প্রাণঘাতী করোনা কেড়ে নিল আরও এক গুণী শিল্পীকে। রবীন্দ্রসংগীতের অঙ্গনে প্রথমেই যে কজন শিল্পীর নাম মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, তাদের অন্যতম মিতা হক (৫৯)। গতকাল ভোরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। বেলা ১১টায় ছায়ানটে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর কেরানীগঞ্জে বাবা-মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে। শেষ বিদায়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গুণী শিল্পীকে স্মরণ করেছেন সহকর্মীরা। লিখেছেন মাসিদ রণ
তার নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সংগীত ব্যক্তিত্ব
ভোরে ঘুম ভেঙেছে এই বিষণ্ণ খবরটা শুনে। দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বুঝতেই পারছেন মনের অবস্থা। শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লাম। কারণ আমার আর মিতার যোগসূত্রটা একই স্থানে। হেঁটেছিও একই পথে। তাকে প্রথমে আমি চিনি ওয়াহিদুল হকের ভাইয়ের মেয়ে হিসেবে। তবে সম্পর্ক ছিল বড় বোন ছোট বোনের মতো। সে বয়সে আমার থেকে বেশ ছোট। তাই বড় বোনের মতো শ্রদ্ধা করত আমাকে। আমিও তাকে ভীষণ স্নেহ করতাম। বিশেষ করে তার গানের জন্য। অসম্ভব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইত মিতা। তার নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল। সেই স্টাইল আমিও পছন্দ করতাম। বহু কাজ করে গেছে মিতা। বহু অনুষ্ঠানে আমরা একমঞ্চে গেয়েছি। কিন্তু তার এই অসময়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না। দেশকে তার আরও অনেক কিছু দেওয়ার ছিল। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।
জীবন ও শিল্পের এমন শুদ্ধতম মিলন কালেভদ্রে ঘটে
নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আহা! অমন পরিশীলিত সুরেলা কণ্ঠের দেখা মেলা ভার। আর মিলবে কি না, জানি না। জীবন ও শিল্পের এমন শুদ্ধতম মিলন কালেভদ্রে ঘটে। এই তো মাত্র সাত দিন আগের কথা। হাসপাতাল থেকে ফোনে চিৎকার করে বলে, ‘বাচ্চু ভাই, আমার তো এইখানে ভাল্লাগে না। আমারে বাসায় নিয়ে যায় না কেন!’ তার দুই-তিন দিন পর কন্যা জয়ীতা ও তার স্বামী শাহীন ওদের করোনামুক্ত মাকে কেরানীগঞ্জের বাসায় নিয়ে যায়। কিন্তু পরশু হঠাৎই শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আবারও হাসপাতালে। আর আজ ভোরে আমার কন্যা এশা জানাল, মিতামা মারা গেছে। আমি নির্বাক! নিস্তব্ধতা হয়ে পড়ি। মিতার মতো জীবনকে এত ভালোবাসতে আমি কাউকে দেখিনি। এমনভাবে কাউকে জীবন উদযাপন করতে দেখিনি। শত কষ্ট-দুঃখের মাঝে কলকলিয়ে এভাবে হাসতেও দেখিনি কাউকে। আজ একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করছে, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী… আমি অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি’। বিদায় প্রিয় মিতা হক।
রবীন্দ্রসংগীতে তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা
তপন মাহমুদ, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও সংগঠক
আমি এখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। সম্ভবত সাড়ে ৬টার দিকে একটি টেলিভিশনের মাধ্যমে জানলাম, মিতা আর নেই। খুব কষ্ট পেয়েছি, এটা বলে বোঝানোর মতো নয়।
মিতাকে প্রথম দেখি ৩৫ বছর আগে। তিনি তখন লালমাটিয়া গার্লস কলেজের ছাত্রী। বার্ষিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। আমি সেখানে বিচারক হিসেবে গিয়েছিলাম। তিনি গাইলেন, ‘বলো সখী বলো, কেন মিছে করো ছল’। প্রথম হলেন। এটুকু বয়সে এত সুন্দর করে গান, ভাবা যায় না। তাই তো রবীন্দ্রসংগীতে তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তিনি বয়সে আমার অনেক ছোট হলেও কাজ করতে করতে সম্পর্কটা বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিল। আমাদের আত্মিক যোগাযোগ ছিল। আমরা আলাদা সংগঠনের হয়েও কেউ কাউকে কখনো ফিরিয়ে দিইনি। দুই বছর আগে বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত সংস্থার পক্ষ থেকে আমরা আজীবন সম্মাননা দিই। মিতা বললেন, ‘তপন ভাই, আমি বয়সে আপনার অনেক ছোট, অথচ আপনি আমাকে সম্মাননা দিলেন।’ আমি বললাম, ‘তুমি আমার চেয়ে অনেক বড় শিল্পী, এটা তোমার প্রাপ্য।’
নীতিগত অবস্থান ব্যক্ত করতে এতটুকু পিছপা হয়নি
সারা যাকের, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
মিতা তার গানের মাধ্যমে তার যাওয়ার কথা বলে গেছে! অদ্ভুত সুন্দর একটা মেয়ে ছিল। তার পরিচয় পাওয়া যায় তার শিল্পে। কী যে ভালো রান্না করত, আর কী আন্তরিকতার সঙ্গে মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করত, তা কেউ না দেখলে বুঝবে না। পরিবারের সবাইকে পরম মমতায় আগলে রাখতে জানত। শুধু পরিবারের সদস্যদেরই নয়, তার ছাত্রছাত্রীদেরও আগলে রেখেছে সব সময়। আমি বলব, সে পেশাজীবনে যেমন সফল, তেমনি সফল পারিবারিক জীবনে; যা আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। আজ তার ব্যক্তিজীবনের কথাই বেশি মনে পড়ছে। শুদ্ধ সংগীতচর্চা আর নীতিগত অবস্থান ব্যক্ত করতে সে কখনোই এতটুকু পিছপা হয়নি। তার মতো একজন ভালো বাঙালিকে এ দেশের খুব প্রয়োজন ছিল।