বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ২০২২। আগামীকালের সূর্যোদয়েই হবে আরেকটি নতুন বছরের সূচনা। নতুন বছরের নতুন সকাল আসার আগে বিদায়ী বছরের ফুটবল বিশ্বে ঘটে গেছে নানান ঘটনা। বছরটি ছিলো বিশ্বকাপের, ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে বিশ্বব্যাপী ভক্ত-সমর্থকদের উল্লাসে ভাসিয়েছেন লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। আবার বছরের একবারে শেষ প্রান্তে এসে ফুটবল বিশ্বকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন ফুটবল সম্রাট পেলে। ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘদনের লড়াই শেষে ৮২ বছর বয়সে নিজেকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছেন ব্রাজিলের ‘কালোমানিক’ পেলে।
বিদায়ী বছরে আন্তর্জাতিক ফুটবলের অঙ্গনে সাফল্যের চাদর গায়ে জড়িয়েছে বাংলাদেশও। বাংলার অদম্য নারীদের হাত ধরে লাল সবুজের পতাকা মুড়িয়ে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপখ্যাত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। বাংলার ফুটবলে যেন নতুন এক জাগরণই নিয়ে এসেছে সাবিনা-সানজিদারা। লাল সবুজের সাহসিকাদের ছাদখোলা বাসের সেই প্যারেড জানিয়ে দিয়েছে, বাংলার মেয়েরাও পারে বিশ্বের বুকে নিজেদের গর্বের পতাকাকে উঁচিয়ে ধরতে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের ফুটবলে বরং অনেকটা নিষ্প্রভই গেছে বিদায়ী বছর।
বিদায়ী বছরে ফুটবলের বিশ্বজুড়ে ঘটে গেছে এমনই আরও কতশত ঘটনা। সেসবের মধ্য থেকেই বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো ফিরে দেখা ২০২২’র তালিকায়-
বাংলার ফুটবল:
বিদায়ী বছরে লাল-সবুজের ফুটবলের ঝান্ডা উড়িয়ে গেছে বাংলার অবম্য নারীরা। বছরটা ছিলো নারীদের অর্জনেই। ২০০৩ সালের ছেলেদের সাফজয়ের ১৯ বছর পর ২০২২’এ এসে আবারও দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্টত্বের মুকুট মাথায় তোলে বাংলার নারীরা। কাঠমুন্ডুতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে যাওয়ার আগে জুনে সাবিনা খাতুনেরা কমলাপুর স্টেডিয়ামে প্রীতি ম্যাচে অনেক এগিয়ে থাকা মালয়েশিয়ার মতো দলকে ৬ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের বদলের যাওয়ার সূচনা বোধ হয় সেখান থেকেই। বছরজুড়ে গোলাম রব্বানীর দল সাতটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ছয়টিতেই পেয়েছে দাপুটে জয়। একমাত্র ড্র মালয়েশিয়ার সঙ্গে। নেই কোনো হার।
ভারতের আধিপত্য ভেঙে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে দেশে ফিরে গনমাশ্নুশের কাছ থেকে বীরোচিত সংবর্ধনা পেয়েছেন সাবিনা-সানজিদারা। ছাদখোলা বাসে রাজধানীর রাস্তায় চ্যাম্পিয়ন প্যারেডে সানজিদারা পেয়েছে শত সহস্র মানুষের অভিনন্দন আর ভালোবাসা।
সিনিয়রদের মতো বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলেও এসেছে সাফল্য। বাংলাদেশের মেয়েরা ফেব্রুয়ারিতে ভারতে সাফ অনূর্ধ্ব–১৮ রানার্সআপ হয়েছে। ঢাকায় সাফ অনূর্ধ্ব–১৫ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে হতেও অবশ্য পারেনি। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সব মিলিয়ে একটিতে চ্যাম্পিয়ন ও দুটিতে রানার্সআপ ট্রফি জয়ের কল্যাণে ২০২২ সালটা বাংলাদেশের নারী ফুটবলে সেরা বছর বলা যায়।
