ফরিদপুরের সালথায় দু’দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে ওই এলাকার কয়েকটি গ্রাম। দুটি পৃথক মামলায় ১৩৩ অভিযুক্তের প্রায় সবাই পুরুষ, এছাড়া রয়েছে ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামি। গ্রেফতার এড়াতে গ্রামের পুরুষ সদস্যরা গা ঢাকা দিয়েছেন। এ অবস্থায় গ্রামের নারী ও শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তবু বাধ্য হয়ে জমিতে ফসল উৎপাদনের কাজ করতে হচ্ছে তাদের।
জানা যায়, গত দেড় মাস আগে খারদিয়া গ্রামের প্রভাবশালী বাসিন্দা যদুনন্দি ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিক মোল্যার সমর্থকদের সঙ্গে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর মিয়ার সমর্থকদের কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পুলিশ রফিক মোল্যা ও আলমগীর মিয়াকে গ্রেফতার করে হামলা মামলায় আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায়।
গত ২৮ এপ্রিল তারা উভয়ই আদালত থেকে জামিন পেয়ে এলাকায় ফিরে আসেন। জামিনে বের হয়ে এলে আবার এলাকায় উভয়পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এর ধারাবাহিকতায় গত ৫ মে দুই পক্ষের শতাধিক সমর্থক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় অন্তত ৩৫ জন আহত হন। ৫০টির বেশি বাড়িঘর চালানো হয় হামলা। লুটপাট করা হয় ঘরে থাকা টাকা পয়সা ও আসবাবপত্র। সংঘর্ষে আহত আলমগীরের সমর্থক সিরাজুল ইসলাম নামে এক যুবক নিহত হন।
এ ঘটনায় সালথা থানায় যদুনন্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম রফিক মোল্যাকে প্রধান আসামি করে ৫৬ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ১৫/২০ জনের নামে হত্যা মামলা করা হয়। অপরদিকে কাজে বাধা দানের অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে আরও একটি মামলা করে। এতে ৭৭ জনের নামে এবং অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
দুই মামলার পর পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে খারদিয়া, উজিরপুর ও সাধুহাটি গ্রাম। ইতোমধ্যে কাজে বাধা দানের মামলায় এজাহারভুক্ত দুই ও সন্দেহভাজন ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে হত্যা, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
তবে মামলার পরেও প্রতিপক্ষের বাড়ি-ঘরে চোরাগোপ্তা হামলার অভিযোগ উঠেছে। চলছে নিজেদের অথবা অন্য বাড়ি থেকে লুট করা মালামাল স্থানান্তর। এমন অবস্থায় গ্রামের মানুষের সার্বিক নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সালথার খারদিয়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, নারী ও শিশু ছাড়া কেউ বাড়িতে নেই। বিভিন্ন বাড়ির নারী ও শিশুদের চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ। ফসলি মাঠেও দেখা মেলেনি কোনও কৃষকের, সেখানেও কাজ করছেন নারীরা।
খারদিয়া গ্রামের বাসিন্দা বিশু শেখ অভিযোগ করেন, পুলিশের সামনেই বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করছে আলমগীর মিয়ার লোকেরা। আমরা সব সময় গ্রেফতার আতঙ্কের মধ্যে আছি। পুলিশ যাকে ইচ্ছা তাকেই আটক করছে। এই সুযোগে আলমগীর মিয়ার লোকেরা আমাদের এলাকার কিছু কিছু মেয়েদের নির্যাতন করারও চেষ্টা চালাচ্ছে। একটি পরিবারতো নির্যাতনের কারণে এলাকা ছেড়ে ময়মনসিংহ চলে গেছে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘যে বেশি টাকা দেয়, পুলিশ তার হয়েই কাজ করে। আবার নিজেদের ফসল বাজারে বিক্রি করতেও পুলিশকে দিতে হচ্ছে টাকা। টাকা না দিলে পুলিশ মালামাল বহনকারী গাড়ি আটকে দিচ্ছে। এক-দুই মণ পেঁয়াজ নিজ বাড়ি থেকে নিলে সমস্যা হয় না, ৫-১০ মণ বা এর চেয়ে বেশি পেঁয়াজ বিক্রি করতে গেলে পুলিশকে টাকা দিতে হয়। আবার ঘরের মালামাল স্থানান্তরের জন্য বকুল মোল্যা, মিন্টু, পান্নু, ইরন মেম্বার, আনোয়ারসহ আরও অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে পুলিশ। এসব থেকে আমরা মুক্তি চাই।’
একই গ্রামের সালেহা বেগম বলেন, সংঘর্ষের পর এলাকায় পুলিশ থাকা অবস্থায় উজিপুর গ্রামে মানোয়ার ফকিরের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর মিয়ার সমর্থকেরা। এতে ঘরসহ বেশ কিছু মালামাল পুড়ে যায়। এছাড়া শতাধিক বাড়ি-ঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। ভয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়াও বাদ দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘নারীদের পেলে অত্যাচার ও নির্যাতন করা হচ্ছে। এ কারণে কম বয়সী নারী ও তরুণীদের এলাকা থেকে অন্যস্থা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন পাট ক্ষেতের পরিচর্যার সময়। গ্রামের সব পুরুষ আত্মগোপনে থাকায় মাঠের ফসলের সঠিক পরিচর্যা করা যাচ্ছে না। এতে আমরা ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছি। এই ফসল বিক্রি করেই আমাদের সারা বছরের সংসার খরচ চলে। এখন কি করবো; ভেবে পাচ্ছি না।’
গ্রামের আরেক বাসিন্দা সবুরন বেগম বলেন, আমি গরুর খামারে কাজ করি। অনেক কষ্ট করে একটা ঘর করেছিলাম, সেই ঘরটি তছনছ করে ফেলা হয়েছে। আমি এখন পরের বাড়িতে থাকি। আমাদের গ্রামে রাতে নারীদের ঘরে থাকাটাও কষ্টকর। আলমগীর মিয়ার সমর্থকেরা দিনের বেলায় মিল্টন মীরদের বাড়িতে থাকে আর রাতের বেলায় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রাত ২-৩টার সময় নজরুল, মজলু, মেজন, রহিম ইব্রাহিম, ইলাহি, শহিদুল, নজরুল শিকদার, টিপুসহ আরও অনেকে নারীদের বিভিন্ন ভাষায় গালাগালি করে। আমাদের পাশের গ্রাম সাধুহাটি একটি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে আলমগীর মিয়ার সমর্থকেরা।
এসব বিষয়ে ফরিদপুরের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (নগরকান্দা-সালথা সার্কেল) মো. সুমিনুর রহমান বলেন, কিছু বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। একটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে বলেও শুনেছি। এসব যাতে আর না ঘটে সেজন্য ওই এলাকায় অস্থায়ীভাবে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। মূলত পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে।
এ সময় সংঘর্ষে জড়িত বিভিন্ন পক্ষ এবং স্থানীয়দের থেকে পুলিশ টাকা নিচ্ছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনও অভিযোগ আসেনি। এমন কোনও ঘটনা ঘটলে আমাদের লিখিতভাবে জানালে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার সুমিনুর রহমান আরও বলেন, খারদিয়ার সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি পুলিশের কাজে বাধা প্রদান ও অন্যটি হত্যা মামলা। দুটি মামলার আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। খারদিয়া এলাকায় যেকোনও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ মাঠে কাজ করছে বলে জানান তিনি।