ফিচার ডেস্ক
সারা পৃথিবীর বুকে একমাত্র একজন নেতার একটি যাদুকরী ভাষণই গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে পুরো জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিল এবং নয়মাস মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল- সেটাই হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর সেই যাদুকরী ভাষণের বিশ্ব স্বীকৃতি! বঙ্গবন্ধুর এ ঋণ আমরা বাঙালি জাতি কীভাবে শোধ করবো।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ডস ডক্যুমেন্টরি হেরিটেজ) হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ৩০ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে ইউনেস্কোর সদর দফতর প্যারিসে এ ঐতিহাসিক ঘোষণাটি দেন। আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে এমন বিষয়গুলোকে বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টারের মেমোরিতে তালিকাভুক্ত করা হয়- সেই হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টারের মেমোরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইউনেস্কো-র এই স্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক বিশাল গৌরবের। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক দলিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তালিকাভুক্ত ঐতিহ্যের সংখ্যা দাঁড়ালো সারা পৃথিবীতে মাত্র ৪২৭টি। এ সংক্রান্ত তালিকাভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (আইএসি)। ২৪ অক্টোবর ২০১৭ থেকে ২৭ অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত বৈঠক করে ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আইএসি কমিটি।
রক্তঝরা-অগ্নিঝরা-রোদন ভরা বসন্তের উত্তপ্ত ফাল্গুনের ৭ মার্চ ’৭১ রবিবার ছিল বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। একাত্তরের অগ্নিগর্ভ ৭ মার্চ ঢাকা ছিল লাখো মানুষের পদচারণায় উত্তপ্ত স্লোগানের নগরী- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘জয়বাংলা, জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বাংলার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলেছিল। ঋতুরাজ বসন্তের অপরূপ অপরাহ্ণে ঢাকার রমনার সবুজ প্রান্তর রেসকোর্স ময়দানের জনমহাসমুদ্রে অপেক্ষা করছেন ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী বাংলার সংগ্রামী জনতা- এদিন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি রূপকথার প্রবাদ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে বর্বর পাকিস্তানি জাতির কবল থেকে মুক্তির দিকনির্দেশনা দিবেন। একটি শুধু একটি ঘোষণা বা ডাকের অপেক্ষায় আগের দিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি উত্তেজনায় আবেগে বিনিদ্র রজনী যাপন করেছেন- আজ কী ডাক দিবেন- কী নির্দেশনা দিবেন বঙ্গবন্ধু! বীর বাঙালির শুধু একটাই চাওয়া একটাই আকাঙ্ক্ষা চার অক্ষরের একটি প্রিয় শব্দ ‘স্বা-ধী-ন-তা’!
১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনমহাসমুদ্রে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা পৃথিবী কাঁপানো ভাষণের টগবগে রক্তে আগুন জ্বলা বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, হাজার বছরের স্বপ্নের বাণী, হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন- যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। দীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্।” এই ঐতিহাসিক ভাষণই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে-নির্দেশে মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যত ভাগ্য স্পষ্ট নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে দেওয়া জাতির পিতার এই কালজয়ী যাদুকরী ভাষণে ধ্বণিত হয়েছিল বাংলার গণমানুষের প্রাণের দাবী। এই ভাষণে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানিদের হত্যা-নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র মূর্ত হয়ে উঠে। শত্রুর মোকাবেলায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।” জাতির পিতার এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
