‘রাইতে সউগ (সব) ভাঙি নিয়া গেইছে। গাছ গেলো, বাঁশ গেলো, মানুষ যে আছে এটা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। যে ভাঙন, ভাঙবার ধরলে কলিজাটা থাকে না!’
কথাগুলো বলছিলেন ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ভিটেহারা নারী বেগম রোকেয়া। ব্রহ্মপুত্রের অনিয়ন্ত্রিত ভাঙনে মাত্র দুই দিন আগে বাস্তুহারা হয়েছেন এই নারী। ঘর ভেঙে নিয়ে অন্যের জমিতে চালা তুলে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছেন। ভাঙনে দিশেহারা এই নারীর আগামীর দিনগুলো কীভাবে কাটবে তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
রোকেয়া বলেন, ‘ভিটা জেল্লা (ভিটাটুকু) তাও গেল। কোনো পথ নাই। এক কাটা সম্পদও নাই। কোনটে যামু? মেলাদিন থাকি ভাঙে, কাইয়ো উদ্দিশ (খোঁজ) করিল না।’
রোকেয়ার বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের পাইকানটারি গ্রামে। গত কয়েকদিনের ধারাবাহিক ভাঙনে ব্রহ্মপুত্র গ্রাস করেছে ওই গ্রামের ভিটা, আবাদি জমি। শুধু রোকেয়া নন, তার কয়েক প্রতিবেশীসহ গত ২০ দিনে অন্তত ১৫টি পরিবার ভিটা হারিয়েছেন। নদে বিলীন হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ বিঘা আবাদি জমি।
ভাঙনের শিকার রোকেয়ার আরেক প্রতিবেশী
আজহার আলী (৬৭)। অর্ধেক ভিটা ব্রহ্মপুত্র গিলেছে। বাকিটায় চিড় ধরেছে। যেকোনও মুহূর্তে সেটিও যাবে। আকস্মিক ভাঙনে বসত ভিটার গাছপালা ও বাগান হারিয়ে ঘর ভেঙে অন্যের জায়গায় রেখেছেন। স্ত্রীকে নিয়ে অন্যের জায়গায় চালা করে মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছেন।
আজহার আলী বলেন, ‘আমগো সব শ্যাষ। কোথায় যামু, কই থাকমু কোনও কূলকিনারা পাইতাছি না।’
খানিক দক্ষিণে চা দোকানি শহিদুল ইসলামের (৪৩) বসতি। আরও কিছুটা সামনে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু তাতে রক্ষা হয়নি শহিদুলের বসত ভিটা।
শহিদুল বলেন, ‘আমার তিনটা ঘর ভাঙছে। আর একটা আছে। ওটাতেই থাকতেছি। আমরা শুধু চাই, সরকার নদীটা শাসন করে ভাঙন থাকি আমাদের বাঁচাক। আমরা রিলিফ টিলিফ কিছু চাই না।’
‘প্রায় একযুগ ধরে ভাঙতাছে। মাঝখানে বিরতি দিয়া আবার দুই বছর ধইরে ভাঙতাছে। সরকার ব্যবস্থা নিলে হয়তো রক্ষা পাওয়া যাবে। কিছু বস্তা পড়লে হয়তো সেই উসিলায় আল্লাহ টিকায় দিতো’, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় আকুতি জানিয়ে কথাগুলো বলেন শহিদুল।
স্থানীয়রা বলছেন, একসময় রাস্তাঘাট, ব্রিজ, স্কুল সব ছিল। ব্রহ্মপুত্র এখন সব গিলেছে। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ (গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী) পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। স্থানীয়রা নিজেদের বসতি রক্ষায় জিও ব্যাগ ফেলার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি।
বাস্তুভিটা হারানো শহিদুল ও আজহার আলীসহ ভুক্তভোগীরা বলেন, ‘বাড়িঘর বিলীন হওয়ার পর সোমবার কিছু জিও ব্যাগ ফেলছে। অথচ কয়েকদিন আগে ফেললে আমরা নিঃস্ব হইতাম না।’
কিছুটা দক্ষিণে এগিয়ে যেতে দেখা মিললো আরও কয়েকটি ভাঙন কবলিত বসতভিটা। ঘরের নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে অস্থায়ী বসতি গড়েছে পরিবারগুলো। তাদের একজন মৎস্যজীবী হাসানুর। গত পরশু তাকে দুইটা ঘর ভেঙে সরাতে হয়েছে। বসতভিটা নদের গর্ভে। এখন অন্যের জায়গায় চালা তুলে স্ত্রী সন্তানসহ বাস করছেন।
হাসানুর বলেন, ‘এক বছরে তিনবারসহ এ পর্যন্ত পাঁচ বার ভাঙনে পড়লাম। কয়েক বছর আগে ভিটা হারাইছি। এরপর থাইকা অন্যের জায়গায় ঘর কইরা থাকি। নদী সেহানেও থাকতে দিতাছে না। সরকার একটু ব্যবস্থা নিলে স্থির হইতে পারতাম।’
হাসানুরের স্ত্রী তারাবানু বলেন, ‘মাছ মাইরা জীবন চলে। ঘরবাড়ি করমু নাকি পেটে খাবার দিমু? দুইটা বাচ্চা নিয়া কই যামু কিছু বুঝতে পারতেছি না।’
কোদালকাটির পাইকানটারি গ্রামে এখন দিনরাত ভাঙন আতঙ্ক। গ্রামের কিছুটা দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্রের বিস্তীর্ণ তীর জুড়ে জিও ব্যাগের স্তূপ। দেখেই বোঝা যায়, কয়েক বছর ধরে এই এলাকায় নদের আগ্রাসী রূপ শত শত পরিবারকে নিঃস্ব করেছে। এখনও ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে শত শত পরিবারের বসত ভিটা ও আবাদি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
স্থানীয়দের দাবি, নদীর তীর রক্ষায় দ্রুত স্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা করে দেবে সরকার। এতে তাদের জীবন ও জীবিকা স্থায়িত্ব পাবে।
কোদালকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ন কবীর ছক্কু বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ৩ ও ৫ নং ওয়ার্ডে ভাঙন চলছে। পাইকানটারি গ্রাম ছাড়াও মধ্য চরসাজাই গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হুমকির মুখে। পাউবোকে জিও ব্যাগ দেওয়ার কথা বললে দেই-দিচ্ছি করছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কোদালকাটির কিছু এলাকায় প্রতিরক্ষা কাজ চলছে। বরাদ্দের অভাবে কিছু এলাকায় কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। ওই এলাকায় স্থায়ী সুরক্ষা প্রকল্পের জন্য আমরা সমীক্ষা ও প্রাক্কলন তৈরির কাজ করছি।’