ছবি: সংগৃহীত
আভাস পাওয়া যাচ্ছিল ভোটের মাস কয়েক আগে থেকেই। সেই আভাসকে আরো মজবুত করে দেয় সবকটি বুথ ফেরত সমীক্ষা। সোমবার ভারতের গুজরাটে দ্বিতীয় বা শেষ পর্বের বিধানসভা ভোটের পর সবকটি সমীক্ষাই বিজেপিকে বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে রাখার পাশাপাশি কংগ্রেসের নজিরবিহীন খারাপ ফলের পূর্বাভাস দিয়েছিল।
গতকাল বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ হওয়া শুরু হতেই মিলে যেতে থাকে সেই পূর্বাভাস। খবর- আনন্দবাজার, রয়টার্স
স্পষ্ট হয়ে যায়, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের রাজ্যের রাজনীতিতে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে রাহুল গান্ধী-মল্লিকার্জুন খাড়গের দল।ভোটগণনার প্রবণতা বলছে ১৮২ আসনের গুজরাট বিধানসভায় বিজেপির আসন ১৫৮ পৌঁছে জেতে পারে। এরই মধ্যে ১৫৬ আসনে জয়ী বা এগিয়ে রয়েছে। তাতে ভেঙে যাচ্ছে ১৯৮৫-র বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের ১৪৯টি আসনে জেতার রেকর্ড।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এ জয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটিকে বিপুলভাবে উজ্জীবিত করবে। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় শিল্পপ্রধান এ রাজ্যটি বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। এখানে ১৯৯৫ সাল থেকে একটানা ক্ষমতায় আছে বিজেপি। ২০১৪-র জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাস্ত করে মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
এদিকে, বিধায়ক সংখ্যা ১৯-এর নিচে নেমে যাওয়ায় মহাত্মা গান্ধী-বল্লভভাই প্যাটেলের রাজ্যে কংগ্রেসবিরোধী দলের মর্যাদাও হারাতে চলেছে। কংগ্রেস ২০১৭-র নির্বাচনে ৭৭টি আসন পেয়েছিল। কিন্তু এবার দলটি মাত্র ১৭টি আসনে এগিয়ে আছে।
দিল্লির পৌর নির্বাচনে বিজেপিকে হটিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (এএপি) বড় জয় পেলেও গুজরাটে প্রত্যাশিত সাড়া পায়নি, শেষ খবর পর্যন্ত মাত্র ৫টি আসনে এগিয়ে আছে তারা। তবে ২০১৭ নির্বাচনের তুলনায় এ ফলকে ভালো বলতে হবে, কারণ সেবার রাজ্যটিতে কোনো আসনেই জিততে পারেনি তারা।
হিমাচলে কংগ্রেস এগিয়ে : হিমাচল প্রদেশের ৬৮টি আসনে গত শনিবার ভোট নেয়া হয়। সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় ৩৫টি আসনের মধ্যে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কংগ্রেস ৪০টি আসনে এগিয়ে রয়েছে। আর বিজেপি এগিয়ে ২৫টি আসনে। রাজ্যটিতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল আপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও এই নির্বাচনে তেমন ছাপ ফেলতে পারবে না বলেই ইঙ্গিত মিলেছে।
জয়ের পর আবেগপ্রবণ মোদির টুইট : গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়ের পর গতকাল বিকালে টুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। টুইটে লিখেছেন, ‘ধন্যবাদ গুজরাট। এই অসাধারণ ফলাফল দেখে আমি আপ্লুত। উন্নয়নের রাজনীতিকে আশীর্বাদ করেছেন মানুষ। একইসঙ্গে এই উন্নয়ন আরো জোরদার করতে যে তারা আগ্রহী, তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমি গুজরাটের জনশক্তির কাছে মাথা নত করছি।’
গান্ধীর রাজ্যে কেন এমন বিপর্যয় : গুজরাটে ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় কংগ্রেসের। ১৮২ আসনের বিধানসভায় নির্বাচিত হন ৭৭ জন ‘হাত’ চিহ্নের প্রার্থী। ৯৯টি আসনে জিতে কোনোমতে সরকার গড়ে বিজেপি। ২০১৭-র বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ওই রাজ্যে ৪৪ শতাংশেরও বেশি ভোট পায়। এদিকে, বিজেপির ভোট ছিল ৪৯ শতাংশ। কিন্তু ২০১৪ সালের পরে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও মোদি-শাহের রাজ্যে খাতা খুলতে ব্যর্থ হয় সোনিয়া-রাহুলের দল। ২৬টি লোকসভাই যায় বিজেপির দখলে। বস্তুত এর পর থেকেই ভাঙন ধরতে শুরু করে কংগ্রেস শিবিরে।
