Image default
আন্তর্জাতিক

বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব কেন জরুরি

১৯৪৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রথম আণবিক বোমা সফলভাবে তৈরি ও পরীক্ষা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পর ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নও তৈরি করে একই ধরনের বোমা। বোমাটি তৈরিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়তো এত তাড়াতাড়ি সফল হতো না, যদি গোয়েন্দারা আণবিক বোমা তৈরির একাধিক গোপন ফর্মুলা বিজ্ঞানীদের সরবরাহ না করত।

এ কথা ঠিক, গোপন তথ্যগুলো না পেলেও একদিন না একদিন পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলত রুশরা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ফর্মুলাগুলো না পেলে অনেক দেরি হয়ে যেত, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এ সময় বাঁচিয়ে দেওয়াটাই তৎকালীন সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বলে আমার মনে হয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এ কারণেও যে, ওই সময় আমেরিকার জেনারেল প্যাটন এবং ব্রিটেনের উইনস্টন চার্চিলের মতো নেতারা জীবনভর ছিলেন রাশিয়া ও অর্থডক্স খ্রিষ্টানদের বিরোধিতাকারী।

মূলত এ দুজনের কল্পনাতেই ১৯৪৫ সালে বাস্তবায়িত হয় অপারেশন আনথিংকেবল। পরবর্তী সময়ে সোভিয়েতবিরোধী আরও বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা তাদের মাথা থেকে এসেছে, যার মধ্যে অপারেশন টোটালিটি, অপারেশন শেকডাউন, অপারেশন ট্রোজান অন্যতম। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বজুড়ে ইঙ্গ-মার্কিন প্রাধান্য বিস্তার করতে দ্রুত সোভিয়েত ইউনিয়নকে দমিয়ে রাখার জন্যই পারমাণবিক শক্তিকে অস্ত্র হিসাবে বেছে নেয় তারা। ফলে যুদ্ধক্লান্ত রাশিয়াকে পরাস্ত করতে তাদের প্রয়োজন ছিল এত বেশি পরমাণু বোমা বানিয়ে রাখা, যাতে করে কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সোভিয়েতরা।

এ হুমকিগুলো বহু সচেতন মানুষকে নাড়া দিয়েছিল এবং তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে পারমাণবিক বোমা তৈরির বিভিন্ন ডকুমেন্ট সরবরাহ করে বিশ্বকে ওই ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে ধাবমান হওয়া থেকে বিরত রাখেন। ওই নাটকের বহু কুশীলব ছিল। তাদের মধ্যে একজনের নাম না বললেই নয়। তিনি হচ্ছেন জৈবপদার্থবিজ্ঞানী থিওডর হল।

কয়েক দশক পর ১৯৯৫ সালে এক টিভি সাক্ষাৎকারে থিওডর বলেছিলেন কীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দাদের হাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ডকুমেন্ট সরবরাহ করেন তিনি। তিনি কেন করেন, সেই ব্যাখ্যাও দেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি চাননি পৃথিবীর একক কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখুক। তার ভয় ছিল, যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনোদিন ভাইমার রিপাবলিকের মতো রাতারাতি ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়, তাহলে সমগ্র মানবজাতি দুর্ভোগ পোহাবে এবং এর এক বড় অংশ মারাও যেতে পারে।

তার মনে হয়েছে, এর চেয়ে ভালো হয়-বিশ্বে এমন অন্তত দুটি পরাশক্তি থাকুক, যারা নিজেরা নিজেদের অন্তত ধ্বংস করতে পারবে না। ফলে কোনো একক দেশ আর পারমাণবিক শক্তির মাধ্যমে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বিশ্বকে।

শক্তির ভারসাম্যের এ অবস্থা বিরাজ করেছিল কয়েক দশক। আমি মনে করি, মূলত সেজন্যই ১৯৪৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময় বিশ্বে শান্তি বজায় ছিল। অবশ্য এ সময়ের মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধ হয়েছে, কোরিয়া যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণে স্থিতাবস্থা থাকায় ওই দুই যুদ্ধ ‘ত্রিশ বছরের যুদ্ধ’, ‘শত বছরের যুদ্ধ’, এমনকি প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় কম ধ্বংসাত্মক ছিল।

সে সময় দুই পক্ষের হাতেই পরমাণু অস্ত্র থাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশই একে অপরের সঙ্গে আচার-ব্যবহারে সতর্ক থেকেছে। কারণ তাদের স্মরণে ছিল, যদি কোনো কারণে দুই পক্ষ পরমাণু যুদ্ধে লিপ্ত হয়, পরিণামে পরাজিত পৃথিবী শাসনের জন্য বেঁচে থাকবে না তাদের কেউই। দুর্ভাগ্যবশত, ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়ালের পতনের পর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে শক্তির ওই ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্র যদিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার প্রভাববলয় আর সম্প্রসারণ করবে না, কিন্তু কার্যত রাশিয়ার পূর্বমুখী সীমান্তে এগোতেই থাকে ন্যাটো।

