বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার এসএম কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা রঞ্জু বেগম। পেশায় তিনি একজন নারী উদ্যোক্তা (মুদি দোকানদার)। তবে তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। পড়াশোনা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন থাকলেও বাবা-মায়ের ইচ্ছাতে কৈশোরে পা দিতেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। সংসার জীবন বুঝে ওঠার আগেই দুই কন্যা সন্তানের মা হন তিনি। দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার পর স্বামী তাকে একা ফেলে চলে যান। এরপর থেকেই শুরু হয় তার জীবনসংগ্রাম। নানা চড়াই-উৎড়াইয়ের পর আজ তিনি নারী উদ্যোক্তা এবং সফল নারী। এলাকার অনেকেই তাকে অনুসরণ করা শুরু করেছেন।
সম্প্রতি মোড়েলগঞ্জে রঞ্জু বেগমের দোকানে বসেই কথা হয় প্রতিবেদকের। এ সময় নিজের জীবন সংগ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন রঞ্জু বেগম। তিনি বলেন, স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর তার কাছে দুনিয়াটা অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়েছিল। কী করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি।
রঞ্জু বেগমের কথায়, ‘দুটি শিশু নিয়ে আমি অসহায় হয়ে পড়লাম, আমার বাবার পরিবারের অবস্থাও খুব বেশি ভালো ছিল না। তারপরও দুই কন্যা সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসি। পাঁচ বোন, দুই ভাই আর বাবা-মায়ের সঙ্গে যুক্ত হলাম আমরা। এখান থেকে শুরু হয় জীবনের এক নতুন অধ্যায়। আমি প্রথমে মোড়লগঞ্জ বাজারের বিভিন্ন চায়ের দোকানে ও বাসা বাড়িতে পানি দেওয়া শুরু করি। ফাঁকে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মের কাজও করি। কিন্তু আমার একার উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চালানো বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। এজন্য রাতেও অন্যের বাড়িতে ধান সেদ্ধ করে দেওয়ার কাজ করতে হয়েছে আমাকে।’
একটা পর্যায়ে স্থানীয় বাজারে রঞ্জু বেগমের ছোট ভাই একটি মুদি দোকান শুরু করেন। সেখানে তাকে সহায়তার পাশাপাশি ডিসি অফিসের রান্নার কাজ নেন তিনি। বলছিলেন, ‘এসব উপার্জন দিয়েই ভাই-বোন ও দুই মেয়ের পড়াশোনা ও সংসার খরচ চলতে থাকে। মাঝে মাঝে নিজের নিয়তির কথা চিন্তা করে গভীর রাতে একা একা কান্না করতাম। তবে পরক্ষণে চোখ মুছে চিন্তা করতাম— আমি থেমে গেলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। সংসারের সবার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে। আমি নারী বলে সমাজের লোক অনেক কিছুই বলতো। কিন্তু সমাজ তো আমাকে খাওয়ায় না, সমাজ আমাকে পরায় না।’
এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে নানান অভাব অনটনে চলতে থাকলেও কিছু টাকা সঞ্চয় করার চেষ্টা করতাম। একটা পর্যায়ে স্থানীয় সমিতি থেকে আরও কিছু টাকা ঋণ করে বাজারের পাশে নিজের দোকান শুরু করেছিলাম। এই দোকান পরিচালনা করেও তিন বছর ডিসি অফিসের রান্নার কাজটা করতে হয়। এরইমধ্যে পরিচয় হয় বেসরকারি সংস্থা বপ ইনক-এর এক প্রতিনিধির সাথে। তার কাছ থেকে জানতে পারি নারীদের উদ্যোক্ত হয়ে উঠতে প্রতিষ্ঠানটি নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেয়। পরে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা আমাকে পরবর্তী গাইডলাইন দিয়ে দেয় এবং সে অনুযায়ী কাজ করে বার্তমানে এলাকায় আমি একজন প্রতিষ্ঠিত নারী উদ্যোক্তা। এখন আমার ব্যবসাও বেশ ভালো চলে এবং আজ আমি পুষ্টি আপা নামে পরিচিত।’