আগের দিন ৬ মার্চ পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠীরও ঘুম হারাম হয়ে পড়ে- বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তারিখ কী ঘোষণা দিবেন। ৬ মার্চ শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে একজন ব্রিগেডিয়ার ধানমন্ডি ৩২ নং রোডের বাড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের হাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে আসেন। একদিকে ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলে টেলিপ্রিন্টারে বার্তা পাঠিয়ে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে বিরত থাকার জন্য কাকুতি-মিনতি করেন- অন্যদিকে ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। ঢাকার জিওসি জে. খাদিম হোসেন রাজা স্পষ্ট করেই শেখ মুজিবুর রহমানকে জানিয়ে দেন, “৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে জনসভায় আক্রমণ চালাবে। এক কথায় ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে, যেখানে শাসন করার ও শাসিত হওয়ার কেউ থাকবে না। প্রয়োজনে বিমান থেকে জনসভায় হামলা করা হবে।” উল্লেখ্য, ঢাকা সেনানিবাস থেকে ৭ মার্চের জনসভাকে লক্ষ্য করে কামান বসানো হয়েছিল। একটি জলপাই রঙের হেলিকপ্টর ঐদিন জনসভার ওপর দিয়ে বারবার টহল দিচ্ছিল। অর্থাৎ শেখ মুজিব ঐদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তান সামরিক চক্র জনসভায় নির্বিচারে গুলি চালাবে এবং এতে শুধু হাজার হাজার নয়- লাখো মানুষ নিহত হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না।
বঙ্গবন্ধু এখন কী করবেন- একদিকে ছাত্র নেতাদের প্রচন্ড চাপ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য- অন্য দিকে দেশবাসীর দাবীতো আছেই- একটু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দেশবাসীর কত বড় ধরণের ক্ষতি বা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারি এমনকি একটা জাতি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে- সে চিন্তা অবশ্য বঙ্গবন্ধুর মাথায়ও ছিল- বঙ্গবন্ধুর সেদিন অর্থাৎ ৭ মার্চ একশো চার ডিগ্রি জ্বর ছিল এবং এই জ্বর নিয়েই তিনি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হন। সম্প্রতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ৭ মার্চের বক্তৃতার বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর অনেক দেশের উদাহরণ দিয়েছেন এবং এভাবে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বাঙালির কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে সে বিষয়েও পরিবারকে অবহিত করেন। বঙ্গবন্ধু এভাবে অনেক উদাহরণ পরিবারের সদস্যদের সামনে উপস্থাপন করলেন- এই সিদ্ধান্তহীনতার জাতির অত্যন্ত সঙ্কটময় জরুরী মুহূর্তে তখন বঙ্গমাতা মহীয়সী বেগম ফজিলাতুন্নেসা (বেগম মুজিব) এগিয়ে এসে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, “না, এটা তুমি করতে পারবে না। ছয় দফার মধ্যে দিয়ে তুমি বাঙালি হৃদয়ে যে স্থায়ী আসন বানিয়েছ, তোমার এ ঘোষণা তাদের কি ক্ষতির সম্মুখীন করবে- ভেবে দেখেছ? পাকিস্তানি আর্মি ওৎপেতে বসে আছে তোমার এ ঘোষণার জন্য। ওরা তোমাকে তো মারবেই, তোমার প্রিয় বাঙালি জাতিকেও শেষ করে দেবে।” বেগম মুজিবের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু নাকি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পাইপ ধরালেন। শেখ হাসিনার সেদিনের স্মৃতিচারণা থেকে এ বিষয়টি নতুন করে বেরিয়ে এসেছে। বেগম মুজিব গৃহবধূ হয়েও কতবড় রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিধ ও দার্শনিক ছিলেন- সেই অধ্যায় নিয়ে কোনো গবেষণা এখানো হয়নি- একটি দেশের বা জাতির একটি অত্যন্ত সঙ্কটময় গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের সময় একটি সঠিক সিদ্ধান্তের পরামর্শ দিয়ে একটা দেশ বা জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন- বঙ্গমাতা মহীয়সী বেগম ফজিলাতুন্নেসা (বেগম মুজিব)-এর সে অধ্যায়টা দেশবাসীর কাছে পর্দার অন্তরালেই রয়ে গেলো।
