অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যায় নগরী, এক যুগেও কাটেনি দুর্ভোগ
বাংলাদেশ

অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যায় নগরী, এক যুগেও কাটেনি দুর্ভোগ

অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে বরিশাল নগরী। ডুবে থাকছে নগরীর অধিকাংশ ছোট-বড় সড়ক। দীর্ঘক্ষণ জমে থাকছে পানি। এতে নগরবাসীর ভোগান্তি বাড়ছে। এখনই এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় আতঙ্কে আছেন বাসিন্দারা। কারণ বর্ষা মৌসুম শুরু হলে এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে জেলা পরিষদ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ড্রেন ভরাট করে নগরীতে নির্মাণ করছে বহুতল মার্কেট। এতে সড়ক সরু হচ্ছে। সংকীর্ণ হচ্ছে ড্রেনগুলো। সেই ড্রেন দিয়ে পানি চলাচল করতে না পারায় নগরীতে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে বেড়েছে দুর্ভোগ। দীর্ঘ এক যুগেও এর সমাধান মেলেনি। অথচ প্রতি বছর জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বাজেট হয়। কিন্তু কাজ হয় না।

নগরীর কাউনিয়া সাবান ফ্যাক্টরি এলাকার বড় একটি অংশ সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায়। সড়ক থেকে শুরু করে আশপাশের এলাকায় পানি জমে থাকা দীর্ঘদিনের ঘটনা হিসেবে দেখে আসছেন এখানকার বাসিন্দারা।

দুর্ভোগের কথা জানিয়ে এই এলাকার বাসিন্দা মো. অলি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমার এলাকার সড়কগুলো বছরের বেশিরভাগ সময় পানির নিচে দেখে আসছি। ভারী বৃষ্টির প্রয়োজন হয় না, সামান্য বৃষ্টি হলেও ডুবে যায়। বর্তমানে একই অবস্থা বিরাজ করছে। সড়কে থাকা পানির সঙ্গে ড্রেনের পানি মিশে নোংরা পরিবেশ বিরাজ করছে। মাঝেমধ্যে এখানের বাসিন্দাদের মনে হয়, এসব দেখার কেউ নেই।’

কাউনিয়ার বাসিন্দারা বলছেন, নোংরা পানি মাড়িয়ে মসজিদে যাওয়ার পর কারও অজু থাকে না। আবারও অজু করে নামাজে দাঁড়াতে হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে এক যুগের বেশি সময় ধরে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীলদের কাছে গেলেও কাজ হয়নি। এভাবে বছরের পর বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এলাকাবাসী ওই পানিতে চলাচল করতে করতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কোনও উপায় নেই।

তার চেয়ে বড় সমস্যায় রয়েছেন নগরীর বটতলা মোড় থেকে করিমকুটির এলাকার বাসিন্দারা। এখানের বাসিন্দারা বলেন, আকাশে মেঘ আসলেই এখানকার সড়কে হাঁটু সমান পানি জমে যায়। নগরীর কোথাও পানি না থাকলে বৃষ্টি হলে এখানে পানি জমবেই। এ অবস্থা চলে আসছে এলাকার খাল ভরাটের পর থেকে। বটতলা মসজিদ মোড় এলাকায় খাল ভরাট করে জেলা পরিষদ গড়ে তুলেছে বহুতল মার্কেট। এরপর খাল ভরাট করে সরু ড্রেন করা হয়েছে। এতে করে বৃষ্টির পানিতে ড্রেন ভরে তা সড়ক সয়লাব হয়ে যায়।

এই এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, ‘কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে সংযোগ খালটি জিলা স্কুলের সামনে থেকে হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে বটতলা ও চৌমাথা হয়ে সাগরদী খালে মিশেছে। আগে ভারী বর্ষণে এলাকায় পানি জমেনি। কিন্তু খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমাদের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। ওই সড়কের সঙ্গে সঙ্গে পানি চলে যায় ১৫ থেকে ২০টি শাখা সড়কে। ফলে বাসা থেকে বের হওয়ার কোনও পরিস্থিতি থাকে না। এজন্য সিটি করপোরেশন থেকে ড্রেন পরিষ্কার করানো হলেও তাতেও মিলছে না সমাধান। বৃষ্টিতে কোথাও পানি না জমলেও আমাদের এলাকায় পানি থাকবেই।’

সার্কুলার রোডের বাসিন্দা মো. তুহিন জানান, তাদের এলাকায় একসময় খাল ছিল। সেই খাল ভরাট করে সড়ক ও ড্রেন নির্মাণের পর থেকে সামান্য বৃষ্টিতে সড়ক থেকে শুরু করে আশপাশের এলাকা পানিতে ডুবে যায়। একই অবস্থা কালু শাহ সড়কেরও। সেখানে তৃতীয় এবং পঞ্চম পরিষদের দুই মেয়রের বাসভবন হওয়া সত্ত্বেও বৃষ্টি হলে ওই সড়ক দিয়ে চলাচল কষ্টকর হয়ে যায়। একইভাবে পানিতে ডুবে থাকে পলিটেকনিক সড়কও। এ জলাবদ্ধতা নিয়ে বহু সংবাদ হয়েছে। কিন্তু তাদের দুর্ভোগ আজও কমেনি বলে জানালেন তুহিন।

