তাইওয়ান ভুখণ্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বরাবরই বিপরীত মেরুতে। এ ইস্যুতে দেশ দুটি দীর্ঘকাল ধরেই দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। এখন সেই দ্বন্দ্ব বেশ শক্তভাবেই মাথাচারা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে জোরেসোরেই বিরোধীতা করে চীন।এমনকি দুই দেশের শীর্ষ নেতা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে টেলিফোনে দীর্ঘসময় ধরে এ সফরকে কেন্দ্র করে তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়। কিন্তু চীনের বিরোধীতাকে উপেক্ষা করেছেন ন্যান্সি। তার তাইওয়ান সফরের পর এই ভুখণ্ডের চারপাশে সামরিক মহড়া শুরু করেছে বিচলিত চীন। অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলেছেন এই মহড়া কি চীন-তাওয়ান যুদ্ধে গড়াবে? ন্যান্সির সফর কি পরিণামে তাইওয়ানের ভাগ্যাকাশকে যুদ্ধের কালো মেঘেই ঢেকে দিচ্ছে? স্বাধীনতার স্বপ্ন কি শেষ পর্যন্ত নিভে যাচ্ছে তাইওয়ানের? চীন কি নিজ ভুখণ্ড বলে দাবি করা তাইওয়ানকে এবার নিজের মূল-ভুখন্ডের সঙ্গে একীভূতই করে নেবে? রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলার সুযোগকে কি নিজের ঢাল হিসেবে এবং পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কি ছুঁতো হিসেবে কাজে লাগাতে কি পিছপা হবে না চীন?
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় ১২টায় তাইওয়ানের চারপাশে ছয়টি এলাকায় লাইভ ফায়ার মহড়া শুরু হয়েছে। জানা গেছে এটি চলবে ৭ আগস্ট পর্যন্ত। পেলোসি তাইওয়ানে আসার পর মঙ্গলবার রাত থেকেই চীন সামরিক তৎপরতা শুরু করে। পরে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধও আরোপ করেছে।
চীন এই মহড়ায় তাইওয়ান প্রণালীতে দূরপাল্লার একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। চীনের সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের এই দৃশ্য দেখেছেন বার্তাসংস্থা এএফপির সাংবাদিকরা। এছাড়া বেইজিংয়ের সামরিক বাহিনীও ওই এলাকায় ‘দূরপাল্লার তাজা গোলাবারুদ ব্যবহার করে গুলিবর্ষণের’ কথা ঘোষণা করেছে।
এএফপির সাংবাদিকরা তাইওয়ান প্রণালীর আশপাশের সামরিক স্থাপনা থেকে ছোঁড়া বেশ কয়েকটি ছোট ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে উড়তে এবং এরপরই সেগুলোকে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে দেখেছেন। স্থানীয় সময় দুপুর ১.১৩ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ১১টা ১৩ মিনিট) বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
চীনের সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা ‘পূর্ব তাইওয়ান প্রণালীর নির্দিষ্ট এলাকায় দূরপাল্লার তাজা গোলাবারুদ ব্যবহার করে গোলাবর্ষণ করেছে।’
চীনের সেনাবাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)-এর ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘পূর্ব তাইওয়ান প্রণালীর নির্দিষ্ট এলাকায় নির্ভুল হামলা চালানো হয়েছে এবং প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন করা হয়েছে।’
তাইওয়ান এ বিষয়ে দাবি করেছে, এ মহড়া জাতিসংঘের নিয়মের লঙ্ঘন।
তবে বেইজিং বরাবরের মতোই ক্রুদ্ধ কণ্ঠে দাবি করে, তাইওয়ান তার ভূখণ্ডের অংশ। প্রয়োজন হলে শক্তি প্রয়োগ করা হবে দখলের জন্য।
লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের চায়না ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক স্টিভ স্যাং বলেন, একেবারে এক্ষুণি যুদ্ধ বেধে যাবার সম্ভাবনা কম।
তিনি বলেন, চীনাদের এখনো সেই সক্ষমতা হয়নি যে তারা তাইওয়ান নিয়ে নেবে, আমেরিকানদের মোকাবিলা করবে এবং তারা যে জিতবেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত বোধ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো মাইকেল ও’হ্যানলন বলেন, সরাসরি যুদ্ধ কারো স্বার্থেরই অনুকুল হবে না।