গত ৫ বছরে গুজরাটে কংগ্রেসের ১৯ জন বিধায়ক দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। এই তালিকায় রয়েছেন অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর যুবনেতা অল্পেশ ঠাকুর, সাবেক বিরোধী দলনেতা তথা একসময়ের কংগ্রেসের ‘জনজাতি মুখ’ মোহনসিংহ রাথুরের মতো নেতা। ১০ বারের বিধায়ক মোহনের দলত্যাগ দক্ষিণ ও পূর্ব গুজরাতের আদিবাসীপ্রধান অঞ্চলে কংগ্রেসের খারাপ ফলের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন দলের একাংশ।
২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে রাহুল সামনে থেকে দাঁড়িয়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জিএসটি, নোটবন্দি, প্যাটেলদের বিক্ষোভ এবং বিভিন্ন এলাকায় বিজেপি নেতাদের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে ‘অস্ত্র’ করেছিলেন হার্দিক প্যাটেল, জিগ্নেশ মেভানি, অল্পেশ ঠাকুরদের মতো তরুণ-তুর্কিদের। জনজাতি, দলিত, পাটীদার, অনগ্রসর (ওবিসি), মুসলিমদের একই জোটে আনার জন্য রাহুল অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন বিজেপির। এবার দিন কয়েকের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ ছাড়া আগাগোড়ায় গুজরাতের প্রচারপর্বে রাহুল ছিলেন অনুপস্থিত। দেখা যায়নি সোনিয়া ও প্রিয়াঙ্কাকেও। জনজাতি এবং দলিত ভোটের ওপর এর ‘প্রভাব’ পড়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
তা ছাড়া যে অনগ্রসর এবং দলিত শ্রেণিকে পাশে নিয়ে কংগ্রেস গুজরাটের ভোটে এগোতে চেয়েছিল, তাদের বড় অংশের ভোট ‘হাত’ প্রার্থীরা পাননি বলেই প্রাথমিক বিশ্লেষণে মনে করছে কংগ্রেস। গুজরাটের রাজনীতিকদের একাংশের, এই অনগ্রসর এবং দলিতদের মধ্যে যারা মধ্যবিত্ত, তাদের মধ্যে জাতের চেয়ে ধর্মীয় ভাবাবেগ অনেক বেশি। মেরুকরণের রাজনীতিতে সেই মানসিকতারই সুফল পেয়েছে বিজেপি।
অন্যদিকে, সংখ্যালঘুপ্রধান এলাকাগুলোয় কংগ্রেসের ভোটে ভাগ বসিয়েছে আসাদউদ্দিন ওয়েইসির দল ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম)।
এছাড়া ভোটের ফলাফলে স্পষ্ট, বিজেপিবিরোধী প্যাটেলদের ভোটের পাশাপাশি সরাসরি কংগ্রেসের অনগ্রসর ও দলিত ভোটে ভাগ বসিয়েছে আপ। ভোটের পাটিগণিত বলছে, বহু আসনেই আপ এবং কংগ্রেসের ভোট কাটাকাটিতে জিতে গেছেন বিজেপি প্রার্থী। দীর্ঘ দিন কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে হতাশ হওয়া বিজেপিবিরোধী ভোটারদের একাংশ আপের দিকে ঝোঁকায় সৌরাষ্ট্র, দক্ষিণ গুজরাত এমনকি, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র সীমানা লাগোয়া আদিবাসী অধ্যুষিত আসনগুলোও ধরাশায়ী হয়েছে কংগ্রেস। অথচ গত বিধানসভায় ওই এলাকাগুলোয় ভাল ফল করেছিলেন ‘হাত’ চিহ্নের প্রার্থীরা।
নির্বাচনী পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৫ সালের পর মহাত্মা গান্ধীর রাজ্যে কোনো বিধানসভা ভোটে জেতেনি কংগ্রেস। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে জনতা দল-বিজেপির জোট ভাঙার পরে মুখ্যমন্ত্রী চিমনভাই প্যাটেল কংগ্রেসে যোগ দেয়ায়, পেছনের দরজা দিয়ে কিছুদিন ক্ষমতা ভোগের সুযোগ হয়েছিল। এর পর ১৯৯৬ সালে বিদ্রোহী বিজেপি নেতা শঙ্করসিন বাঘেলা, দিলীপ পারিখদের মদত দিয়ে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই প্যাটেলকে সরানো সম্ভব হলেও ১৯৯৮ সালের বিধানসভা ভোটের পর থেকেই গুজরাটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ধারা তৈরি করে ফেলে পদ্ম-শিবির। টানা সপ্তমবার প্রবলতর আকার নিয়ে বজায় রইল সেই ধারা।
এমকে