উল্টো দিকে ২০২২ সালে ছেলেদের ফুটবলে চোখ রাখলে হতাশায় মনটা বিষণ্নই হবে। বছরের শুরুতে যেখানে ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ছিল ১৮৬, বছর শেষান্তে ১৯২। জামাল ভূঁইয়ারা এমন কিছু করতে পারেননি, যা নিয়ে গর্ব করা যায়। দেশে শীর্ষস্তরে ফুটবলারদের বাৎসরিক পারিশ্রমিক কোটি টাকা ছুঁলেও সেটির কোনো ছাপ জাতীয় দলের খেলায় নেই। জাতীয় দল বরং এ বছর আগের চেয়েও আরও খারাপ করেছে।
গোটা বছরে ছেলেদের ফুটবলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে আটটি। পাঁচটি ফিফা টায়ার ওয়ান প্রীতি ম্যাচ, তিনটি এশিয়ার কাপের বাছাই। এই আট ম্যাচে বাংলাদেশের জয় মাত্র একটি। সেটি এসেছে ২২ সেপ্টেম্বর প্রীতি ম্যাচে কম্বোডিয়ার সঙ্গে তাদেরই মাঠে রাকিব হোসেনের দেওয়া একমাত্র গোলে।
ছেলেদের ফুটবলের হাতাশা ছাপিয়ে নারী ফুটবলের সাফল্যে মোড়ানো বছর শেষ করেই নতুন বছরে পা রাখতে যাচ্ছে বাংলার ফুটবল। সানজিদাদের এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলার ফুটবলে নবজাগরণের আশাতেই শুরু হোক নতুন বছর।
বিশ্ব ফুটবল:
বিদায়ী বছরের শুরুতেই বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার পক্ষ থেকে দেওয়া ‘ফিফা দ্য বেস্ট’ট্রফি ওঠে পোল্যান্ডের স্ট্রাইকার রবার্ট লেওয়ান্ডোভস্কির হাতে। টানা দ্বিতীয়বারের মতো এই পুরষ্কার জিতে নেন লেওয়া। তৎকালীন বায়ার্ন মিউনিখে খেলা লেওয়া বাভারিয়ানদের জার্সিতে ৪৪ ম্যাচে করেছিউলেন ৫১ গোল আর ৮ অ্যাসিস্ট। বুন্দেসলিগায় জার্ড মুলারের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ৪০ গোলের রেকর্ডও ভেঙে দেন পোলিশ এই গোলমেশিন।
২০২২ সালের শুরুটা সমগ্র বিশ্বের মঙ্গল কামনা করে হলেও ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ যেন ওলোট-পালোট করে দেয় সবকিছু। যুদ্ধের সেই ভয়াল থাবা নেমে আসে ক্রীড়াঙ্গনেও। তখনই ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর দায়ে ফিফা ও উয়েফা অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাশিয়ার উপরে।
বিশ্বকাপ বা ইউরোসহ সব ধরণের আন্তর্জাতিক ইভেন্ট থেকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় রাশিয়াকে। সমগ্র বিশ্বই প্রতিবাদের আওয়াজ জানিয়ে দেউ রাশিয়ার বিরুদ্ধে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব আর উয়েফা ন্যাশনস লিগ থেকে বহিষ্কার করা হয় রাশিয়াকে। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে রাশিয়ার ক্লাবকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।
রাশিয়াকে একপাশে রেখেই শেষ হয় বিশ্ব ফুটবলের বড় বড় আসরগুলোর। এরই মাঝে ইউরোপীয় ফুটবলে ঝড় তোলে ফরাসি ত্যারকা কিলিয়ান এমবাপ্পের দলবদল নিয়ে। নতুন মৌসুম শুরুর আগেই বেশ জোরেশোরে গুঞ্জন ওঠে এমবাপ্পের রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়া নিয়ে। মৌসুম শেষেই ফরাসি ক্লাব পিএসজির সঙ্গে চুক্তি শেষ হওয়ায় ফ্রি এজেন্ট হিসেবেই মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার গুঞ্জন ডালপালা মেলে বেশ ভালোভাবেই।
কিন্তু সবার উত্তেজনার পারদ চরমে চড়িয়ে একেবারে শেষ মুহুর্তে এসে পিএসজির সঙ্গেই নতুন চুক্তি করে এমবাপ্পে। স্প্যানিশ জায়ান্টরাও হতবাক হয়ে যায় এমবাপ্পের এমন কর্মকাণ্ডে। মাদ্রিদের সমর্থকরা এমবাপ্পেকে অর্থলোভী আর প্রতারক বলেই আখ্যা দিয়েছে পরে।