তিনি বলেন, এ রকম কোন যুদ্ধ কোনদিকে মোড় নেবে তা কেউ বলতে পারে না, এটা খুব সহজেই বৈশ্বিক চেহারা নিয়ে নিতে পারে, পারমাণবিক হুমকিও তৈরি হতে পারে।
ও’হ্যানলন বিবিসিকে বলেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি উদ্বেগের কারণ, কিন্তু রাশিয়ার মত গুরুতর হুমকি নয়।
ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা মুখপাত্র জন কারবি বলেছেন, চীনের হুমকি ও বাগাড়ম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ভীত হবে না। চীন তাইওয়ানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংঘর্ষে জড়াতে পারে এবং চীন-মার্কিন সম্পর্ক নির্ভর করবে চীনের ভবিষ্যৎ আচরণের ওপর।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, পেলোসির সফরের কারণে চীন তাইওয়ানে প্রাকৃতিক বালু রপ্তানি এবং তাইওয়ান থেকে ফল ও মাছ আমদানি বন্ধ করেছে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছে, উত্তেজনা আরও তীব্র হলে তা বহু বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক শিল্প গবেষণা সংস্থা কাপরন এশিয়ার পরিচালক জেনন কাপরনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তাইওয়ানের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো চীনের ভ্যালু চেইনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তিনি মনে করেন, তাইওয়ানের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর খুব বেশি চাপ দেওয়া চীনের জন্য কঠিন হবে।
আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়, সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বে তাইওয়ানের অবদান ৬৪ শতাংশ। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমানে এসব চিপ ব্যবহার করা হয়। সেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর চীন কোনো চাপ তৈরি করলে তা ‘নিজের পায়ে কুড়াল’ মারার মতোই হতে পারে বলে বিশ্লেষণে মন্তব্য করা হয়।
চীনের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে মঙ্গলবার রাতে তাইওয়ানে নামেন ন্যান্সি পেলোসি। ২৪ ঘণ্টারও কম সময় তিনি সেখানে অবস্থান করেন। পরে বুধবার বিকেলে দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্দেশে উড়াল দেওয়ার আগে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের সঙ্গে বৈঠক করেন। অপরদিকে পেলোসির এ সফরকে ঘিরে নজিরবিহীন সামরিক তৎপরতা শুরু করে বেইজিং।
তাইওয়ানের সীমান্তে যুদ্ধ মহড়া শুরু করার পাশাপাশিিআন্তর্জাতিক সমর্থন ও বিভিন্ন দেশকে নিজের পাশে চেয়ে দেশটির বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূতরা বিবৃতিও দিয়েছেন। এরই মধ্যে জি-৭ এর বিবৃতি নিয়েও স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছে চীন।
এমন এক বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশে নিয়োজিত চীনের রাষ্ট্রদূত। এরপর বাংলাদেশও তার অবস্থান ব্যক্ত করার পাশাপাশি চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা হ্রাসে সব দেশকে সহনশীল আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা।
‘এক চীন’ নীতির পক্ষে বাংলাদেশ তার দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ তাইওয়ানের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম অবলম্বন করার আহ্বান জানাচ্ছে।
সর্বশেষ খবর দ্য ডেইলি স্টার বাংলার গুগল নিউজ চ্যানেলে।
এ অঞ্চলে ও বাইরে উত্তেজনা বাড়াতে পারে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে এমন কোনো কাজ করা থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে।
এসআর