আমার কাছে চারটে কুকুরছানা থাকায় যেতে পারছি না’—অলিভিয়েরের বাস্তবতার এখানেই শেষ নয়, বাকিটাও শুনুন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে ওদের (কুকুর) নিয়ে যেতে পারব না। সেখানে হাজারো মানুষ, কুকুর রাখতে দেবে না। আমিও ওদের ছেড়ে যেতে পারব না। প্রচণ্ড ভয় নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে একা দিন কাটছে। পানি, খাবার ও কুকুরের খাবার মজুত আছে মাসখানেকের জন্য।’
রাশান ফৌজ কিয়েভের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। অলিভিয়ের প্রহর গুনছেন…। অথচ কিছুদিন আগেও অলিভিয়েরের বাস্তবতা ছিল অন্য রকম। চার বছর আগে ছুটি কাটাতে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে এসেছিলেন। তুষারশুভ্র শহরটা মনে ধরায় আর ফেরেননি। পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেয়েছেন ধীরে ধীরে। একটি প্রাইভেট স্কুলে ইংরেজি পড়ানোর পাশাপাশি তিনি ইউক্রেন ক্রিকেট ফেডারেশনের (ইউসিএফ) প্রধান নির্বাহী। কেপটাউনে জন্ম নেওয়া এই দক্ষিণ আফ্রিকানকে অনেকে ‘ক্রিকেট যাযাবর’ হিসেবে চেনেন। ৩৮টি দেশ ঘোরা অলিভিয়ের সাবেক ক্লাব ক্রিকেটার, নেদারল্যান্ডস যুব দলের সাবেক কোচ এবং ক্রিকেট কেনিয়ার সাবেক প্রধান নির্বাহী।
ডাচদের কোচ থাকার সময় তাঁর দলটা আয়ারল্যান্ডের যে অনূর্ধ্ব-১৭ দলের মুখোমুখি হয়েছিল, সে দলে ছিলেন এউইন মরগান, কেভিন ও’ব্রায়েন এবং উইলিয়াম পোর্টারফিল্ডরা। সেসব দিন পেছনে ফেলে অলিভিয়েরের কাছে বর্তমান হলো মুহুর্মুহু গুলি ও বোমার শব্দ এবং তাঁর মাঝে চারটে কুকুর নিয়ে বেঁচে থাকার প্রার্থনা। হ্যাঁ, শুধুই প্রার্থনা—এ ছাড়া আর কিছুই করার নেই, ‘আমি সাহসী নই, প্রচণ্ড ভয়ে আছি। আর কিছুই করার নেই। এটাই বাস্তবতা।’
বৃহস্পতিবার রাশিয়ার সেনাবাহিনী আক্রমণ শুরুর পর শুধু সেদিনই তিনি ১৯টি বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ পেয়েছেন। বিকট শব্দ এবং স্প্লিন্টারে যেন জানালার কাচ ভেঙে ছিটকে আসা কাচের টুকরাতে কুকুরগুলো আঘাত না পায়, সে জন্য জানালা তোশক ও কুশন দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন।
ঘরের মধ্যে প্রাণভয়ে থাকার দুশ্চিন্তা কাটাতে অলিভিয়েরের একমাত্র অবলম্বন টেলিভিশন। যুদ্ধের খবর শোনা এবং ক্রিকেট দেখার মাঝে তাঁর সময় কাটে। চলতি নিউজিল্যান্ড–দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজে চোখ রাখছেন। পাশে থাকায় কুকুরগুলো স্বস্তিতে থাকে বলে মনে করেন অলিভিয়ের, ‘টিভি দেখার সময় ওরা আমার পাশেই বসে থাকে। প্রায় সময় স্ন্যাকস খেতে দিই। ওরা এমনিতে চুপচাপ কিন্তু বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজে কেঁপে ওঠে।’
বাবার সঙ্গে একটি কুকুর নিয়ে কিয়েভে আসার পর এই শহরেই অলিভিয়েরের বাবা মারা যান। তারপর থেকে কিয়েভের সঙ্গে বিনি সুতার মালায় বাঁধা পড়া অকৃতদার অলিভিয়েরের ধ্যান–জ্ঞানজুড়ে এই শহর, ‘৩৮টি দেশ ঘুরেছি। কিন্তু কিয়েভ আমার জন্য অনন্য অভিজ্ঞতা। আমার বাবা এখানে মারা গেছেন। কিয়েভের সঙ্গে তাই হৃদয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়েছি। যা–ই ঘটুক না কেন, যাচ্ছি না।’
ইউক্রেনে প্রায় ১৫ হাজার বিদেশি ছাত্র আছেন। বেশির ভাগই ভারতীয়। তাঁদের পুঁজি করে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ক্রিকেটে উন্নতির চেষ্টা করছে দেশটি। অলিভিয়েরের হাত ধরে আইসিসির সহযোগী সদস্য হওয়ার কাছাকাছিও পৌঁছে গিয়েছিল ইউক্রেন। কিন্তু সামনে কী ঘটবে, তা অলিভিয়েরের ভাষায়, ‘কেউ জানে না। জুনেই পরবর্তী টুর্নামেন্ট। আশা করি তার আগেই সব থেমে যাবে।’
বৃহস্পতিবার থেকে ইউক্রেনিয়ানরা কিয়েভ ছাড়তে ছাড়তে শহরটি এখন প্রায় জনশূন্য। ‘ইউক্রেনে ক্রিকেটের উন্নতিই আমার ধ্যানজ্ঞান। গত কয়েক বছর প্রতিদিন অনেক কষ্ট করেছি। স্কুলে গেলে বাচ্চারা জানতে চাইত, কখন ক্রিকেট খেলতে পারব? এখন যদি চলে যাই তাহলে আর কি ফেরা হবে? ক্রিকেট ছেড়ে এভাবে যেতে পারব না’—এই ঘোরলাগা আশায় মজেই যুদ্ধের আগে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খালি করে সব টাকা ডলারে ভাঙিয়ে অলিভিয়ের খাবার মজুত করেছেন বাসায়। আর প্রহর গুনছেন বেঁচে থাকলে যুদ্ধ থামার পর সবার আগে যেতে হবে খারকিভে।
খারকিভ শহরটি ইউক্রেনের ক্রিকেট আঁতুড়ঘর। ইউক্রেনের সিনিয়র খেলোয়াড়েরা সেখানে থাকেন। ২০০১ সাল থেকে সেখানে ক্রিকেট লিগ হয়। এই শহরে আটকা পড়া এশিয়ান ছাত্র ও ক্রিকেটাররা খুব বাজে অবস্থায় আছে বলে জানালেন অলিভিয়ের। ‘প্রায় হাজার দুয়েক ক্রিকেটার আটকা পড়েছে সেখানে’—অলিভিয়েরের দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
খারকিভ শহর রাশিয়ান সেনাবাহিনীর আক্রমণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু। সেখানে ক্রিকেট অবকাঠামো টিকে থাকবে কি না, এই দুশ্চিন্তায় পুড়ছেন অলিভিয়ের, ‘বোমা হামলায় আমাদের ক্রিকেট ওভাল টিকে থাকবে কি না জানি না। এটা আমাদের ক্রিকেটের সদর দপ্তর হওয়ার কথা ছিল…কিন্তু জানি না সামনে কী হবে। আমি শুধু আশাই করতে পারি।’