বরাবরের মতোই ক্লাব ফুটবলে শেষ মৌসুমে দুর্দান্ত দাপট দেখিয়েছে স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। এমবাপ্পে হাত ফসকে গেলেও লা লিগা আর চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা ঠিকই নিজেদের ঘরে তুলেছে লস ব্লাঙ্কোসরা। লা লিগার শিরোপা জয়ের মাসখানেকের মধ্যেই লিভারপুলকে হারিয়ে নিজেদের ১৪তম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জেতে মাদ্রিদের দলটি।
দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটানো মাদ্রিদের এতো সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বয়াড় কারিগর ছিলো ফরাসি স্ট্রাইকার করিম বেনজেমা। দ্য বিগ বেঞ্জের অবিশ্বাস্য ফর্মে চড়েই ভুরিভুরি সাফল্য এসেছে মাদ্রিদের ড্রেসিং রুমে। রিয়ালের হয়ে ৪৬ ম্যাচে করেছেন ৪৪ গোল। মৌসুম শেষে অবশ্য দুর্দান্ত ফর্মের পুরষ্কারটিও পেয়ে গেছেন বেনজেমা। মেসি-রোনালদোর যুগে লুকা মদ্রিচের পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে জিতেছেন ব্যালন ডি’অর। ১৯৫৬ সালের পর সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় হিসেবে ব্যালন ডি’অর জেতেন ৩৪ বছর বয়সী বেনজেমা।
স্পেনে একদিকে চলছে রিয়াল মাদ্রিদের জয়জয়কার, একই সঙ্গে অন্যদিকে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার ভরাডুবি। শেষ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিলো বার্সা। একপি ধারা অব্যাহত রয়তে গেছে চলতি মৌসুমেও। তবে ক্লাবের কিংবদন্তি জাভির কাতে কোচের দায়িত্ব তুলে দেওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে স্বরূপে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছে কাতালান ক্লাবটি।
ক্লাব ফুটবলের এই বছরের পারফরম্যান্সের বিচারে একটি নাম অবশ্যই আসবে সবার মুখে মুখে। নামটি আর্লিং হাল্যান্ড। প্রতি ম্যাচে ঠিক যেন দানবের মতো গোলের পর গোল করে গেছেন বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে চলতি মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেওয়া এই নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও বায়ার্ন মিউনিখের মতো শীর্ষ ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোকে টেক্কা দিয়ে ৫ কোটি ১০ লাখ পাউন্ডে হাল্যান্ডকে দলে ভেড়ায় ম্যানচেস্টার সিটি। অবশ্য তার সেই মূল্যমানের যথার্থতাও প্রমাণ করে চলেছেন হাল্যান্ড।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে অভিষেকেই ওয়েস্ট হ্যামের বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। এরপরের টানা তিন লিগ ম্যাচে করেন হ্যাটট্রিক। লিগের ফর্ম তেনে আনেন চ্যাম্পিয়ন লিগেও। সেভিয়ার বিপক্ষে পেথম ম্যাচেই করেন জোড়া গোল। সকল ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এই বছর ২০ ম্যাচে ২৬ গোল করে দুর্দান্ত এক বছরই পার করেছেন হাল্যান্ড।
ক্লাব ফুটবলের দাপটের মধ্যেই বছরের মাঝামাঝি হয় যায় বিশ্ব ফুটবলের আকর্ষনীয় এক লড়াই। কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা আর ইউরো চ্যাম্পিয়তন ইতালিসর মধ্কার ফিনালিসিমার সেই ম্যাচে ইউরোপের দম্ভ চূর্ণ করে ইতালিকে ৩-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা মাথায় তোলে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। আগের বছর কোপা আমেরিকার পর আবার আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের আনন্দে ভাসে আলবিসেলেস্তারা।
