Image default
ইতিহাস

৭২-এর সংবিধানে দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল

বাংলাদেশের সংবিধানের সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের শাসনতন্ত্র রচনার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পটভূমির প্রাসঙ্গিক আলোচনা– আবহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেবল ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধই ছিল না, মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলার কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতার দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের এক চূড়ান্ত রূপ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ বণিক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে এদেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় ১৭৫৭ সালে স্বাধীন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশীর আম্রকাননে নির্মমভাবে হত্যা করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই অঞ্চলের ক্ষমতা দখল করে। ক্ষমতা দখলের পর থেকেই তাদের শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে বাংলার নির্যাতিত মানুষ বিদ্রোহ শুরু করে।

এদেশের সাঁওতাল-গারো-হাজং আদিবাসীদের বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী-ফকিরদের বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, শান্তি ঘোষ, বাঘা যতিন, ক্ষুদিরাম প্রমুখ দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের নেতৃত্বে সংঘটিত অগ্নিযুগের সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লব ও স্বদেশি আন্দোলনসহ জনগণের বহুমাত্রিক সংগ্রামে ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে এ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলেও সাম্প্রদায়িক ও দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত দুই হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষা-ভাষীদের নিয়ে পাকিস্তান নামক এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।

পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর জাতিগত বৈষম্য, শোষণ-শাসন, দমন-পীড়ন ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, মুটে-মজুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪’-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪’-এর স্বাধিকার আন্দোলন, ৬৬’-এর ৬ দফার আন্দোলন, সবশেষে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলার রাখাল রাজা শেখ মুজিব কারামুক্তির পর ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ছাত্র জনতার বিশাল জনসমুদ্রে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, কুলি-মজুর, ছাত্র-জনতা এক নবজাগরণে উজ্জীবিত হয়েছিল এবং তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের পর ছাত্র-জনতার উত্তাল সংগ্রাম ও গণদাবির মধ্য দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার অধীনে ৬ দফার ভিত্তিতে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তারা সমগ্র বাঙালি জাতির ওপর নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির উদ্দেশে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণে ‘যার যা আছে তাই নিয়ে সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান করেন’। ৭ মার্চ থেকেই মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ পরিচালিত হতে থাকে এবং সমগ্র জাতি মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ৩২নং রোডের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা তৎকালীন ইপিআর বাহিনী কর্তৃক ওয়্যারলেসযোগে দেশে-বিদেশে প্রচারিত হয়। নব প্রজন্মের জানা প্রয়োজন, হঠাৎ করে সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে কারও হুইসেলে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের ত্যাগ, নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তাঁর বলিষ্ঠ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে বাঙালি জাতির দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছিল ৭১’-এ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল’৭১ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলায় (মুজিবনগর) নবগঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথগ্রহণ করেন এবং তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও গণপরিষদ সদস্য ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও অনুমোদনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ও আইনানুগভাবে পরিচালিত হয় নবগঠিত সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে জাতির পিতা মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্রবিন্দু করে হাত দেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে। একই সঙ্গে নবজাতক বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে শুরু করেন কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা এবং দেশ পরিচালনার জন্য কাঙ্ক্ষিত শাসনতন্ত্র রচনার কাজে।

জাতির পিতা অতি অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র ১০ মাসে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লিখিত শাসনতন্ত্র আমাদের উপহার দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিখেছিলেন, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য নিশ্চিত হবে।

রাষ্ট্র পরিচালিত হবে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে, যা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলে বিবেচিত হবে এবং সাম্যবাদী সমাজ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা হবে। রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হবে বাংলার কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষসহ জনগণের অনগ্রসর অংশকে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি প্রদান করা। ১৯৭২ সালের সংবিধানে স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে– পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশ, নাগরিকদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সব নাগরিকের জন্য সমতা, মানুষে-মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের বিলোপ সাধন করা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র কী হবে তা সুস্পষ্টভাবে সংবিধানে উল্লেখ করেছিলেন।

১৯৭২-এর সংবিধান প্রবর্তিত রাজনীতি, অর্থনীতি ছিল এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, মুটে-মজুর, ছাত্র-জনতা ও মেহনতি মানুষের স্বার্থে। সংবিধানের ৪ মূলনীতির আলোকে দেশ চলতে শুরু করে। যার ফলে পাকিস্তানের পরাজিত শক্র এবং তাদের মদতপুষ্ট দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণি, পাকিস্তানপন্থি উচ্চাভিলাষী কিছু সামরিক অফিসার ও দলের অভ্যন্তরে বর্ণচোরা বিশ্বাসঘাতকদের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্র ক্ষুব্ধ হয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

Related posts

উচ্চ শিক্ষার সেরা হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়

News Desk

যেভাবে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

News Desk

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস

News Desk

Leave a Comment