আম উৎপাদনে দেশখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে গতানুগতিক জাতগুলোর পাশাপাশি উন্নত জাতের আম আবাদে ঝুঁকছেন চাষিরা। প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন ব্যবস্থায় স্বল্প সময়ে ভালো ফলন এবং বেশি দাম পাওয়া যায়—এমন জাতের নতুন নতুন আম বাগান গড়ে উঠছে। অনেকে বৃহদাকৃতির আম গাছ কেটে উন্নত জাতের আমবাগান গড়ে তুলছেন। এ অঞ্চলে উন্নত জাতের মধ্যে হাইব্রিড বারি আম-৪, গোরমতি ও ইলামতি জাত তিনটি ভালো সাড়া ফেলেছে। তিনটি জাতের আমই খেতে সুস্বাদু, কাঁচামিঠা ও পাকলে মিষ্টি।
জানা গেছে, বাংলাদেশের আশ্বিনা ও আমেরিকার লাইন এম-৩৮৯৬ এর সংকরায়ণের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাত ‘বারি আম-৪’ এরই মধ্যে চাষিদের মাঝে ভালো সাড়া ফেলেছে। নওগাঁ জেলায় গত বছর ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছিল। যেটা এ বছর ৩ হাজার ৬২৫ হেক্টর বেড়ে ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। বর্ধিত জমির অধিকাংশতেই ‘বারি আম-৪’ চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জেও এই জাতটির দিকে ঝুঁকছেন চাষিরা।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বারি আম-৪ উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড নাবিজাত। যেটি সংকরায়ণের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে উদ্ভবিত হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০০৩ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে চারা রোপণের জন্য মুক্তায়ন করা হয়। আমটির আকর্ষণীয় আকার-আকৃতি, স্বাদ, রং ও উৎপাদনের জন্য ভালো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই জাতের আমের ৮০ শতাংশই খাদ্যোপযোগী। রোগবালাই কম, গাঢ় হলুদ ও আঁশহীন এই আমের প্রতিটির ওজন হয় ৬০০ থেকে সাড়ে ৬০০ গ্রাম। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই আম গাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়। এছাড়া আম পাড়ার পর ৭ থেকে ৮ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
এদিকে, মৌসুমের শেষে (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) হাইব্রিড আম ‘ইলামতি’। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের বিজ্ঞানীরা গোমস্তাপুর উপজেলার রামচন্দ্রপুরের একটি বাগনে এই আমের সন্ধান পান। মাঝারি আকৃতির এই আমের গড় ওজন ৪২৭ গ্রাম। কাঁচা আম সবুজ আর পাকা অবস্থায় হাল্কা হলুদ। পাকা আমে সুঘ্রাণ রয়েছে।
অপরদিকে, বারি আম-১২ যেটা ‘গৌরমতি’ নামে অধিক পরিচিত। এই আম ইলামতিরও পরে বাজারে আসে। সে সময় অন্য জাতের আম বাজারে থাকে না বললেই চলে। এতে চাষিরা ভালো দাম পান। এই আমটির স্বাদ অনেকটাই ল্যাংড়া আমের মতো। কাঁচামিঠাও খাওয়া যায়। এই আমটিরও উৎপাদন ভালো। প্রতিটি আমের ওজন হয়ে থাকে প্রায় ৫০০ গ্রাম। গত বছর এই আম ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীরা। ৬ থেকে ৭ বছর বয়সী একটি গাছে এই আমের ফলন হেক্টর প্রতি ৪.৩ টন।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন জানান, হাইব্রিড বারি আম-৪ ও গোরমতি-এই দুটি জাত তাদের কাছে আছে। এই দুটি জাত বাংলাদেশ ফল গবেষণা কেন্দ্রের আবিষ্কার। এই দুটি জাতই এখন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উৎপাদন, স্বাদ, রং সবদিক দিয়েই ভালো সাড়া ফেলেছে নতুন এই জাত। এই জাত দুটির রোগ-বালাইয়ের আক্রামণের হার অন্য আমগুলোর চেয়ে কম। চাষিরা দামও ভালো পাচ্ছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক খয়ের উদ্দিন মোল্লা জানান, গৌরমতি আমটি মৌসুমের শেষে বাজারে আসছে। যে কারণে দামটা অন্য আমের চেয়ে বেশি পাচ্ছেন চাষিরা। আর যেকোনও আম যখন সবার শেষে আসবে তখন পোকামাকড়ের আক্রমণের হারটা মৌসুমের তুলনায় বেড়ে যায়। তবে এখন আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পোকাসহ রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা মাঠ পর্যায়ের চাষিরা খুব ভালো বোঝেন। এটা নিয়ে কোনও শঙ্কা