এক আফগান ক্রিকেট কন্যার দুঃখ ও স্বপ্ন
খেলা

এক আফগান ক্রিকেট কন্যার দুঃখ ও স্বপ্ন

গতবছর তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর থেকে আফগানিস্তানে সব ধরনের খেলাধুলায় নারীদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে মুখ থুবড়ে পরেছে আফগানিস্তান নারী ক্রিকেট দলের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের একজন রয়া শামিম। ২৮ বছর বয়সী এই নারী ক্রিকেটার দেশ থেকে পালিয়ে এখন কানাডায় আশ্রয় নিয়েছেন। সেখান থেকে ইএসপিএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন নিজের আক্ষেপ, দুঃখ এবং আফগানিস্তানে নারী ক্রিকেট নিয়ে তার স্বপ্নের কথা।

আফগানিস্তানের জার্সি গায়ে এখনো কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারেননি রয়া শামিম। তবে সেটি বাস্তবে না হলেও এবার ভার্চুয়ালি পূরণ হয়েছে। সম্প্রতি একটি অনলাইন স্পোর্টস প্রতিযোগিতার আয়োজন করে গ্লোবাল ই-স্পোর্টস। সেখানে নারী বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলে আফগানিস্তান। ম্যাচটিতে আফগানিস্তানের জার্সি গায়ে ভার্চুয়ালি রয়া শামিমের উপস্থিতিও ছিল। এই ম্যাচটি ছিল মূলত আফগানিস্তানে নারীদের খেলাধুলায় নিষিদ্ধ করার ভার্চুয়াল প্রতিবাদ।

এ বিষয়ে রয়া শামিম বলেন, ‘ম্যাচটি যারা খেলেছে তারা সবাই আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এটি মোমবাতি প্রজ্বলন প্রতিবাদের মতো, তবে কোনো মোমবাতি ছিল না। এটি মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে আমরা এখানে আছি, কোথাও চলে যাইনি। আমি জাতীয় মাঠে খেলতে পারিনি, কিন্তু ভার্চুয়ালি খেলেছি। এবং যখন আমি এটি দেখি, নিজেকে নিয়ে গর্বিত হই এবং বলি, হ্যাঁ! আমি আফগানিস্তান জাতীয় দলে ছিলাম।’

আফগানিস্তানে কখনোই নারী ক্রিকেট জনপ্রিয় ছিল না। সমাজের লোক খারাপ চোখে দেখতো। তাই বাড়ির ভেতরেই ভাই-বোনদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন রয়া শামিম। দেশটিতে ২০১৯ সালের দিকে প্রফেশনাল নারী ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয়। ওই সময় একটি প্রতিষ্ঠানে গণিতের শিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন শামিম। তখন ভাবেন ক্রিকেট তার ক্যারিয়ার হতে পারে এবং সে পথে অগ্রসরও হন। ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রথমবার ২৫ জন নারী ক্রিকেটারকে চুক্তির আওতায় নিয়ে আসে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি)।

২৮ বছর বয়সী এই নারী ক্রিকেটার বলেন, ‘সেখানে কিছু লোক ছিল যারা আমাদের গ্রহণ করছিল এবং অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তারা বলতো, আমরা পারবো। সেখানে এমনও মানুষ ছিল, যারা তাদের কন্যাদের স্কুলে যেতে বলতো। ক্রিকেট এবং অন্য খেলার ইভেন্টে অংশ নিতেও বলতো। ধীরে ধীরে এসব গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছিল।’

রয়া শামিম বলেন, ‘পুরুষ ক্রিকেট দলের কোচ ও ট্রেইনাররা আমাদের নিয়েও কাজ করতো। এসিবি আমাদের জন্য সপ্তাহে তিন-চার ক্যাম্পের আয়োজন করতো। আমরা দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে একে অপরের বিপক্ষে খেলতাম। দিনে সাত-আট ঘণ্টা ক্রিকেট নিয়ে থাকতাম। প্রথমে আমরা এসিবির প্রধান কার্যালয়ে যেতাম এবং সেখান থেকে ভিক্টোরি ক্রিকেট একাডেমিতে। তারপরে আমরা ফিটনেস ক্লাবেও সময় দিতাম। আমরা প্রফেশনাল হতে চেয়েছি এবং অনেক উন্নতিও করেছি।’

ওই সময়ে ওমান অথবা বাংলাদেশ নারী দলের বিপক্ষে কিছু ম্যাচ আয়োজন নিয়েও কথা হচ্ছিল। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। শামিমের কথায়, ‘আমাদের চুক্তির ছয় মাসও পূর্ণ হয়নি। তার মধ্যেই তালেবানরা আসে এবং সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়।’ গতবছরের আগস্টে ক্ষমতা দখল করে তালেবান। সে সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘তালেবানরা যখন দুটিরও বেশি প্রদেশ ও বড় শহর হেরাত দখল করে নেয়, আমরা ভয় পেয়ে যাই। আমি আমার ক্রিকেট ম্যানেজারকে বলি, যদি আপনি জানেন যে এখানে ক্রিকেট কার্যক্রম চলবে এবং শান্তি বজায় থাকবে, তাহলে আমি কোথাও যাবো না। জবাবে ম্যানেজার বলেছিল, তিনি গ্যারান্টি দিতে পারবে না, মেয়েদের জন্যও পরিস্থিতি ভালো না। তোমার চলে যাওয়া উচিত। এরপরই আমরা কাবুল ছেড়ে চলে আসি। এর তিন দিন পরই তালেবানরা কাবুল দখল করে নেয়।’