৭ মার্চ ’৭১ রবিবার সকাল থেকেই আমাদের লেকসার্কাস-কলাবাগানের বাসা থেকে মিরপুর রোডের রেসকোর্স অভিমুখে মিছিলের মুহুর্মুহু স্লোগান সবই শোনা যাচ্ছিল- উত্তেজনায় আমি এবং আমার বড়ভাই ছটফট করছি। রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক মিটিংএ আগেভাগেই যাওয়ার জন্য সেদিন আব্বা দুপুর ১২টার আগেই আমাদের দুই ভাইয়ের খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে বললেন। অবাক হয়ে যাই আব্বার এ ধরনের মুক্ত আচরণ দেখে! যত মিটিং-মিছিলে গিয়েছি সব বাবার অজান্তে পালিয়ে পালিয়ে- আর আজ কিনা বাবা নিজের থেকেই…! আমার কাছে মনে হচ্ছিলো- আমরা দুই ভাই যুদ্ধে যাচ্ছি। রেডিও ক্যাসেট রেকর্ডারে নাইটি মিনিটের ক্যাসেট সেট করে দিয়ে বাসার সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যাতে বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ ভাষণটি যেনো রেকর্ড করা হয়। মিরপুর রোডে এসেই রেসর্কোস অভিমুখে অগ্রসরমান স্লোগানমুখর মিছিলের সাথে মিশে যাই। নির্মাণাধীন শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরির কাছে আসতেই দেখলাম লাইব্রেরির দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন মিছিলের লোকদেরকে লাঠির সমান টুকরো করা লোহার রড বিলিয়ে দিচ্ছে। আর্ট কলেজের বিপরীত দিক দিয়ে রেসকোর্সে প্রবেশ করি। মঞ্চের সামনে নিরাপত্তার জন্য এবং মহিলাদের বসার জন্য অনেকটা জায়গা জুড়ে বাঁশ দিয়ে ঘেরাও দেওয়া ছিল এবং সেই ঘেরাও দেওয়া বাশেঁর বাউন্ডারি ঘেঁসেই প্রথম দিকেই আমার আসন ছিল। লক্ষ কণ্ঠের স্লোগানে স্লোগানে মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী প্রকম্পিত হচ্ছে! বাঙালিদের সবচেয়ে ঘৃণিত স্লোগান ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ তথা পাকিস্তানিদের তথাকথিত স্লোগান ‘জিন্দাবাদ’-কে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির রণহুঙ্কার হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘জয়বাংলা’। প্রচুর দেশি-বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত। জনসমুদ্রের মাঝখানে হলুদ রঙের অনেক উঁচু একটি ক্রেনের মধ্যেও ক্যামেরা এবং টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছেন সাংবাদিকরা। রেসকোর্সের জনসমুদ্রের উপর দিয়ে একটি জলপাই রঙের হেলিকপ্টর উড়ে গেল।
বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে ওঠে এলেন- তখন রেসকোর্সে বাংলার উপস্থিত ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী বীর জনতা বজ্র নির্ঘোষে করতালি ও গগনবিদারী স্লোগানের মধ্যে তাদের প্রিয় নেতাকে অভিনন্দন জানান- ‘বাঁশের লাঠি তৈরি কর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা’, ‘জয়বাংলা- জয়বাংলা’, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগান দিয়ে।
মঞ্চ থেকে মাইকে স্লোগান দেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলীগের নেতা আ.স.ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকের প্রধান আবদুর রাজ্জাক।
মুহুর্মুহু স্লোগানের গর্জনে ফেটে পড়ে বাংলার আকাশ বাতাস। মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন- জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং আরো অনেকে।
বঙ্গবন্ধু তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ও ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, “আজ বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। … প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা।”
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচার হওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তান সরকারের হস্তেক্ষেপে তা সেদিন প্রচারিত হতে পারেনি। আমরা রেসকোর্সে জনসমুদ্রে বসেই সেই খবর পেয়ে যাই। তাৎক্ষণিক ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে যায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র। পরে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ পরের দিন সকালে বঙ্গবন্ধুর রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচার করে। তখনই আমরা রেডিওতে প্রচার করা ভাষণটি রেডিও ক্যাসেট রেকর্ডারে রেকর্ড করি।
মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, হাজার বছরের স্বপ্নের বাণী, হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন- যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। দীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্।” এই ঐতিহাসিক ভাষণই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে-নির্দেশে মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যৎ ভাগ্য স্পষ্ট নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। লাখো মানুষের স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল ঢাকা মহানগরী। স্মৃতিময় ঐতিহাসিক সেই দিনের ঘটনার ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে এখনো আমার স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করছে!
এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে যা নির্দেশ প্রদান করেছিলেন আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঘরে ফিরি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত প্রতীকী স্টাইলে ভাষণটি দিয়েছেন। একদিকে মুক্তিকামী মানুষকে দীর্ঘ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের কূটনীতিবিদ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সবকিছুকে প্রকাশ করেছেন একজন কূটনীতিবিদের মতো। তিনি বলেছেন, বিগত ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর নির্বাচন, ৫৮-এর সামরিক শাসন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালি বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন, অন্যদিকে যুদ্ধকৌশলও বলে দিয়েছেন এবং একটি সাজানো গোছানো অলিখিত ভাষণ দিয়েছেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতার সারমর্ম পাকিস্তানিরা তখন বুঝতে পারেনি। আর আমাদের মতো তখন যারা কিশোর-তরুণ ছাত্র ছিলাম আমাদের একটাই দাবী ছিল স্বাধীনতা- এছাড়া আমরা অন্য কিছু ঘোষণা মানবো না- আমরাও তখন বুঝিনি- বুঝতে পারিনি বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। মাত্র ১৯ মিনিট ভাষণ দেওয়ার পর ১০ লক্ষাধিক লোকের মহাসমুদ্রে ‘জয়বাংলা’ বলে বঙ্গবন্ধু শেষ করেন ৭ মার্চের ভাষণ- যা আজ বিশ্ব ইতিহাসের সেরা ভাষণের একটি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে।
বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ: (রেসকোর্স ময়দান, ঢাকা, ৭ মার্চ, ১৯৭১ রবিবার)
“ভায়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার আত্ম অধিকার চায়।
কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনে সাতই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন- আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আপনারা জানেন, দোষ কি আমাদের? আজকে আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি আপনারা জানেন- আলাপ-আলোচনা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়- পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, পনেরোই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। তিনি মাইনে নিলেন। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমরা আলাপ-আলোচনা করবো। আমি বললাম বক্তৃতার মধ্যে, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো।
তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। তারপরও যদি কেউ আসে তাকে ছন্নছাড়া করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।
কী পেলাম আমরা? যা আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি যখনই এদেশের মলিক হবার চেষ্টা করেছি- তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারা আমাদের ভাই। আমি বলেছি তাদের কাছে এ কথা। যে আপনারা কেন আপনার ভাইয়ের বুকে গুলি মারবেন? আপনাদের রাখা হয়েছে যদি বহিঃশক্রু আক্রমণ করে তার থেকে দেশটাকে রক্ষা করার জন্য। তারপর উনি বললেন- যে আমার নামে উনি বলেছেন আমি নাকি স্বীকার করেছি যে ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি উনাকে একথা বলে দিবার চাই- আমি তাকে তা বলি নাই।
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান, ঢাকায় আসেন, কীভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তারপরে আপনি ঠিক করুন- আমি এই কথা বলেছিলাম। আমিতো অনেক আগেই বলেছি কিসের আর টি সি? কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে, পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন এবং যে বক্তৃতা করে এসেম্বলি করেছেন- সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।
আমি পরিষ্কার মিটিংএ বলেছি, এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, যে ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসা আমরা এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাকে দেয় নাই।
ভাইয়েরা আমার, তোমরা আমার উপর বিশ্বাস আছে? আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাঁচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়াগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু… সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা।
আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। শোনেন মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন।
তবে আমি অনুরোধ করছি- আপনারা আমাদের ভাই- আপনারা দেশকে একেবারে জাহান্নামে ধ্বংস করে দিয়েন না। জীবনে আর কোনোদিন আপনাদের মুখ দেখাদেখি হবে না। যদি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ফয়সালা করতে পারি তাহলে অন্ততপক্ষে ভাই ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা আছে। সেইজন্য আপনাদের অনুরোধ করছি আমার এই দেশে আপনারা মিলিটারি শাসন চালাবার চেষ্টা আর করবেন না।
দ্বিতীয় কথা- প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়- প্রত্যেক ইউনিয়নে- প্রত্যেক সাবডিবিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”
“আপনারা আমার উপর বিশ্বাস নিশ্চই রাখেন- জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সাথে বেঈমানি করি নাই। প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই। ফাঁসি-কাষ্ঠে আসামী দিয়েও আমাকে নিতে পারে নাই। যে রক্ত দিয়ে আপনারা আমাকে একদিন জেলের থেকে বাইর করে নিয়ে এসেছিলেন এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম- আমার রক্ত দিয়ে আমি রক্ত ঋণ শোধ করব- মনে আছে? আমি রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত। আমাদের মিটিং এইখানেই শেষ। আসসালামু আলাইকুম। জয়বাংলা।”
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের পূর্ণাঙ্গ ভাষণ ইংরেজিতে (The historical 7th March speech by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman)
7th March 1971 Ramna Racecourse, Dhaka, Bangladesh
… Brothers of mine,
Today I appear before you with a heavy heart. You know and understand everything. We tried with our lives. But the painful matter is that now the streets of Dhaka, Chittagong, Khulna, Rajhshahi and Rangpur are stained with the bloods of my brothers.
