Image default
বাংলাদেশ

এক জেলায় বছরে ৫২৪ আত্মহত্যা, নেপথ্যে হতাশা-অভিমান

দিন দিন আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে পরিবার, প্রেমিক কিংবা বন্ধুর সঙ্গে অভিমান ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে কম বয়সী তরুণ-তরুণীরা বেশি আত্মহত্যা করছেন। ময়মনসিংহে ২০২১ সালে ৫২৪ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি। তবে জেলায় প্রকৃতপক্ষে আত্মহত্যার সংখ্যা আরও বেশি। 

পুলিশ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অভিমান ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে কম বয়সী তরুণ-তরুণীরা বেশি আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যা ঠেকাতে পারিবারিক কাউন্সিলিং বাড়ানো প্রয়োজন।

১৩ উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ জেলা গঠিত। লোকসংখ্যা ৫৩ লাখের ওপরে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জনবহুল এই জেলায় বছরে আত্মহত্যার দিক দিয়ে সারা দেশের কয়েকটি জেলার মধ্যে অন্যতম। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অকারণে ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যার পথ বেচে নিচ্ছে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২১ সালে জেলায় আত্মহত্যা করেছে ৫২৪ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ৫৫৪ জন। ২০২১ সালে গলায় দড়ি দিয়ে ২৬৬ জন, বিষপানে ১২৪ জন এবং অন্যান্যভাবে ১৩৪ জন আত্মহত্যা করেছে। জেলার ১৩ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার সংখ্যা ময়মনসিংহ সদর উপজেলায়। ২০২০ সালে এই উপজেলায় ১৩৮ জন আত্মহত্যা করেছে। তবে ২০২১ সালে আত্মহত্যা কিছুটা কমে ৯৯ জনে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে কম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে নান্দাইল উপজেলায় ২০২০ সালে ১৭ জন এবং ২০২১ সালে ১৪ জন। এদের বেশিরভাগ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

চলতি মাসের ১৩ মার্চ স্বাধীন এবং বেপরোয়াভাবে জীবনযাপন করতে না পারায় বাবা-মা ও ভাইয়ের সঙ্গে অভিমান করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নগরীর স্বদেশী বাজারের বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে সরকারি বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী অর্ক প্রিয়া ধর শ্রীজা (১৫)। সে নগরীর শিক্ষক স্বপন ধরের মেয়ে। এ ঘটনায় মানুষের মাঝে এখনও নানা আলোচনা চলছে।

এর আগে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি মোবাইলে গেম খেলতে নিষেধ করায় নগরীর শিকদার বাড়িতে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ঘরের দরজা বন্ধ করে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শ্রাবণ সিংহ (১২)। সে ওই এলাকার চিত্র মোহন সিংহের ছেলে। ছেলের মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে পরিবারটি।

অপরদিকে, গত ১১ জানুয়ারি গৌরীপুর উপজেলার সহনাটী ইউনিয়নে খাওয়া নিয়ে খোঁটা দেওয়ায় মায়ের সঙ্গে অভিমান করে চিরকুট লিখে আমগাছের ডালে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে তুষার মিয়া (১৫) নামে দশম শ্রেণির এক ছাত্র। তুষার পাছার গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে।

কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি শাহ কামাল আকন্দ বলেন, কোতোয়ালি থানায় লোকসংখ্যা বেশি; তাই আত্মহত্যার সংখ্যাও বেশি। বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান, চাওয়া পাওয়ার ব্যত্যয় ঘটলে আত্মহত্যা করে। পুলিশের তথ্যের চেয়েও বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। অনেক পরিবারের কেউ আত্মহত্যা করলে লোকলজ্জা ও হয়রানির ভয়ে প্রকাশ করে না।

সরকারি বিদ্যাময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার বলেন, আবেগে শিশুরা বেশিরভাগ সময় আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যারোধে প্রত্যেক বিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে দাবিও জানিয়েছি বেশ কয়েকবার। শিশুর মনন বিকাশে আমাদের প্রতিষ্ঠানে কোনও বিষয় নেই। অনেকে মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করে বসে আছেন। তাদের প্রত্যেক স্কুলে নিয়োগ দিয়ে শিশুদের কাউন্সিলিং করা হলে আত্মহত্যারোধ হবে। কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলে তা প্রতিরোধে আমি শিশুদের বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু একার পক্ষে সব সম্ভব হয় না। অনেকে আবেগে আত্মহত্যা করে আবার অনেকে তিলেতিলে মারা যাচ্ছে। মেধাশূন্য হচ্ছে জাতি। সর্বশেষ দশম শ্রেণির ছাত্রী শ্রীজার আত্মহত্যা কিছুতেই মানা যাচ্ছে না। 

চিরকুট লিখে আমগাছের ডালে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে তুষার মিয়া

ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হানুল ইসলাম বলেন, ‘এই যুগের ছেলেমেয়েরা একটু বেশি আবেগী। তারা বাবা-মা এবং আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে অভিমান করেই আত্মহত্যার পথ বেচে নিচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি যত্রতত্র ব্যবহারও অনেকাংশে দায়ী। এই থেকে ছেলেমেয়েদের দূরে রাখতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নিতে হবে পরিবারকে। প্রত্যেক পরিবারে বাবা-মায়ের উচিত, তাদের সন্তানদের একটু বেশি সময় দেওয়া। তারা কি করছে, না করছে তার খোঁজখবর রাখা। তাহলেই আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসবে।’

নগরীর নাসিরাবাদ কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মাহবুবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পারিবারিক বন্ধন আগের তুলনায় অনেক কমে যাওয়ায় আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। মানুষ মানসিক দুরবস্থা থেকে আত্মহত্যার পথ বেচে নেয়। গোপনে অনেক ছেলেরা নেশা করে। একসময় নেশা না করতে পেরে আত্মহত্যা করে। এজন্য পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষকরাও দায়ী। আগে পরিবার এবং শিক্ষকরা যেভাবে ছেলেমেয়েদের শাসন করতো, এখন তা কমে গেছে। অল্প বয়সে স্মার্টফোনের কারণে প্রেমের ফাঁদে পড়ছে তরুণ-তরুণীরা। ফলে একসময় তারা ব্রেকআপে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। আত্মহত্যা রোধে পরিবার ভূমিকা রাখতে পারে। কোনও ছেলেমেয়ে যদি আত্মহত্যা করতে চায়, তাদের লক্ষণ দেখলেই বোঝা যায়। তখন যদি মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে ওই ছেলে কিংবা মেয়ে কোনোদিন আত্মহত্যা করবে না। তাকে মেডিসিনের পাশাপাশি একটু কাউন্সিলিং করলেই ঠিক হয়ে যায়।’

Source link

Related posts

দুই ডোজ টিকা নিলেও নিস্তার নেই ডেল্টা থেকে

News Desk

সততার সঙ্গে সত্য প্রকাশ করি

News Desk

দাম কমল পেঁয়াজের

News Desk

Leave a Comment