নেই। লাভজনক হওয়ায় নতুন জাতগুলোর প্রতি আম চাষিরা আকৃষ্ট হচ্ছেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এদিকে ‘বাঘাশাহী’ আম মে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পাকে। আঁশ নেই, আঁটি ছোট। মিষ্টতার পরিমাণ ক্ষীরশাপাতি বা হিমসাগরের কাছাকাছি। নিজস্ব ঘ্রাণ আছে। পাকার পরে টিকে থাকে কমপক্ষে আট দিন। প্রতিবছর আম ধরে। সম্প্রতি এমন ব্যতিক্রমধর্মী জাতের দুটি আমগাছের সন্ধান পেয়েছে কৃষি বিভাগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন জাতের এই আমের গাছগুলো রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বলিহার গ্রামের। উৎপত্তিস্থলের সঙ্গে মিল রেখে কৃষি কর্মকর্তারা আমের নামকরণ করতে চাইছেন ‘বাঘাশাহী’। ইতোমধ্যে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বাঘা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাঘা পৌরসভার মেয়র আবদুর রাজ্জাকের বাগানে এই জাতের দুটি আমগাছ রয়েছে। বয়স ৩০-৪০ বছর। গুটি আম হিসেবে মেয়রের পরিবার গাছটি থেকে আম খেয়ে আসছেন। প্রতিবছর আম ধরে।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান জানান, বাঘাশাহী হবে আগাম জাতের একটি নতুন আম। এই আমটি ক্ষীরশাপাতি আমের মতো সুমিষ্ট এবং এর নিজস্ব ঘ্রাণ আছে। তিনি এই সুমিষ্ট আম খেয়ে এর সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন। যেহেতু এই আমটি বৈশাখ মাসের শেষ সপ্তাহে পাওয়া যায় এবং এ সময় বাজারে এ রকম সুমিষ্ট আম পাওয়া যায় না, তাই এর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে বলে তিনি মনে করেন।
আমের আকার ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, এই আম আম্রপালি আমের মতো দেখতে। এর কোনও আঁশ নেই এবং এর আঁটি ছোট বিধায় পাল্পের পরিমাণ অনেক বেশি। অন্যান্য আম পাকার পরে তিন-চার দিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু এই আম পাকার পরে সাত-আট দিন পর্যন্ত ভালো থাকে। এই আম পাকার পরে খুব আকর্ষণীয় রং ধারণ করে। ‘অল্টারনেট বিয়ারিং’-এর কারণে অন্যান্য আমগাছে যেখানে এক বছর ভালো আম হলে পরের বছর সেভাবে হয় না, সেখানে এই জাতের আম প্রতিবছর একই পরিমাণে ধরে।
শফিউল্লাহ সুলতান আরও বলেন, এই গাছ থেকে সায়ন (কলম তৈরি করার সময় আমগাছের ডালের যে ডগা ব্যবহার করা হয়, সেটাকেই কৃষিবিদেরা সায়ন বলে থাকেন) সংগ্রহ করে চারা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন নার্সারিতে দেওয়া হবে এবং দুই-তিন বছরের মধ্যে সেই চারা সবাই কিনতে পারবেন। আমগাছটি বাঘায় অবস্থিত হওয়ায় এর নামকরণ করা হয়েছে বাঘাশাহী। আগামী বছর থেকে নার্সারিতে এই জাতের চারা যাতে পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।
অন্যদিকে রাজশাহীতে এ মৌসুমে ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে এসেছে আম। গতবার ছিল ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আম চাষ। গতবারের তুলনায় এবার বেড়েছে ৫৭২ হেক্টর জমি। এ জমি থেকে এবার দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৭৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। যা হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ১১.৬০ মেট্রিক টন আম। তবে কেজি প্রতি এবার আমের গড় ধরা হয়েছে ৪২ টাকা। সে হিসাবে এবার ৯০১ কোটি টাকার আমের বেচাকেনা হবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, গত মৌসুমে আমের উৎপাদন বেশি হলেও করোনার কারণে আম চাষিরা দাম পাননি। গেলো মৌসুমে আম উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ১৭ হাজার ১২৮ মেট্রিক টন। গড়ে এর দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪০ টাকা কেজি। সে হিসাবে ৮০৬ কোটি ৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকার ব্যবসা হয়েছে। আর এ বছর তুলনামূলক বেশি জমিতে আমের চাষ হলেও আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৭৬ মেট্রিক টন আম; যা টাকার হিসাবে প্রায় ৯০১ কোটি টাকা। গতবারের তুলনায় এবার ১০০ কোটি বেশি।