Now the people of Bangla want freedom. The people of Bangla want to live. The people of Bangla want to have their rights.
What wrong did we commit?
The people of Bangladesh cast their vote overwhelmingly for me, for Awami League.
Our National Assembly will sit. We will draw up the Constitution there. And we will build this country. The people of this country will have economic, political and cultural freedom.
But it’s a matter of great sorrow that today I have to tell painfully the pitiful history of the last twenty three years. The bloody history of Bangalis tortured in Bangla itself.
The history of the last twenty- three years is the history of the wailing of dying men and women.
The history of Bangla is the history of the staining of streets with the blood of the
People of this country.
We gave blood in 1952. After winning the election in 1954, we couldn’t even form the government. Proclaiming martial law in 1958, Ayub Khan made us slaves for ten years.
During the ‘Six Point Movement’, my children were gunned down on 7th June 1966.
After, the fall of Ayub Khan brought about the ‘Mass Movement’ of 1969 where Yahya Khan usurped power.
He said he would give constitution and democracy to the nation. We Agreed.
Thereafter the rest is history. There was an election. You know the fault was not ours.
Today I met President Yahya Khan and discussed everything with him. Being the leader of not only of Bangla but of the majority party of Pakistan, I requested him to convene the National Assembly of 15th February.
He didn’t agree with me, rather he yielded to Mr Bhutto’s demand to hold the assembly in the first week of March.
We said that was alright. We would sit in the Assembly. I went even to the extent of saying that if anybody, even a lone person proposed something reasonable, we, although the majority will accept the proposal.
Mr Bhutto came here. He conferred with us and said that the door for discussion was not closed. There would be more discussions.
Then we talked with other leaders and said ‘please come and sit together; let’s prepare the Constitution through discussion’.
Mr Bhutto said that if the members of West Pakistan came here, the Assembly would turn into a slaughter house. He said whoever would come would be killed.
If they came to the Assembly, then from Peshawar to Karachi, all shops will be closed down by force.
I said that Assembly would continue, then all of a sudden, the Assembly was closed on 1st March.
As President, Mr Yahya Khan had summoned the Assembly. I said that I would attend.
Mr Bhutto said that he won’t. Thirty- five members from West Pakistan came here. Then all of a sudden, the Assembly was closed. The people of Bangla were blamed; I was blamed too.
Because of the closure, the people of this country burst into protest. I told them to observe ‘hartal’ (strike) in a peaceful manner I told them to close down all mills and factories.
The people responded. The people spontaneously came out on the streets. They firmly pledged to continue their resistance in a peaceful manner.
What did we get?
The weapons we bought at the expense of our money to protect the country from the invasion of foreign enemies, are now being used against the poor and unarmed people of our country; they are being shot down.
We are the majority of the people of Pakistan. Whenever we Bangalis tried to gain power; tried to rule this country as our own, they assaulted.
They are our brother; I asked them ‘Why must you shoot your brother? You were deployed to protect this country from the attack of foreign enemies’.
Mr Yahya said that I had agreed that there would be a Round Table Conference (RTC) on 10th March. I said no such thing to him. I had a talk with him over the telephone.
I told him ‘General Yahya Khan, you are President of Pakistan. Come to Dhaka and see the how my poor people, my people of Bangla are being shot down. How the bosom of our mothers are being emptied of their sons. How my people are being killed. You come, see and do justice and then finalise. That’s exactly what I told him.
I told him long ago, RTC for what? Who do we sit with? With them… who spilled the blood of my people?
Without any consultation, with me or any discussion with us, suddenly after 5 hours of secret meeting, Yahya Khan delivered his speech, in which he dumped all the blame squarely on me, squarely on the people of Bangla. (The crowds says shame, shame)
I have said in the meeting, the struggle this time is our struggle for emancipation, the struggle this time is the struggle for our independence.
Brothers of mine.
The Assembly has summoned on the 25th March. The marks of bloods have not yet dried.
I had clearly said on 10th March that Mujib Rahman can’t joint RTC, treading the bloods of martyrs.
They have called the Assembly. They have got to accept my demands:
First, martial law must be withdrawn;
All army personnel must go back to the barracks;
There has to be an inquiry into the way the killings were carried out;
And the power has to be handed over to the people’s representatives.