বছরজুড়ে ফুটবলের আলোচনা জমবে আর সেখানে নাম থাকবে না পর্তুগিজ তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর, এটা যেন ভাবাই যায় না। তবে এই বছর সিআর সেভেনের নাম বেশি শনা গেছে বিতর্কিত কর্মাকাণ্ডের জন্যই। জুভেন্টাস থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে প্রত্যাবর্তন করা রোনালদোর প্রথম মৌসুমটা ভালো গেলেও দ্বিতীয় মৌসুমে হতাশাই উপহার দিয়েছেন পাঁচবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী এই তারকা।
চলতি মৌসুমে এরিক টেন হাগ রেড ডেভিলদের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই যেন রোনালদোর সঙ্গে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। ইউনাইটেড ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমাতে জোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন রোনালদো। তবে নতুন ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে ওল্ড ট্রাফোর্ডেই থেকে যান তিনি।
তবে বিশ্বকাপের আগে ব্রিটিশ সাংবাদিক পিয়ার্স মর্গ্যানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বোমা ফাটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন ম্যানইউতে। বিশ্বকাপের ঠিক আগে তার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে ক্লাবটি। বিশ্বকাপে পর্তুগিজ কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের সঙ্গেও মনোমালিন্য হয়ে হতাশার এক বিশ্বকাপ কাটে সিআর সেভেনের। নিজের শেষ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নেয় রোনালদোর পর্তুগাল। এদিকে, প্রায় দেড় মাস ক্লাবহীন থাকার পর বছরের শেষে এসে ইউরোপ ছেড়ে সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসরে তে যোগ দেন রোনালদো।
বিদায়ী বছরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিলো মরুর বুকে কাতার বিশ্বকাপ। ৩৬ বছরের অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে বিশ্বকাপের ২২তম আসর থেকে নিজেদের তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে নেয় আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টাইন মহাতারকা লিওনেল মেসির মাথায় ওঠে পরম আরাধ্য বিশ্বজয়েরে মুকুট।
মরুর বুকে প্রথম বিশ্বকাপের আসর বসলো কাতারের মাটিতে। বিশ্বকাপে আসার আগেই মেসি ঘোষণা দিয়ে এলেন এটিই হতে চলেছে তার শেষ বিশ্বকাপ। ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় এসে সমাপ্তির ঘোষণা দিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের ফেভারিট হিসেবেই কাতারের মাটিতে পা রাখলো মেসির আর্জেন্টিনা। দলের প্রতিটা ফুটবলারের ভেতর জেদ চেপে বসে আছে, জাদুকরকে তার শেষ বিশ্বকাপে শিরোপার সোনালি রঙে রাঙিয়েই বিদায় দিতে হবে। অনুপ্রেরণা হিসেবে কোপা আমেরিকার শিরোপা আর বিশ্বকাপের কিছুদিন আগেই ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে লা ফিনালিসিমার শিরোপা জয়।
