দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের এই সিদ্ধান্তে খুশি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মানুষ। নির্বাচনি এলাকার দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের আনন্দিত হওয়া ও মীর মোস্তাক আহমেদ রবির মনোনয়ন না পাওয়ার নেপথ্য কারণ বেরিয়ে এসেছে তথ্য অনুসন্ধানে।
অনুসন্ধান বলছে, সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটিতে নিজের লোকদের বসিয়ে নিয়োগ ও এমপিও বাণিজ্য করেছেন দেদার। নিজের আপন বোন, পিএ, সিএ, এমনকি ছাতা ধরা কর্মচারীকেও করেছেন একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় বসবাসরত সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবির ছোট বোন রোটারি ক্লাব অব জাহাঙ্গীরনগরের ক্লাব প্রেসিডেন্ট নাজনীন আরা নাজু কালেভদ্রে সাতক্ষীরায় আসেন। অথচ তাকে সাতক্ষীরা নবারুণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, ঝাউডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ ও ভালুকা চাঁদপুর আদর্শ কলেজের সভাপতি করে এমপি রবি নিজেই কলকাঠি নাড়েন।
শুধু বোন নয়, এমপি রবির ব্যক্তিগত সহকারী মকসুমুল হাকিমকে করা হয়েছে সাতক্ষীরা রসুলপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সভাপতি।
জিয়াউর বিন সেলিম জাদু সম্পর্কে এমপি রবির ভাইপো। তার কাজ মূলত এমপি রবিকে রোদ-বৃষ্টিতে প্রটেকশন দিতে ছাতা বহন করা। তাকে করা হয়েছে বল্লী মো. মুজিবর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি।
সংসদ সদস্যের আরেকজন সহকারী শেখ মাহফুজুর রহমান জন। তাকে করা হয়েছে শিকড়ী বৈকারী-কুশখালী (বিকে) মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও আগরদাড়ী আমিনিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি। এছাড়া শেখ মাহফুজুর রহমানের বাবা শেখ তৌহিদুর রহমান ডাবলুকে করা হয়েছে কাথন্ডা আমিনিয়া আলিম মাদ্রাসার সভাপতি।
এই পঞ্চপাণ্ডবই নিয়ন্ত্রণ করছেন সাতক্ষীরা সদরের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার নিয়োগ বাণিজ্য। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সঙ্গে সভাপতিদের পরিচয়ই নেই। অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক দুই একদিন তারা প্রতিষ্ঠানে যান। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়নে তাদের কোনও প্রচেষ্টা নেই। তারা খোঁজ নেন কখন কী নিয়োগ হবে।
অনুসন্ধান বলছে, নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের নিয়ম বা স্থানীয় অভিভাবকদের দাবি থাকলেও এমপি রবি তা হতে দেন না। তিনি নিজের লোককে সভাপতি বানিয়ে কমিটি চাপিয়ে দেন এবং তাদের মাধ্যমেই চলে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য। বিভিন্ন সময়ে এমপি ও তার বসানো এসব সভাপতির বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও অজ্ঞাত কারণে তা বারবার চাপা পড়ে। এতে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা পড়ছেন বিপদে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে মীর মোস্তাক আহমেদ রবি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরপরই তার বিরুদ্ধে তিন ধাপে ১৩৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দফতরি কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগে জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। সেসময় টাকা দিয়েও নিজের ছেলেকে চাকরি না দেওয়ার অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেন সাতক্ষীরা ব্যাংদহা গ্রামের নিমাই চন্দ্র ঢালী। তিনি অভিযোগে জানান, ব্যাংদহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী পদে চাকরি পেতে ছেলে রাজকুমার ঢালীর জন্য তিনি সংসদ সদস্যকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিলেও ৬ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি বাগিয়ে নেন প্রতিদ্বন্দ্বী অসীম কুমার।
নিমাই চন্দ্র ঢালীর ছেলে রাজকুমার ঢালী বলেন, চাকরি না হওয়ায় বাবা টাকা ফিরে পেতে দেনদরবার করলে সংসদ সদস্য এক লাখ টাকা ফেরত দিয়েছিলেন। বাকি টাকার শোকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণসহ প্যারালাইজড হয়ে অচল হয়ে পড়েছেন বাবা।
বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় নিয়োগ ও এমপিও বাণিজ্যেও মীর মোস্তাক আহমেদ রবির সম্পৃক্ততার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এমপিও নীতিমালা ভঙ্গ করে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এমপি রবি ভালুকা চাঁদপুর আদর্শ কলেজের উপাধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহকে নিয়োগ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক বাসুদেব সিংহ, ভূগোলের প্রভাষক নাজমুল হক ও গ্রন্থাগারিক রহিমা খাতুনকে ফরোয়ার্ডিং দিয়ে বেতন আনিয়ে দেন। এ নিয়ে এমপিও নীতিমালা ভঙ্গ করার অভিযোগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক শেখ শরিফুল ইসলাম দুদকে অভিযোগ করলে দুদক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মাউশির সহকারী পরিচালক তপন কুমার দাস কলেজের ৪ শিক্ষককে এমপিও কেন বাতিল করা হবে না জানতে চেয়ে চিঠি দেন। এছাড়া চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবির প্রটোকলের দায়িত্বে থাকা গোপনীয় সহকারী ও শিকড়ী বৈকারী-কুশখালী (বিকে) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি শেখ মাহফুজুর রহমানসহ এমপির একান্ত কাছের লোকজনদের বিরুদ্ধে নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থের বিনিময়ে অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী নিয়োগ দেওয়ায় সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কাথন্ডা এলাকার ইছাহাক আলীর ছেলে ইয়াসিন আলী একটি মামলা করেন।