Only then, we will consider whether we can sit in the Assembly or not. Before that we can’t sit in the Assembly. The people have not given me that right.
Brothers of mine
Do you have faith in me? (The crowds says yes yes)
I don’t want Prime Ministership. We want to establish the right of the people of this country.
I want to say in clear terms that from now on all courts, magistrates, offices and educational institutions in Bangladesh will remain closed sine die.
To ensure that no suffering is inflicted on the poor people, to ensure that my people do not suffer, from tomorrow the following things will be put out of range of the ‘hartal’. Rickshaws and hackney carriages will work; railway trains and launches will run.
But the Secretariat, Supreme Court, High Court, Judge’s Court and semi-government offices like WAPDA (Pakistan Water Development Authority) will not function. All employees will draw their salaries on the 28th of the month.
If salaries are not paid; if one more shot is fired and if my people are killed again then my request to you is; build a fortress in each and every home.
Face the enemy with whatever you have.
Incase I can’t give you any further order, I tell you; close all roads and highway indefinitely.
We will starve them to death. We will make them go without water and choke them to death.
You are our brothers. You stay in your barracks; no one will say anything to you. But don’t ever try to shoot us. This will do you no good.
You can’t keep seven crores of people subjugated. Since we have learnt to die, no one can dominate us.
We, from Awami League, will try our best to help those who are embracing martyrdom and those who have received injuries.
Those who are capable, please extend your monetary support, whatever you can to our relief fund. And every owner of industries will pay salaries to all workers who participated in the 7-day ‘hartal’.
My instruction to government officials is that you must obey what I say. From now on, tax will not be paid till such time as the freedom of our country is achieved; no one will pay anything.
Listen and bear in mind, the enemy has penetrated us in order to create divisions amongst us and to start looting.
Hindus, Muslims, Bengalis and non-Bengalis, all those who live in this Bangla are our brothers. The responsibility of protecting them is on you. Ensure that our reputation is not smeared in any way.
The employees of the Radio and Television; please bear in mind that if our words are not broadcasted by the radio, then no Bangali shall go to the radio station.
If our news is not broadcasted by Television, then no Bangali will go to the Television station. The bank shall remain open for two hours every day so that the people can get their salaries.
But from East Bangla, a single paisa will not be allowed to be remitted to West Pakistan.
Telephone and Telegraph service will remain operative in our East Bangla. They shall keep on sending our news to foreign news media. But if there is any sinister move to annihilate the people of this country, the Bangalis, you will have to keep very careful watch.
I am requesting you, you are my brothers.
Do not make this country a hell and destroy it.
We will not see each other’s face in the future.
If we can solve things in a peaceful manner, we can at least live as brothers.
That is why I am requesting you; do not try and run military rule in my country.
Secondly, in every village, every locality, every union and every sub-division establish ‘Resistant Council’ under the leadership of the Awami League.
And be ready with whatever you have.
Bear in mind that since we have given blood, we will give more. By the grace of Allah, we will surely liberate the people of this country.
The struggle this time is the struggle for our emancipation.
The struggle this time is the struggle for our independence. Joy Bangla. [কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: Sadia Rahman Rifa]
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ- যা বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে। লেখক ও ইতিহাসবিদ জেকব এফ. ফিল্ড-এর আড়াই হাজার বছরের গণজাগরণ ও উদ্দীপনামূলক বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা “উই শ্যাল ফাইট অন দি বিচেস: দি স্পীচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টরি” (We Shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired History- Jacob F.Field) এই গ্রন্থে বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর একটি ভাষণ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বের ১২টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে এই ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্ট্রার স্মারকে অন্তর্ভুক্তি আরেকটি মাইলফলক- যা বিশ্ববাসীর কাছে বিশেষ করে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে আলোর দিশারীতে পরিণত হয়েছে। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মুলমন্ত্র। এই ভাষণের যাদুকরী আবেদন আজও অম্লান যা প্রতিনিয়ত তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে এবং অনাদিকাল ধরে বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করে যেতে থাকবে। ৭ মার্চ ’৭১ রবিবার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে উপস্থিত থাকা ১০ লক্ষাধিক লোকের মধ্যে এখনও অনেকেই বেঁচে আছেন- যেমন আমি এখনো বেঁচে আছি- যা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় আজও চিরস্মরণীয় হয়ে জ্বলজ্বল করছে।
সারাবাংলা/এসবিডিই