নগরীর বাসিন্দা আলফাজ উদ্দিন বলেন, ‘সাবেক মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত দায়িত্ব নেওয়ার পর ড্রেন পরিষ্কার ও খাল খনন করায় কিছু সমস্যা কেটেছে। তবে কীর্তনখোলা নদীর জোয়ারের পানিতে বেশিরভাগ সময় নগরীতে পানি উঠে যায়। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় জোয়ার ও বৃষ্টি একসঙ্গে হলে। তখন হাঁটু সমান পানি মাড়িয়ে চলাচল করতে হয়। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলে আসছে। দেখার কেউ নেই।’

বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের নগরীর কালু খাঁ বাড়ির বাসিন্দা মো. মিরাজ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটু বৃষ্টি হলেই আমতলার মোড় থেকে কালু খাঁ বাড়ি এবং সিকদাপাড়া সড়ক পানিতে ডুবে যায়। খাল ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই সড়ক ও আশপাশের এলাকা ডুবে যাচ্ছে।’

২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রুস্তম আলী বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলতে হচ্ছে আমাদের। ভারী বর্ষণ এবং কীর্তনখোলার জোয়ারের পানিতে এলাকা ডুবে যায়। সেই পানি সরতে এক সপ্তাহের বেশিও লাগে। বছরের বেশিরভাগ সময় পানির মধ্য দিয়েই চলাচল করতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের একই অবস্থা।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সমন্বয়ক রফিকুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাল খনন না করা, জলাশয় ভরাটের কারণে নগরীতে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। ২০১০ সালে মাস্টারপ্ল্যানে নগরীতে ৪৬টি খালের নাম পাওয়া গেলেও এখন কোনোমতে অস্তিত্ব টিকে আছে সাতটির। নগরীতে বর্তমানে জলাশয় টিকে আছে ১০ শতাংশ। পানিপ্রবাহের জায়গা না থাকায় এই জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। এই সংকট দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে।’

৫৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন উল্লেখ করে রফিকুল আলম আরও বলেন, ‘সেখানে ৩০টি ওয়ার্ড আছে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমবেশি পানি থাকে। দীর্ঘদিন পর এ বছরের শুরুর দিকে সাতটি খাল খনন করা হয়। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ড্রেন পরিষ্কারের কাজও চলমান রয়েছে। তাতেও জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই মিলছে না আমাদের।’

এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাইল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীকে রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সাতটি খান খনন করা হয়েছে। এ ছাড়া ড্রেনে যাতে পানি আটকে না যায়, সেজন্য ড্রেন পরিষ্কারের কাজ চলমান আছে।’ 

শহররক্ষা বাঁধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া এ ব্যাপারে কেউ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে না। তবে সে বিষয়টি সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনায় আছে।’

বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কীর্তনখোলা নদীর পানি কিন্তু বাড়েনি। বিভিন্ন সময় সমীক্ষা চালিয়ে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। সমস্যা দেখা দিয়েছে নগরীর খাল, ডোবা, নালা ও পুকুর ভরাট করে বহুতল বাড়ি থেকে শুরু করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ কারণে বৃষ্টির পানি চলাচল করতে না পারায় সড়ক ডুবে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেতে ইতোমধ্যে ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতটি খাল খনন করা হয়েছে। এতে জলাবদ্ধতা অনেক কমে এসেছে।’

এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কীর্তনখোলা নদীর নগরীর প্রান্তে শহর রক্ষা বাঁধ মেরামত করা উল্লেখ করে মো. খালেদ বিন অলীদ বলেন, ‘বাঁধটি দেওয়া গেলে বিভিন্ন সময় বৃষ্টির সঙ্গে নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও নগরী ডুবে যাবে না। এর সঙ্গে ড্রেন পরিষ্কার রাখতে হবে। প্রতি বছর নগরীর খালগুলো খনন অব্যাহত রাখতে হবে। সেজন্য সিটি করপোরেশনকে এগিয়ে আসতে হবে। তারা সাহায্য চাইলে আমরা করতে প্রস্তুত আছি।’

Source link

Related posts

আম কুড়াতে গিয়ে সাপের কামড়ে শিশুর মৃত্যু

News Desk

শেখ জামালের শুভ সূচনা

News Desk

আরও ২-৩ দিন পর্যবেক্ষণে থাকবে সুন্দরবনের আগুন লাগা এলাকা

News Desk

Leave a Comment