ভালুকা চাঁদপুর আদর্শ কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক শেখ শরিফুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালে মীর মোস্তাক আহমেদ রবি কলেজের সভাপতি থাকাকালে নিয়োগ ও এমপিওকরণে যে দুর্নীতি হয়েছে, এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না। কারণ, আমরা জানি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভাপতির ইচ্ছার বাইরে কারও কিছু করার সুযোগ নেই।
এদিকে সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সভাপতি থাকার সময়ে কলেজে তথ্য জালিয়াতি ও তথ্য গোপন করে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ ও এমপিওভুক্তি, অভ্যন্তরীণ তহবিল তছরুপ করে কমপক্ষে ১২ কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে। তথ্য জালিয়াতি করে ২১ জন শিক্ষককে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এমপিওভুক্ত করেছেন এমপি রবি। আর বাকি ১২ জন শিক্ষক জাল-জালিয়াতি করে এমপিওভুক্তির চেষ্টা করলে মাউশিতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্য জালিয়াতি ফাঁস হওয়ায় তাদের এমপিও হয়নি। এসবের প্রতিকার চেয়ে সিটি কলেজের এমপিও বঞ্চিত শিক্ষক বিধান চন্দ্র দাস প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মাউশি ও দুদকে অভিযোগ দেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে দুদক ২০২২ সালের ৯ মার্চ কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আবু সাইদসহ ৫ জনকে আসামি করে খুলনা আদালতে মামলা করেন। আর এ মামলায় বর্তমানে জেলে রয়েছেন সাতক্ষীরা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সাঈদ, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এসএম আবু রায়হান, দর্শন বিভাগের প্রভাষক নাসির আহম্মেদ ও হিসাববিজ্ঞানের প্রভাষক অরুণ কুমার সরকার।
অপরদিকে, সিটি কলেজের ইংরেজি শিক্ষক আবু রায়হানসহ ৪ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের এমপিও স্থগিত করেছে মাউশি কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে বিধান চন্দ্র দাস বলেন, হিসাববিজ্ঞানের দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে ২০১৫ সালে আমার এমপিও হওয়ার কথা। অথচ কাঙ্ক্ষিত অর্থ না পেয়ে কলেজের তৎকালীন সভাপতি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে রুনা লাইলাকে নিয়োগ দিয়ে ২০১৭ সালের মে মাসে এমপিওভুক্ত করান। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের পরিপত্র অনুসারে তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত করার সুযোগ আসে। তখন তথ্য জালিয়াতি করে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের জুনিয়র শিক্ষক অরুণ কুমার সরকারকে তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত করেন। উপায়ন্তর না দেখে আমি দুদকসহ বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করি। এ অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক প্রবীর কুমার দাস দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে অরুণ কুমার সরকারসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন।
তিনি বলেন, নিয়োগ ও এমপিওভুক্তকরণে সভাপতি হিসেবে মীর মোস্তাক আহমেদ রবি তার দায় এড়াতে পারেন না। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট সর্বোচ্চ আদালতের রায় ছিল এমপিরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারবেন না। অথচ তিনি এমপি হওয়ার তথ্য গোপন করে ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল সদর উপজেলার আখড়াখোলা-মুকন্দপুর দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি হন। মীর মোস্তাক আহমেদ রবি সাতক্ষীরা শহরের ছফুরেন্নেসা ডিগ্রি মহিলা কলেজের সভাপতি হন ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ। অথচ ৬ মার্চ তারিখে তিনি সভাপতি হিসেবে গভর্নিং বডির সভা করেন এবং ৮ জনকে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সুপারিশ করেন।
পরে দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ পড়লে তিনি নিজে সরে গিয়ে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব লোকজনকে সভাপতি বানিয়েছেন। এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষা খাতে মীর মোস্তাক আহমেদ রবির এমন কর্মকাণ্ডই তাকে বেশি বিতর্কিত করে তুলেছে নির্বাচনি এলাকায়। এ প্রসঙ্গে একজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এমপি সাহেব তার লোকজনকে বসিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ করে দিয়েছেন। তাও যদি একজনকে একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি করতেন মেনে নেওয়া যেতো। একেকজনকে দুই-তিনটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি করে প্রতিষ্ঠানগুলো জিম্মি করে ফেলেছেন তিনি।
এছাড়াও তার বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় নেতাকর্মীদের। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন তো করতেনই না, বরং বিভক্তি সৃষ্টি করে ‘রবি লীগ’ তৈরির চেষ্টা করেছেন বিগত দশ বছরে। তাকে প্রধান অতিথি না করে দলীয় কর্মসূচিও পালন করতে পারতো না সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগ।
এ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি গণমাধ্যমকে বলেন, তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে তাকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়েছে।