সংস্থাটি সার্বিয়ায় বোমাবর্ষণ করে ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর মতো করে মস্কোকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ক্যাম্প বন্ডস্টিল নামক অবৈধ সেনাছাউনি বসায়, যাতে করে কসোভো মাঝেমধ্যে রাশিয়ার জন্য যন্ত্রণার কারণ হতে পারে। একই প্রক্রিয়ায় ন্যাটো জর্জিয়ার মতো সাবেক সোভিয়েত মৈত্রীকে লাগিয়ে দেয় রাশিয়ার পেছনে। এখন তো রাশিয়ার চার পাশেই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে ময়দান রায়টের সময় যে মার্কিনপন্থি দলটি সক্রিয় ছিল, তাদের দ্বারা ইউক্রেনের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে যুক্তরাষ্ট্রের ধামাধরা সরকারকে বসানো হয় ক্ষমতায়।

বার্লিন দেয়ালের পতনের পর থেকে মার্কিনিরা মনে করা শুরু করে, তারাই পৃথিবীর একমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ। আমি মনে করি-সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, জর্জিয়া, ভেনিজুয়েলা থেকে শুরু করে আরও বেশ কয়েকটি দেশে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার অন্যতম কারণ বিশ্ব-পুলিশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা। ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন সার্বিয়ায় অবৈধভাবে বোমাবর্ষণ করল, সেই দিনই বোঝা গেছে আন্তর্জাতিক আইনের কোনো তোয়াক্কাই করে না দেশটি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পাঁয়তারা না করে দেশটি যে বিশ্বশক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস, সেই উৎসটাকে মানবকল্যাণে কাজে লাগানো।

পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি, সব শক্তি আসে জোড়ায় জোড়ায় ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া হিসাবে। যদি কোনো শক্তি অপ্রতিসাম্য হয়ে ওঠে কিংবা ভারসাম্যহীন হয়, তাহলে পুনরায় ভারসাম্য ফিরে আসা পর্যন্ত প্রকৃতিতে দুর্যোগ চলতে থাকে। উদাহরণ হিসাবে আমরা জীবজগতের কথা বলতে পারি। জগৎটি শিকার ও শিকারি দ্বারা অর্ধ-ভারসাম্যপূর্ণ। এর মধ্যে কোনো একটি গ্রুপ হয় শিকার অথবা শিকারি।

যদি সংখ্যাধিক্য ঘটে তাহলে ওই বাস্তুসংস্থানে ভারসাম্য ফিরে আসার আগ পর্যন্ত অধিক হারে রোগ, মৃত্যু অথবা বাসস্থানের ধ্বংস সংঘটিত হয়। আর যদি ভারসাম্যটি কোনোভাবেই না আসে ডাইনোসরদের কপালে যা জুটেছিল, সেটাই ঘটে। প্রকৃতির মাঝে বৈচিত্র্য ও বহুমেরুত্ব একটি শক্তি। সমরূপতা এবং একক মেরুত্ব তথা একমুখিতা প্রকৃতির জন্য বিরাট দুর্বলতা।

একইভাবে বিশ্বকে একক মেরুর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যে চেষ্টা, আমি মনে করি, তা বিশ্বশান্তি ও স্থিতাবস্থার জন্য হুমকি এবং এ বিষয়ে রাশিয়া, চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যাতে তেমন কিছু না ঘটে। শক্তির ভারসাম্য নীতির ওপর নির্ভর করে তারা যদি বিশ্বব্যবস্থায় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে না পারে, তাহলে বিশ্ববাদীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে বিশ্ব। কোনো একক ব্যক্তি বা দেশের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকা উচিত নয়। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা এ যুক্তিটি খুব ভালোভাবে অনুধাবন করেছিলেন বলেই না মার্কিন সংবিধানে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের এত ছড়াছড়ি। কারণ এটাই মানব প্রকৃতি।

Related posts

ম্যাক্রোর যুক্তরাষ্ট্র সফরে ফিরবে ২১৯ বছরের বন্ধুত্ব

News Desk

আল জাজিরার কার্যালয় গুঁড়িয়ে দিলো ইসরায়েল

News Desk

অক্সিজেনের অভাবে রাশিয়ায় ৯ করোনা রোগীর মৃত্যু

News Desk

Leave a Comment