পুরনো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে অর্থের বিনিময়ে নতুন ব্যবসায়ীদের ফুটপাতের জায়গায় দোকান বসানোর জন্য দিয়েছেন ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের বাজার পরিদর্শক খন্দকার জাহাঙ্গীর আলম। মহানগরীর মেছুয়া বাজারের পালিকা শপিং সেন্টার থেকে জিলাপি পট্টি পর্যন্ত সড়কের ফুটপাত লিজ দিয়েছেন তিনি।
প্রতিকার চেয়ে ভুক্তভোগী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু বিদেশে থাকায় এ বিষয়ে কোনও সমাধান হচ্ছে না। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ মেছুয়া বাজারের ব্যবসায়ীরা।
বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) দুপুরে মেছুয়া বাজারের মাছের আড়তের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, মুরগি বিক্রেতা হেপি আক্তার (৫০) হাউমাউ করে কাঁদছেন। তিনি বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে মাছের আড়তের সামনের সড়কের ফুটপাতে ভিটা নিয়ে মুরগি বিক্রি করে আসছি। আমার ছয় মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে ক্যানসারে আক্রান্ত। মুরগি বিক্রির আয় দিয়ে সংসারের খরচসহ মেয়ের চিকিৎসা ব্যয় চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এক মাস আগে ড্রেন পরিষ্কার করার নামে সিটি করপোরেশনের বাজার পরিদর্শক খন্দকার জাহাঙ্গীর আলম ও তার সহকর্মীরা ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের দোকান উচ্ছেদ করেন। এর ১৫ দিনের মাথায় টাকা নিয়ে নতুন ব্যবসায়ীদের ওই জায়গা লিজ দিন। ওই জায়গা দাবি করলে জাহাঙ্গীর আলম আমার কাছে ছয় লাখ টাকা দাবি করেন। খুব কষ্টে সুদের ওপর তিন লাখ টাকা জোগাড় করে জাহাঙ্গীর আলমকে দিই। কিন্তু চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারায় আমাকে লিজ দেওয়া হয়নি। অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে সজীব নামে এক ব্যবসায়ীকে কাঁচামাল বিক্রির জন্য আমার জায়গা লিজ দেওয়া হয়েছে। এখন জায়গা পাওয়ার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কীভাবে আমার সংসার চলবে, কীভাবে ক্যানসার আক্রান্ত মেয়ের চিকিৎসা খরচ চলবে; এসব নিয়ে আমি খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।
শুধু হেপি আক্তার নন, এরকম অভিযোগ প্রায় অর্ধশত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর। জামালপুরে নদীভাঙন এলাকা থেকে এসে ময়মনসিংহ মহানগরীর পাটগুদামে বসবাসকারী সবজি বিক্রেতা শেফালী আক্তার (৫০)। তিনি জানান, প্রায় ২৫ বছর ধরে মেছুয়া বাজারের পালিকা শপিং সেন্টারের মোড়ে শাক-সবজি বিক্রি করছেন। এই আয় দিয়ে বাসা ভাড়াসহ সংসার খরচ চলছে। আবার নতুন করে দোকানের জায়গা লিজ নেওয়ার জন্য জাহাঙ্গীর আলম দুই লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে না পারায় গত দুই সপ্তাহ ধরে দোকানে তাকে বসতে দিচ্ছে না। তার জায়গায় নতুন করে একজনকে সবজি বিক্রির জন্য জায়গা দিয়েছেন জাহাঙ্গীর। এখন পথে বসেছেন তিনি।
বৃদ্ধ নিতাই পাল (৭৫) বলেন, টাকা দিতে না পারায় আমাকে জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে দিয়েছেন জাহাঙ্গীর। ৫০ বছর ধরে এই জায়গায় ব্যবসা করে সংসার চালিয়েছি। এখন বেকার হয়ে পথে পথে ঘুরছি।
মেছুয়া বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, এক মাস আগে মেছুয়া বাজারের ড্রেন পরিষ্কার করার নামে সিটি করপোরেশনের বাজার পরিদর্শক খন্দকার জাহাঙ্গীর আলম অর্ধশত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে উচ্ছেদ করেন। ১৫ মার্চ থেকে নতুন করে মাসে তিন হাজার টাকা ভাড়া এবং লাখ লাখ টাকা নিয়ে জায়গা লিজ দেন। লিজ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও আইন মানা হয়নি। বাজার পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় প্রভাবশালী সোহেল বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে জায়গা লিজ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
নতুন করে জায়গা লিজ নেওয়া ফল ব্যবসায়ী আশরাফুল আলম জানান, মাসে তিন হাজার টাকা ভাড়ায় তিনি জায়গা লিজ নিয়েছেন। এজন্য তাকে অতিরিক্ত আরও এক লাখ টাকা খন্দকার জাহাঙ্গীর আলমকে দিতে হয়েছে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা গোপন রাখতে বলেছেন জাহাঙ্গীর আলম।
মেছুয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতা হাফিজুর রহমান টিপু বলেন, নতুন করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জায়গা পেতে বাজার পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলমকে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে। বাড়তি টাকা ছাড়া কাউকে জায়গা লিজ দেননি তিনি।
তিনি আরও বলেন, পুরনো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পেরে এখন পথে বসে গেছে। এর প্রতিকার চেয়ে মেয়রের কাছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কোনও কাজে আসেনি। অসহায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মানবিক দিক বিবেচনায় এনে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাই।
তবে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বাজার পরিদর্শক খন্দকার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নতুন করে জায়গা পেতে কাউকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়নি। প্রত্যেকে মাসে তিন হাজার টাকা জমা দিয়ে রশিদ নিয়েছেন। কিছু ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছেন। এজন্য মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি কিছুদিন আগে সিটি করপোরেশনে যোগ দিয়েছি। এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে অভিযোগের সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।