বিশ্বকাপ জয়ের পণ করে এসে প্রথম ম্যাচেই অপ্রত্যাশিত হার সৌদি আরবের বিপক্ষে। অপ্রত্যাশিত সেই হারে শিরোপা স্বপ্নে বড় এক ধাক্কা খায় আলবিসেলেস্তারা। তবে সেই ধাক্কাটাই কি শাপে বর হয়ে এলো আলবিসেলেস্তাদের জন্য? সেই এক ধাক্কাতেই যেন ভোজবাজির মতো পাল্টে গেলো আর্জেন্টিনা। ওই এক হারের পরই বাকী সবগুলো ম্যাচে দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালেও উঠে গেলো আর্জেন্টাইনরা। গ্রুপ পর্বের পরের দুই ম্যাচ থেকে নক-আউট হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল বা সেমিফাইনাল, আর্জেন্টিনা ছিলো অপ্রতিরোধ্য। এই আর্জেন্টিনাকে থামানোর মতো কেউ ছিলো না বিশ্বকাপে।
প্রথম ম্যাচে হারের পরও ঠিক যেন স্বপ্নের মতো এক বিশ্বকাপ পার করেই ফাইনালে উঠলো আর্জেন্টিনা, যার মূল কারিগর অধিনায়ক লিওনেল মেসি। প্রতিটি ম্যাচে মেসির দুর্দান্ত পারফরম্যান্সই যেন গড়ে দিয়েছে ম্যাচের ফল। ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ, মেসি খেলেছেনও যেন জানপ্রাণ দিয়েই। ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে এসেও যেন সেই চিরতরুণ মেসিকেই মনে করিয়ে দিয়েছে আর্জেন্টাইন মহাতারকার মাঠের পারফরম্যান্স।
টাইব্রেকারে গড়ালো ফ্রান্সের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ফাইনাল। টাইব্রেকারকে অনেকেই বলে ভাগ্যের খেলা, তাহলে ফুটবল বিধাতা কি সঙ্গ দেবেন মেসির নাকি বিদায়ের মঞ্চ থেকে খালি হাতেই ফেরাবেন জাদুকরকে। না, ফুটবলবিধাতা এবার সদয় হলেন তার শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রতি। মেসির জন্য যুদ্ধেও যেতে পারবেন এমন ঘোষণা দেওয়া আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ নিজের শক্ত দুই হাতেই যেন বিশ্বকাপের শিরোপা উপহার দিলেন মেসিকে।
মেসির আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দের রেশ যেন রয়েই গেছো, এর ভেতরেই বিশ্ব ফুটবলকে কাঁদিয়ে দেওয়া সংবাদ এলো ব্রাজিল থেকে। ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই শেষে ৮২ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন ফুটবল সম্রাট পেলে। ফুটবলের সবুজ গালিচায় তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি প্রতিপক্ষের কোনো ডিফেন্ডার। সেই তিনি জীবনের মাঠে হার মানলেন মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে।
ফুটবল সম্রাট পেলের সঙ্গে ক্যান্সারের লড়াইটা ছিলো দীর্ঘদিনের, আর পারলেন না সম্রাট, নিজেকে সপে দিলে মৃত্যুর কোলে। সাও পাওলোর আলবার্ট আইনইস্টাইন হাসপাতালে ২৯ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) দিবাগত রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ব্রাজিলিয়ান এই কিংবদন্তি। যেই ব্রাজিলের জার্সি গায়ে কাঁপিয়েছেন ফুটবলের মাঠ, সম্রাটের মৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েছে ঐতিহাসিক হলুদ জার্সির সেই সাম্রাজ্য। বছরের শেষে এসে ফুটবলের রাজাকে হারানোর শোকের সাগরে ভেসেছে সমগ্র বিশ্ব।
ফুটবল সম্রাটের চির বিদদায়ের হাহাকার নিয়েই ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বিদায় নিতে চলেছে ২০২২। আসছে বছর কিংবদন্তির অনুসারীদের কারো পায়েই ফুটবলের সবুজ গালিচায় ফুটে উঠুক নতুন দিনের কোনো ফুল। সেদিনের সেই ফুলেও হয়তো লেখা থাকবে হলুদফ জার্সির এক ‘কালোমানিকের’ নাম।