এই বিষয়ে জানতে বপ ইনক-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংস্থাটির ইমপ্যাক্ট ম্যানেজার রাফায়েত আলম বলেন, ‘আমরা বর্তমানে খুলনার প্রত্যন্ত এলাকার ২০০ জন নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে কাজ করছি, বিশেষ করে যাদের মধ্যে উদ্যোক্তা হবার অদম্যস্পৃহা রয়েছে। তাদের আমরা ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিনামূল্যে তাদের নানান প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এছাড়াও এসব প্রত্যন্ত এলাকায় থেকেও প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোর ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে এবং স্থানীয় পর্যায়ে চাহিদাসম্পন্ন পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাদের এই প্রচেষ্টার পুরো প্রক্রিয়াটিও তদারকি করা হয়।’
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার থুকরা ইউনিয়নের রূপরামপুরের আরেকজন নারী উদ্যোক্তা শিল্পী জোয়ার্দার। যিনি বিয়ের পর অভাবের সংসারে স্বামীর আয়ে নির্ভর না থেকে অন্য আয়ের উৎস হিসেবে নিজেই মুদি দোকান দেন। এরপর পরিবারসহ প্রতিবেশী ও সমাজ থেকে শুনতে হয় নানা কটূ কথা। তারপরও থেমে যাননি তিনি। বর্তমানে তিনি পরিবারের ভরসার স্থলে পরিণত হয়ে উঠেছেন। ব্যবসার পাশপাশি এলাকায় তিনি গড়ে তুলেছেন নারী কল্যাণ সমিতি। সেখান থেকে নারীরা ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেন।
রঞ্জু-শিল্পীর মতো এমন গল্প রয়েছে খুলনা অঞ্চলের গ্রামীণ প্রত্যান্ত এলাকার ২০০ নারীর। সম্প্রতি নড়াইলের কালিয়া, বাগেরহাটের মোড়েরগঞ্জ ও খুলনার ডুমুরিয়ার গ্রামীণ নারী ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।
শিল্পী জোয়ার্দার জানান, নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বিয়ে হয়ে যায় তার। তবে সেই স্বপ্নকে মরে যেতে দেননি তিনি। পাঁচ বছর আগে ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে দোকান শুরু করেন। পরে বপ ইনক থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ বিষয়ক সহায়তা নিয়ে এখন এলাকার অন্য নারীদেরও প্রশিক্ষণও দেন তিনি। তাছাড়াও বপ ইনকের প্রতিনিধি আমার ছোট্ট দোকানটিকে এমনভাবে সাজিয়ে দিয়েছে, যেটা সবার নজর কেড়েছে। এইসব সহয়তা তার নিজের ব্যবসায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান বাজার এলাকার উদ্যোক্তা শারমিন কবির। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় ২০০৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী পঙ্গু হয়ে যান তার স্বামী। এরপর থেকেই জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। অনেক কষ্টে কিছু টাকা একত্রিত করে ছোট্ট একটা দোকান দেন।
তিনিও বপ ইনক থেকে সহায়তা পেয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘ব্যবসার প্রথমে অনেকেই বলছিল আমাকে দিয়ে হবে না, আমি পারবো না। কিন্তু এখন এলাকার সবাই আমাকে অনেক সম্মান করে।
এছাড়াও নড়াইলের জালিয়া উপজেলার জামরিলডাঙ্গার রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘নারী হিসেবে দোকানদার হয়ে ওঠা সহজ ছিল না। এখন জামিরডাঙ্গা, পেরোলী, কদমতলা, খোরলিয়া, শীতলবাড়ির লোকজন আমায় পুষ্টি আপা বলেই জানে। এটা সম্ভব হয়েছে ব্যবসা পরিচালনার জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ ও দিক নির্দেশনা পাওয়ায়।’
রাবেয়া খাতুনের স্বামী মো. মিজানুর রহমান জানান, আধা কিলোমিটার দূরে বেশ কিছু দোকান থাকলেও সেখানে প্রয়োজনীয় সবকিছু থাকে না। রাবেয়ার দোকানে সবই থাকে। কারণ এলাকার মানুষের চাহিদা সম্পর্কে তার ভালো ধারণা আছে। ফলে লোকজন তার দোকানেই আসে।