দায়িত্ব পালনের সময় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে তার গ্রামের বাড়িতে। মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) আসরের নামাজের পর টাঙ্গাইল শহরের বোয়ালী মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে তাকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
নিহত তানজিম সারোয়ার নির্জন টাঙ্গাইল শহরের করের বেতকা গ্রামের সারোয়ার জাহানের ছেলে। সারোয়ার জাহানের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে তানজিম ছোট। তার বড় বোন স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করেন।
এদিকে, তার এমন করুণ মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মাতম চলছে নিহতের পরিবারে। সেনা কর্মকর্তা তানজিম নিহতের খবর এলাকায় জানাজানি হলে সকাল থেকেই তার বাড়িতে ভিড় করেন আত্মীয়-স্বজনসহ এলাকাবাসী। এরই মধ্যে ঘাটাইল শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস থেকে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা নিহত তানজিমের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জানিয়েছেন।
এদিন বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জনের মরদেহ কক্সবাজার থেকে হেলিকপ্টারযোগে টাঙ্গাইল হেলিপ্যাডে এসে পৌঁছায়। এ সময় পুরো এলাকা ঘিরে রাখেন সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সেখান থেকে লাশবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তার মরদেহ শহরের বোয়ালী এলাকার নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার পর নিহতের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। আসরের নামাজের পর শহরের বোয়ালী মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে তাকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এর আগে, তাকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হয়। এ সময় ঘাটাইল এরিয়ার ১৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ মাসীহুর রহমান, যমুনা ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মামুনুর রশীদসহ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তার মৃত্যুর ঘটনার পরিবার ও এলাকাবাসী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নিহত তানজিমের বাবা সারোয়ার জাহান প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ রকম মৃত্যু যেন আর কারও না হয়। আর যেন কোনও বাবার এভাবে আর্তনাদ করতে না হয়। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার চাই। তানজিমই আমার একমাত্র ছেলে। সেই ছিল বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমি এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার ও অপরাধীদের ফাঁসি চাই।’
তানজিমের মা নাজমা বেগম ছেলে হারানোর বেদনায় বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘তানজিম ছিল আমার কলিজার টুকরা। আবার ছেলের এভাবে অকালমৃত্যু হবে, তা কখনও ভাবিনি। সরকারপ্রধান ও সেনাপ্রধানের কাছে আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
ঘাটাইল এরিয়ার ১৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ মাসীহুর রহমান বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা সেনাবাহিনী খুবই মর্মাহত। আমরা আমাদের একজন সহকর্মীকে হারিয়েছি। আমরা তার পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করছি। বাংলাদেশ আইন অনুযায়ী আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ৩টার দিকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চকোরিয়া উপজেলার অন্তর্গত ডুলহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে ডাকাতির খবর পেয়ে চকোরিয়া আর্মি ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল দ্রুততার সঙ্গে গমন করে। আনুমানিক ৪টার দিকে মাইজপাড়া গ্রামে অভিযান পরিচালনা করার সময় ৭-৮ সদস্যের একটি ডাকাত দল সেনা টহল দলের উপস্থিতি টের পেয়ে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার সময় লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জন (২৩) ডাকাত দলের কয়েকজনকে তাড়া করেন। এ সময় ডাকাত দলের সদস্যরা লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জনের ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করলে গুরুতর আহত হন এবং এতে তার প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তাৎক্ষণিকভাবে লেফটেন্যান্ট তানজিমকে উদ্ধার করে মালুমঘাট মেমোরিয়াল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জন টাঙ্গাইল শহরের বোয়ালী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী এই তরুণ সেনা কর্মকর্তা পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ৮২তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে ২০২২ সালের ৮ জুন আর্মি সার্ভিস কোরে (এএসসি) কমিশন লাভ করেন।
প্রসঙ্গত, ঘটনাস্থল থেকে তিন ডাকাতকে আটকসহ একটি দেশীয় বন্দুক, ছয় রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও ডাকাত সন্দেহে আরও তিন জনকে আটক করা হয়।