‘স্বপ্ন, ইচ্ছে এবং আশা সবকিছুই ভুল দিকে যাচ্ছিল। এটি এমনই খারাপ পরিস্থিতি ছিল যে, এখনো মনে আসলেই আমার কান্না আসে।’ শামিমের অনেক সতীর্থই আফগানিস্তানে রয়ে গেছে। মাত্র দুই জোড়া পোশাক সঙ্গে নিয়ে কানাডায় পাড়ি জমাতে সক্ষম হন শামিম। ভাই এবং দুই বোনও তার সঙ্গে গেছে। এখন নতুন দেশে ও সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন এই আফগান কন্যা। রয়া শামিম বলেন, ‘আমার জীবন কেমন চলছে তা ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। আফগানিস্তানে আমার ভালো ক্যারিয়ার ও অন্যান্য কিছু ছিল। বন্ধু ও একটি দলও ছিল। লোকেরা আমাকে নিয়ে গর্বিত হতো। কিন্তু এখানে (কানাডা) সবকিছু শূন্য থেকে শুরু করতে হচ্ছে। তবু, আমি শুরু করতে পেরেছি। কারণ, আমি জানি যে আমি শক্তিশালী, আমি যেকোনো কিছুই মোকাবিলা করতে পারি। কিছু বন্ধুও জুটেছে, ক্রিকেট খেলা ও কাজও শুরু করেছি। সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। আমি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘যখন আমি শুনি যে তালেবানরা মেয়েদের স্কুলে যেতে দেবে না, তখন আমি এর বিপক্ষে প্রতিবাদ করার জন্য আফগানিস্তানে ছিলাম না। কেবল কান্না করেছি। আমি কিছুই করতে পারিনি। যদি আপনি ভবিষ্যত পরিবর্তন করতে চান তাহলে নারীদের শিক্ষিত করতে হবে। এটি দেখা খুবই কঠিন যে আমাদের দেশ সবকিছুই হারাচ্ছে। এটি কষ্ট দিলেও আমি কিছু করতে পারছি না। কেবল এভাবেই প্রতিবাদ জানাতে পারবো।’

যাইহোক, কানাডাতে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করার ব্যাপারে আশাবাদী শামিম। আশপাশে কয়েকটি ক্লাবও রয়েছে। তিনি বলেন, ‘যদি ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে আমাদেরকে কিছু সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে আমরা খুবই খুশি হবো। এমনকি ট্রায়ালের জন্যও আমরা প্রস্তুত। আমি ক্রিকেট খেলি, কারণ আমি জানি এটাই আমার ক্যারিয়ার। ভবিষ্যতে হয়তো আমি কোনো জাতীয় দলেও সুযোগ পাবো। এর জন্য আমি কঠোর পরিশ্রম করছি। আমি সবকিছুই হারিয়েছি, এখন ক্রিকেটই আমার জীবন হতে পারে।’

কোচিং পেশায় জড়িত হওয়ার আগে আরও সাত-আট বছর ক্রিকেট খেলতে চান রয়া শামিম। তিনি চান না বিশ্ব মঞ্চ থেকে আফগানিস্তান চলে যাক। তাই তিনি আফগানিস্তান পুরুষ ক্রিকেট দলকে সমর্থন করেন। কারণ, এই দলটিই আফগানদের মাঝে খুশি এনে দিতে পারে। পাশাপাশি স্বপ্ন দেখেন, একদিন আফগানিস্তানে গিয়ে দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলবেন। রয়া শামিম বলেন, ‘এই মুহূর্তে দেশে যাওয়া অসম্ভব। কারণ, তালেবান আমাকে গ্রহণ করবে না এবং আমিও তাদের মেনে নেবো না। কিন্তু যদি কোনো পরিবর্তন হয়। যেমন: হয়তো তারা নারীদের ক্রিকেট খেলার অনুমতি দিলো অথবা কোনো একটি ম্যাচ আয়োজিত হলো। আমি সেখানে যাবো। কারণ, সেটাই আমার দেশ।’

Source link

Related posts

অ্যালেন ল্যাজার্ড বলেছেন: “অ্যারন রজার্স থেকে শন পেটনকে নামিয়ে নিন” এখানে সবার সাথে কথা বলুন

News Desk

জিম্বাবুয়ে-যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচের ফল বিশ্বকাপে কোনো কাজে আসবে না: সাকিব

News Desk

অধিনায়ক সম্পর্কে কি বললেন লিটন?

News Desk

Leave a Comment