অসংখ্য কালজয়ী বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী, দেশবরেণ্য কিংবদন্তি চিত্রনায়িকা, সবার অতি প্রিয় মিষ্টিমেয়েখ্যাত কবরী। এই মহান অভিনেত্রীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল, করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। প্রয়াণ দিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।
কবরী (মিনা পাল/ধর্মান্তরিত নাম সারাহ বেগম কবরী), ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল, মায়ের নাম শ্রীমতি লাবণ্য প্রভা পাল।
পারিবারিকভাবে শিল্প-সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা কবরীর জন্মস্থান বোয়ালখালী হলেও তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রাম নগরীতে। ১৯৬৩ সালে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভাব হয় কবরীর।
চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক সত্য সাহার মাধ্যমে ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং’ সিনেমার নায়িকা হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিনয়জীবন শুরু হয় নায়িকা কবরীর। ব্যাপক ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি ‘সুতরাং’ অর্জন করেছিল আন্তর্জাতিক পুরস্কারও।
কবরী অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- বাহানা, হীরামন, সোয়ে নদীয়া জাগে পানি, নিশি হলো ভোর, সাত ভাই চম্পা, আবির্ভাব, বাঁশরি, অরুণ বরুণ কিরণমালা, শীত বসন্ত, চোরাবালি, পারুলের সংসার, প্রতিকার, ময়নামতি, আগন্তুক, নীল আকাশের নিচে, পদ্মানদীর মাঝি, মেহেরবান, নতুন ফুলের গন্ধ, যে আগুনে পুড়ি, আঁকাবাঁকা, সন্তান, নায়িকা, দ্বীপ নেভে নাই, দর্পচূর্ণ, ক খ গ ঘ ঙ, বিনিময়, রং বদলায়, কত যে মিনতি, অধিকার, ঢেউয়ের পরে ঢেউ, আপন পর, পিতা পুত্র, ঘূর্ণিঝড়, সাধারণ মেয়ে, কাঁচকাটা হীরে, জলছবি, সুখদুঃখ, গাঁয়ের বধূ, স্মৃতিটুকু থাক, শেষ রাতের তারা, কমলরাণীর দীঘি, নিজেরে হারায়ে খুঁজি, লালন ফকির, রক্তাক্ত বাংলা, রংবাজ, খেলাঘর, বলাকা মন, যাহা বলিব সত্য বলিব, কে তুমি, তিতাস একটি নদীর নাম, অনির্বাণ, আমার জন্মভুমি, অঙ্গীকার, চোখের জলে, চাবুক, উৎস্বর্গ, মাসুদ রানা, ভুল যখন ভাঙল, বেঈমান, অবাক পৃথিবী, পরিচয়, দুইপর্ব, ত্রিরত্ন, সুজন সখী, ধন্যি মেয়ে, ডাকপিয়ন, লাভ ইন সিমলা, উপহার, জালিয়াত, চলো ঘর বাঁধি, রংবেরং, রক্তের ডাক, গুন্ডা, গোপন কথা, অনুরোধ, মতিমহল, সাগরভাসা, তৃষ্ণা, মমতা, কুয়াশা, ফরিয়াদ, রক্তশপথ, অঙ্গার, আগুনের আলো, সারেং বৌ, বধু বিদায়, দিন যায় কথা থাকে, মধুমতি, ছোট মা, আরাধনা, শহর থেকে দূরে, ঈমান, নওজোয়ান, সোনার হরিণ, সোনার তরী, কলমীলতা, লাল সবুজের পালা, স্বামীর সোহাগ, দেবদাস, আরশিনগর, আশা, প্রেমবন্ধন, সোনালী আকাশ, দুই জীবন, চেতনা, ছোট বৌ, লাখে একটা, দয়ামায়া, অপরাজিত নায়ক, দেমাগ, বিয়ের ফুল, আামাদের সন্তান, জীবনের গল্প, আয়না, মেঘের কোলে রোদ, পিতা মাতার আমানত, তুমি আমার স্বামী ইত্যাদি।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য নায়িকা কবরী যেসব পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, ছবি-সারেং বৌ (১৯৭৮), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আজীবন সম্মাননা-২০১৩ বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, ছবি- লালন ফকির (১৯৭৩), সুজন সখী (১৯৭৫), সারেং বৌ (১৯৭৮), দুই জীবন (১৯৮৮) ও বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার আজীবন সম্মাননা-২০০৯ পান। এ ছাড়াও প্রযোজক সমিতি চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক নানা পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।
কবরী টেলিভিশন নাটকেও অভিনয় করেছেন। পরিচালনাও করেছেন। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’ মুক্তি পায় ২০০৬ সালে। সরকারি অনুদানে ‘এই তুমি সেই তুমি’ নামে আরেকটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করছিলেন তিনি। এই ছবিটির শুটিং শেষ করে সম্পাদনার কাজ করছিলেন।
নায়িকা কবরী একসময় সরাসরি রাজনীতিতে আসেন। ‘বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট’-এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কবরীর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’ প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে কবরী, দুইবার বিয়ে করেছেন। প্রথম বিয়ে করেন চলচ্চিত্র প্রযোজক চিত্ত চৌধুরীকে। কিছুদিন পর তাঁর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরে ১৯৭৮ সালে কবরী বগুড়ার এক দরবেশের কাছে গিয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। সেখানেই তিনি সফিউদ্দীন সরোয়ার বাবুর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। দীর্ঘ ৩০ বছর সংসার করার পর ২০০৮ সালে তাঁদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরীর পাঁচ ছেলে সন্তান রয়েছে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অসম্ভব জনপ্রিয় অভিনেত্রী কোটি কোটি ভক্ত-দর্শকদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন নায়িকা কবরী। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে বাণিজ্যিকভাবে সুদৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড় করাতে চিত্রনায়িকা কবরীর বিশেষ অবদান রয়েছে। এ দেশের চলচ্চিত্রের সফল রোমান্টিক চিত্রনায়িকা তিনি। তখনকার সময়ে সিনেমা দর্শকদের হৃদয়ে অন্যরকম এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, রাজ্জাক-কবরী জুটি। যাঁদের অভিনয় প্রতিভায়, হিন্দি-উর্দু সিনেমার দাপটের সঙ্গে টক্কর দিয়ে টিকে থাকে আমাদের বাংলাদেশের সিনেমা।
স্বাধীনতার পর রাজ্জাক-কবরী জুটি আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জনপ্রিয়তা ও সফলতার শীর্ষে অবস্থান করেন কবরী। বাংলাদেশের সিনেমার যথার্থ চিত্রনায়িকা হিসেবে জয় করে নেন কোটি মানুষের ভালোবাসা।